হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট ও ‘বাংলাদেশী আদানি’দের কথা

কানাই দাশ | মঙ্গলবার , ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৩৩ পূর্বাহ্ণ

সম্প্রতি মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ ভারতের তথা এশিয়ার শীর্ষ ধনী ব্যক্তি গৌতম আদানির শেয়ার কারসাজি ও তাঁর বিশাল কর্পোরেট হাউসের আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে এক বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করার পর পুরো ভারত জুড়ে শোরগোল পড়ে যায়। বোম্বে স্টক মার্কেটে আদানির বিশাল শিল্প কমপ্লেক্সের বিভিন্ন কোম্পানীর শেয়ারের দাম দ্রুত পড়তে থাকে। শেয়ারের এই ক্রমাগত ধসের কারণে ইতোমধ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূলধন কমে শীর্ষ ধনীর তালিকায় তিনি সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী আর নেই। কিছুদিন আগে পেছনে পড়ে থাকা মুকেশ আম্বানি বর্তমানে এশিয়ার শীর্ষ ধনীর স্থানটি পুনর্দখল করেছে। ভারত, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অতি অল্প সময়ে ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠা ‘আদানিদের’ উত্থান নিয়েই আজকের এই আলোচনা।

ছোট বেলা থেকে ভারতের শীর্ষ ধনী পরিবার হিসাবে নাম শুনে আসা টাটা, বিড়লা, গোয়েঙ্কারা এখন ভারতের আর্থিক হিসাবের খাতায় পেছনে চলে গেছে। যদিও স্থাবর সম্পত্তি ও সামর্থ্যের কারণে টাটা কোম্পানি এখনো প্রভাবশালী কর্পোরেট হাউস হিসাবে পরিগণিত হয়। মূলত উনবিংশ শতাব্দী থেকে ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকা টাটাবিড়লা প্রমুখ ধনী পরিবারগুলো পুঁজিবাদী পথে ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশ ও শিল্প পরিকাঠামো, ব্যাংকিং খাত গঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। চিরায়ত পুঁজিবাদী উৎপাদনের সম্পর্কের মধ্যে ঔপনিবেশিক ভারতে গড়ে উঠা এসব ভারতীয় ধনী পরিবারের ব্যবসা ও শিল্প কারখানাকে মানুষ ঔপনিবেশিক শোষণের বিপরীতে ভারতীয়দের মর্যাদা ও স্বনির্ভরতার শক্তি ও প্রতীক হিসাবে দেখত। ঐ সমস্ত ধনী পরিবারের সাথে পরাধীন ভারতের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল কংগ্রেসেরও স্বাভাবিক সুসম্পর্ক ছিল। দেশীয় বিশাল ধনী পরিবারগুলো নিজেদের স্বাধীন বিকাশ ও ব্যাপ্তির আকাঙ্ক্ষায়, স্বাধীন ভারতের ভবিষ্যৎ বিশাল বাজার নিয়ন্ত্রণের অভিপ্রায়ে এবং পুঁজিবাদের অসম বিকাশের স্বাভাবিক নিয়মে বৃটিশ পুঁজির বিরুদ্ধেই ছিল।

স্বাধীন ভারতের সীমিত আমদানির সংরক্ষণবাদী বাজার ব্যবস্থার কারণে ১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত চিরায়ত পুঁজিবাদী পথে গড়ে উঠা ধনী পরিবারগুলির প্রভাব ভারতীয় অর্থনীতিতে অব্যাহত ছিল। কিন্তু অস্তিত্ব ও বিকাশের সহজাত সংকট বারবার পুঁজিবাদকে তার রূপ পাল্টাতে বাধ্য করেছে। ক্রমে তা অনৈতিক, হিংস্র ও আগ্রাসীরূপ নিয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে আদানিদের উত্থান ও পতনের ইতিবৃত্ত সেই পটভূমিতে দেখতে হবে।

আদিম পুঁজি সঞ্চয়ের নির্মমতার পরবর্তী যুগে পুঁজিবাদ নিজের বিকাশের প্রয়োজনে কিছু সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধ গড়ে তুলে। ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সর্বজনীন ভোটাধিকার, শিক্ষা মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতার বিপরীতে যুক্তি ও বিজ্ঞান মনস্কতা প্রভৃতি কিছু প্রগতিশীল ভাবনায় সমাজ ঋদ্ধ হয় কিন্তু পুঁজির শোষণ অব্যাহত থাকে সভ্যতা ও কথিত মানবিকতার মোড়কে। যখনি সংকটে পড়ে তখনি পুঁজিবাদের হিংস্র রূপ ইতিহাস বার বার প্রত্যক্ষ করেছে। ১৮৬০ এর দশকে তার পরিবর্তিত আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদীরূপ, ১৯৩০ এর দশকের সংকট উত্তরণে ফ্যাসিবাদের ভয়ংকর উত্থান, নিজেদের দ্বন্দ্বে দুটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ মারণযজ্ঞ ইত্যাদি পুঁজিবাদ সংঘটিত করেছে। কিন্তু ব্যবস্থার সহজাত সংকট কোনদিন পুঁজিবাদকে পিছু ছাড়েনি। কিছুদিন পর পর তা নতুনরূপে দেখা দেয়। ওয়েল ফেয়ার স্টেট নামে কথিত অর্থনীতির দেশগুলোও আজ সংকটে।

