বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে উপস্থিত থাকুন বা না থাকুন, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতেই হবে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বিচার অবশ্যই হবে। শুধু তিনি নন, তার সঙ্গে যারা জড়িত, তার পরিবারের সদস্য, তার সহযোগী ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাও বিচারের আওতায় আসবেন। খবর বিডিনিউজের।
প্রবল গণ আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে সেখানেই আছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ছাত্র–জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো দমন পীড়নকে গণহত্যা বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুবনালে শেখ হাসিনাসহ তার সহযোগীদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এছাড়া গোপন বন্দিশিবিরের একটি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে, যেখানে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আটকে রাখা, গুম ও হত্যার মত ঘটনা ঘটত বলে অভিযোগ রয়েছে।
হত্যা ও গুমের দুই মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে ট্রাইব্যুনাল। প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় তাকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে সরকার ভারতকে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠালেও দিল্লি তার উত্তর দেয়নি বলে সাক্ষাৎকারে জানান ইউনূস। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, শেখ হাসিনাকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে, তা তিনি সশরীরে বাংলাদেশে থাকুন বা না থাকুন। ভারতে থাকলেও তার অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে।
‘আয়নাঘর’ নামে কুখ্যাতি পাওয়া শেখ হাসিনার আমলের কয়েকটি বন্দিশালা সম্প্রতি ঘুরে দেখার কথাও সাক্ষাৎকারে বলেন প্রধান উপদেষ্টা। তার ভাষায়, সেখানে তিনি যা দেখেছেন, তাতে শিউরে উঠেছেন। এটা এমন এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার, যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, অনুভব করতে পারবেন না বা দেখলেও বিশ্বাস করতে পারবেন না, তিনি বলেন।
স্কাই নিউজ লিখেছে, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধ মতের শত শত কর্মীকে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ রয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি দাবি করেছেন, তাকে রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। সারা দেশে আট শতাধিক গোপন বন্দিশিবির পরিচালনায় যারা জড়িত ছিলেন, শেখ হাসিনার সেই ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। সেসব অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা এবং তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে সময় লাগছে জানিয়ে ইউনূস সাক্ষাৎকারে বলেন, এতে সবাই জড়িত ছিল। পুরো সরকারই এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাই কারা নিজেদের আগ্রহে এটা করেছে, কারা সরকারের আদেশে এটা করেছে, আর কারা বাধ্য হয়ে করেছে– এটা নির্ধারণ করা কঠিন।
শেখ হাসিনার নির্দেশে আইন–শৃঙ্খলা বাহিনী গত বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে যে সহিংস দমন–পীড়ন চালিয়েছে, তাতে জাতিসংঘের হিসেবে প্রায় ১,৪০০ মানুষের প্রাণ গেছে। স্কাই নিউজ লিখেছে, আন্দোলনে হতাহতদের পরিবার যেন দ্রুত ন্যায়বিচার পায়, সেই প্রত্যাশার চাপ রয়েছে অধ্যাপক ইউনূসের ওপর। অন্তর্বর্তী সরকার থাকতে থাকতেই যাতে সেই বিচার করা যায়, সেই চেষ্টা ইউনূস করছেন। তার ভাষায়, কিছু অপরাধীর বিচার হবে, কিছু বিচারের প্রক্রিয়ায় থাকবে, আর কেউ কেউ হয়ত ধরাছেঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনার ভাগ্নি ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনার ভাগ্নি ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে। দেশের অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে দায়িত্ব নেওয়ার পর অধ্যাপক ইউনূসকে নানামুখি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যার মধ্যে শেখ হাসিনার আমলের দুর্নীতির তদন্তও রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে, তাদের মধ্যে ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ সিদ্দিকও আছেন, যিনি শেখ হাসিনার ভাগ্নি। ইউনূস সাক্ষাৎকারে বলেন, টিউলিপের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। দেশে তার বিপুল সম্পদসহ সবকিছুই খতিয়ে দেখা হবে।
বাংলাদেশে দুদকের তদন্তে নাম বাসার পর লন্ডনে বেশ কয়েকটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়, যেগুলো টিউলিপ ও তার পরিবারের সদস্যরা শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছেন। এ নিয়ে ব্যাপক শোরগোলের মধ্যে গত জানুয়ারিতে সিটি মিনিস্টারের পদ থেকে পদত্যাগ করেন টিউলিপ। লন্ডনে তার একজন মুখপাত্র স্কাই নিউজকে বলেছেন, দুদক অভিযোগের বিষয়ে টিউলিপের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। আর তিনি সেসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।