হাসিনার পদত্যাগ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি মিথ্যাচার করেছেন : আসিফ নজরুল

তার পদে থাকার যোগ্যতা নিয়ে ভাবতে হবে

| মঙ্গলবার , ২২ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ইস্যুতে বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন মিথ্যাচার করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। গতকাল সোমবার দুপুরে সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে নিজ অফিসকক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ মন্তব্য করেন তিনি। আইন উপদেষ্টা বলেন, তার এ পদে থাকার যোগ্যতা আছে কিনা, এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তিনি যদি তার বক্তব্যে অটল থাকেন, তাহলে বিষয়টি উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হতে পারে। খবর বাংলানিউজের।

সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপকালে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তাকে বলেন, তিনি শুনেছেন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তবে তার কাছে এর কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। কথোপকথনটি রোববার পত্রিকাটির রাজনৈতিক ম্যাগাজিন ‘জনতার চোখ’এ প্রকাশিত হয়। এরপর নতুন করে আলোচনায় আসে হাসিনার পদত্যাগপত্রের বিষয়টি।

রাষ্ট্রপতির এমন মন্তব্য নিয়ে জানতে চাইলে আইন উপদেষ্টা বলেন, রাষ্ট্রপতি যে বলেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র পাননি, এটি হলো মিথ্যাচার, তার শপথ লঙ্ঘনের শামিল। কারণ, তিনি নিজেই গত ৫ আগস্ট রাত ১১টা ২০ মিনিটে পেছনে তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং তা তিনি নিয়েছেন।

আসিফ নজরুল বলেন, এরপর তার (রাষ্ট্রপতি) কাছ থেকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে জানতে চাওয়া হয়, এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উপদেশমূলক এখতিয়ার প্রয়োগ করে তা জানতে চাওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের

তৎকালীন যে প্রধান বিচারপতি ছিলেন, তিনিসহ অন্য বিচারকেরা মিলে একটি মতামত দেন। সেই মতামতের প্রথম লাইন হলো, ‘দেশের বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন।’ সেখানে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ

আপিল বিভাগের সব বিচারকের সই আছে।

উপদেষ্টা বলেন, এই যে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন, রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেন; এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা যায়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামতের ভিত্তিতে একটি নোট মন্ত্রণালয় থেকে রাষ্ট্রপতির দপ্তরে পাঠাই। রাষ্ট্রপতি এ অভিমত দেখেন এবং নেন। এরপর তিনি নিজে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন।

তিনি বলেন, গত ৫ আগস্টের ভাষণ, এরপরের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত, তিনি (রাষ্ট্রপতি) পুরো জাতির কাছে বিভিন্নভাবে বারবার নিশ্চিত করেছেন এবং সুনিশ্চিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র দিয়েছেন এবং তিনি তা নিয়েছেন। আজ যদি প্রায় আড়াই মাস পর তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র দেননি, তাহলে এটি এক ধরনের স্ববিরোধিতা হয়, শপথ লঙ্ঘন হয় এবং তার এ পদে থাকার যোগ্যতা আছে কিনা সে সম্পর্কে প্রশ্ন আসে।

আইন উপদেষ্টা বলেন, আমরা জানি, বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে, আপনার যদি শারীরিক মানসিক সক্ষমতা না থাকে বা আপনি যদি গুরুতর অসদাচরণ করেন, তখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে থাকতে পারেন কিনা, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আমাদের সংবিধানে রয়েছে। স্ববিরোধী কথাবার্তা বলার কোনো সুযোগ নেই। যদি তিনি এ বক্তব্যে অটল থাকেন, তাহলে তার রাষ্ট্রপতির পদে থাকার যোগ্যতা আছে কিনা তা আমাদের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভায় ভেবে দেখতে হবে।

পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রের কাছে দেখাতে পারবেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতির কাছেই পদত্যাগ করেন। সেটি রাষ্ট্রপতির দপ্তরেই থাকার কথা। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, এ নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তিনি বলেছেন, পদত্যাগপত্র নিয়েছেন, এখন বলছেন নেননি। তিনি পদত্যাগপত্র কী করেছেন, সেটি তাকেই জিজ্ঞেস করুন।

রাষ্ট্রপতির এ ধরনের কথা বলার পেছনে কোনো কারণ আছে বলে আপনি মনে করেন কিনাজানতে চাইলে আইন উপদেষ্টা বলেন, আমি এখানে অনুমান করতে আসিনি এবং অনুমানের জায়গায় নেই। তবে এ নিয়ে সমাজে প্রশ্ন আসতে পারে। আজ যখন দেখি পতিত ফ্যাসিস্ট মাথাচাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর বিভিন্ন আয়োজন করছে, তখন হঠাৎ করে তিনি আড়াই মাস পর এ কথা বললেন কেন? এ নিয়ে সমাজে প্রশ্ন আসতে পারে। আসা খুব স্বাভাবিক। এতদিন পর এ ধরনের কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।

জনতার চোখ’এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, আমি বহুবার পদত্যাগপত্র সংগ্রহের চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। হয়ত তার সময় হয়নি। ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে বঙ্গভবনে ফোন আসে, যেখানে বলা হয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসবেন। এরপরই বঙ্গভবনে প্রস্তুতি শুরু হয়। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যে আরেকটি ফোন আসে যে, তিনি (শেখ হাসিনা) আসছেন না।

তিনি বলেন, চারদিকে অস্থিরতার খবর। কী হতে যাচ্ছে জানি না। আমি তো গুজবের ওপর নির্ভর করে বসে থাকতে পারি না। তাই সামরিক সচিব জেনারেল আদিলকে বললাম খোঁজ নিতে। তার কাছেও কোনো খবর নেই। আমরা অপেক্ষা করছি। টেলিভিশনের স্ক্রলও দেখছি। কোথাও কোনো খবর নেই। এক পর্যায়ে শুনলাম, তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আমাকে কিছুই বলে গেলেন না। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার যখন বঙ্গভবনে এলেন তখন জানার চেষ্টা করেছি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন কিনা? একই জবাব। শুনেছি, তিনি পদত্যাগ করেছেন। মনে হয় তিনি সময় পাননি জানানোর।

রাষ্ট্রপতি বলেন, সবকিছু যখন নিয়ন্ত্রণে এলো, তখন একদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এলেন পদত্যাগপত্রের কপি সংগ্রহ করতে। তাকে বললাম, আমিও খুঁজছি। এ বিষয়ে আর বিতর্কের সুযোগ নেই। শেখ হাসিনা চলে গেছেন এবং এটাই সত্য। তবু এই প্রশ্নটি যাতে আর কখনো না ওঠে, তা নিশ্চিত করতে আমি সুপ্রিম কোর্টের মতামত চেয়েছি।

তবে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র না পেলেও নতুন সরকারের আইনি বৈধতা নিয়ে কোনো সংকট নেই বলেও রাষ্ট্রপতি মন্তব্য করেছেন বলে জানিয়েছেন মতিউর রহমান চৌধুরী।

গত ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটে। এরপর তিনি ভারতে পালিয়ে যান। এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকারউজজামান জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর জানান। এরপর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং তিনি তা নিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ডিজিটালাইজেশনে গুরুত্ব প্রধান উপদেষ্টার
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