১৯৭০ এর দশকে এসে আবারো পুঁজিবাদের আভ্যন্তরীণ সংকট খ্যাত stagflation এর কারণে সাধারণ মানুষের কাছে কিছুটা সহনীয়, কিছুটা সরকার নিয়ন্ত্রিত কেইনসীয় মডেলের প্রচলিত পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে সংকট উত্তরণে আরো আগ্রাসী নিও লিবারেল অর্থনীতির প্রবর্তন করে পুঁজিবাদের মোড়লরা। এদের সৃষ্ট বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মাধ্যমে তা আর্থিকভাবে দুর্বল স্বল্পোন্নত দেশগুলোর শাসকশ্রেণিকে দিয়ে জোর করে চালু করে বিশ্বব্যাপী। স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্টের নামে এসব দেশগুলোর সরকারি নিয়ন্ত্রিত কলকারখানা, ব্যাংক বীমা ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। মার্কিন অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান এই নিও লিবারেলিজমের তথা লুটেরা অর্থনীতির মূল প্রবক্তা। সংক্ষেপে সেই অর্থনীতির মূল কথা হলো উখচডিরেগুলারাইজেশন, লিবারেলাইজেশন ও প্রাইভেটাইজেশন অর্থাৎ সরকারি নিয়ন্ত্রণ মুক্ত অর্থনীতি, শিল্প ও বাণিজ্যের অবাধ অধিকার ও সরকারি সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর। তখন থেকে প্রয়োজনে নানা চক্রান্ত বা জোর করে রেজিম চেইঞ্জ করে পৃথিবীর উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে এই অর্থনীতির চালুর উদ্যোগ নেয় পুঁজিবাদী বিশ্ব। ভারতে তা তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব হয়নি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও দেশীয় বৃহৎ পুঁজির অস্তিত্বের কারণে। ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় খাতের সাথে প্রতিযোগিতা করে টাটাবিড়লা তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে আইনের সুস্থ পথে। ভারতে গড়ে উঠে মোটামুটি স্বনির্ভর ও একটি স্বাধীন পুঁজিবাদী অর্থনীতি। কিন্তু স্থবিরতার কথা বলে ১৯৯০ সালে অর্থমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং আর্থিক সংস্কারের নামে ভারতের রক্ষণশীল বাজার ব্যবস্থা উন্মুক্ত করে দেন। আমলা ও রাজনৈতিক যোগসাজশে, চৌর্যবৃত্তি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে সুবিধা আদায় করে আম্বানিআদানি প্রমুখ টেলিযোগাযোগ, ব্যাংক, বীমা, বন্দর, জ্বালানি, খনিসহ গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক খাত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে শুরু করে। দ্রুতই পুঁজি বাজারে টাটা, বিড়লার মতো ঐতিহ্যবাহী শিল্প মালিকরা পিছিয়ে পড়ে। ২০১৪ সালে আদানিআম্বানিদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ক্ষমতায় এসে তাদের জন্য মোদি সব আর্থিক খাত উন্মুক্ত করে দেয়। একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক সংস্থা এদের হাতে তুলে দেয়। এক্ষেত্রে আদানি এগিয়ে থাকে। তার হাতে এমনকি সম্প্রতি রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাও আংশিক ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সরকারি ব্যাংক থেকে দেদার টাকা ঋণ নিয়ে শেয়ার মার্কেটের মাধ্যমে আদানি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। বৃহৎ দেশ হিসেবে ভারতের এই লুটেরা গোষ্ঠী সম্পদের দিক থেকে সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

এই প্রেক্ষিতে মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ তার রিপোর্টে দেখিয়েছে কী করে আদানিরা স্টক মার্কেট থেকে লক্ষ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, কী করে সরকারি পৃষ্ঠ পোষকতায় ভারতের চিরায়ত পুঁজিবাদকে কলঙ্কিত করে মোদির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গৌতম আদানি রেকর্ড কম সময়ে প্রায় ১২ হাজার কোটি ডলারের মালিক হয়ে বিশ্বের সেরা ধনীদের টেক্কা দিতে শুরু করেছে। নিও লিবারেল পলিসির কারণে আজ ভারতের অর্থনীতি দেশীবিদেশি মুষ্টিমেয় লুটেরাদের মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বিরোধীরা এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছে পার্লামেন্টের ভিতরেবাইরে। কংগ্রেস ও বামেরা দীর্ঘদিন ধরে আদানিআম্বানির বিরুদ্ধে বলছেন। কিন্তু সরকার সবসময় নীরব ভূমিকায় রয়েছে। হয়ত কিছু দিন পরে ধর্মীয় কোনো উসকানি দিয়ে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে নিয়ে যাবে। নির্লজ্জের মতো মূল অভিযোগ এড়িয়ে গিয়ে আদানিদের পক্ষ থেকে বলা হলো হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট নাকি ভারতের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত। হিন্ডেনবার্গ প্রত্যুত্তরে বলেছে জাতীয় পতাকা গায়ে দিয়ে আদানি জাতিকে লুটে নিচ্ছে এবং পারলে অভিযোগগুলো খণ্ডন করতে অনুরোধ করেছে।

দুর্বলতর আর্থিক পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালেই সামরিক শাসনের সুযোগে বাংলাদেশে এই লুটেরা মুক্ত বাজার অর্থনীতি জেনারেল জিয়ার আমলে সূচিত হয়। বাংলাদেশে তখন বেসরকারি খাতে শুধু ব্যাংক প্রতিষ্ঠান অনুমতি নয় সরকারি ব্যাংক নামমাত্র মূল্যে ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয় স্বজন প্রীতির মাধ্যমে। ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকার প্রাক্কলিত ৩৫০ কোটি টাকার পূবালী ব্যাংক মাত্র ১৬ কোটি টাকায় ব্যক্তি মালিকানায় দিয়ে দেন। ঐ টাকাও অন্য সরকারী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে প্রদান করা হয় কিস্তিতে। সরকারি সম্পত্তি লুটপাটের এটি একটি নমুনা মাত্র। এরকম অসংখ্য সরকারি শিল্প কলকারখানা ১৯৮০ থেকে পরবর্তীতে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আদমজিসহ দেশের সব শিল্প এলাকা এখন বিরান হয়ে গেছে। এভাবেই বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এর বাধ্যবাধকতায় দেশে লুটেরা, লুম্পেন ও স্বজনপ্রীতির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে একটি বিকৃত ক্রোনি ক্যাপিটেলিজম ও একটি লুটেরা ধনাঢ্য গোষ্ঠি, যারা দেশের অর্থনীতিকে গ্রাস করে এখন রাজনীতি ও রাষ্ট্র ক্ষমতা করায়ত্ত করে নিতে চাইছে সামরিক বেসমারিক আমলা পুঁজির সাথে এক অশুভ আতাঁতে। এ শক্তিশালী আঁতাত এখন এ দেশের পুরো ব্যাংকিং সেক্টর, জ্বালানী খাত ও আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য বিশাল সিন্ডিকেট করে সম্পূর্ণ কুক্ষিগত করে নিয়েছে। শেয়ার বাজারে ১৯৯৬ সালে ও ২০১০ সালে কারসাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে দিয়েছে চিহ্নিত কিছু লুটেরা গোষ্ঠী। আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত প্রখ্যাত ব্যাংকার খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এর তদন্ত কমিশন দুই বৃহৎ দলের কয়েকজনকে এই কেলেংকারীর মূল হোতা হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এদের বিচার হবে দূরে থাক একজন মূল অভিযুক্ত এখন জ্বালানি স্বাস্থ্যসহ নানা বিষয়ে সরকারের পরামর্শ দাতা এবং সম্ভবত দেশের শীর্ষ ধনী। নিছক লুটপাট ও বিদেশে ব্যাপক অর্থ পাচারের ফলে আজ ব্যাংক খাত এক অভাবনীয় দুরবস্থায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু অপরিমেয় অর্থ পাচার ও কোটিপতি তৈরিতে রেকর্ডধারী আমাদের দেশে এই সর্বশক্তিমান, সরকারি ও বিরোধী দলে বিভক্ত লুটেরা পুঁজির মালিক, শেয়ার বাজারের লুটেরাদের নিয়ে কেউ কিছু বলে না। অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মইনুল ইসলাম সাম্প্রতিক এক লেখায় বলেছেনমাননীয় অর্থমন্ত্রী এসব ঋণ খেলাপী ও লুটেরাদের কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রেখেছেন (আজাদী ০২/০২/২০২৩)। আমরা বাংলাদেশী আদানিদের এই বীভৎস ও নির্মম লুটপাটের কাহিনি, লক্ষ কোটি টাকা পাচারের কথা জানতে চাই। জানতে চাই এদের পৃষ্ঠপোষকদের পরিচয়। হিন্ডেনবার্গ বা অন্য কেউ কি এ নিয়ে আমাদের সাহায্য করবেন?

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামের নারী নেতৃত্ব
পরবর্তী নিবন্ধসিএসইতে লেনদেন ৭.৩০ কোটি টাকা