পুনরায় করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলেছে চট্টগ্রামে। বিশেষ করে নতুন বছরের শুরু থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। যা দিন দিন বাড়ছেই। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বলছে, বছরের প্রথম দিন চট্টগ্রামে করোনা শনাক্তের হার ছিল ১ শতাংশের ঘরে। যা সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৪০ শতাংশে ঠেকেছে। আগের দিন এ হার ছিল প্রায় ৩৯ শতাংশ। তবে সংক্রমণ বাড়লেও মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ তেমন একটা ছিলনা বললেই চলে। কিন্তু এই সময়ে এসে করোনা রোগীর সংখ্যাও ধীরে বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে। বিশেষ করে গত এক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালেও রোগী বাড়তে শুরু করেছে। মহানগরের সরকারি–বেসরকারি উল্লেখযোগ্য বেশ কয়টি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন– ৮/১০ দিন আগেও করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত কেবিন/ শয্যা বেশির ভাগই খালি ছিল। কিন্তু গত এক সপ্তাহে এ চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে। এই সময়ে রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে হাসপাতালগুলোতে। করোনার ওমিক্রন ধরনের (ভ্যারিয়েন্ট) বিস্তার ঘটে যাওয়ায় সংক্রমণ দিন দিন বাড়ছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের উদ্যোক্তা ও প্রধান নির্বাহী ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া। তিনি বলেন, ভাইরাসের এ ধরন (ওমিক্রন) অন্যান্য ধরনের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি সংক্রামক। খুব বেশি দ্রুত ছড়ায়। যা ইতোমধ্যে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থাৎ সামাজিক সংক্রমণ ঘটে গেছে। যার ফলে এখন টেস্ট করলেই পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে।
তবে আশার কথা শুনিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী বলছেন, সংক্রমণ বাড়লেও আক্রান্ত সবাইকে কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে না। আক্রান্ত হলেই রোগীরা আগের মতো গুরুতর অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছেন না। জটিলতা কম দেখা যাচ্ছে। যার কারণে ঘরে থেকেই বেশিরভাগ রোগী সুস্থ হয়ে উঠছে। এটি টিকা গ্রহণের বড় ধরনের সুফল। তবে যারা টিকা নেননি, আক্রান্ত হলে তাদের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে বলে মন্তব্য করছেন ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী ও ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া।
সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কিছুটা হলেও বাড়ছে বলে স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি আজাদীকে বলেন, সংক্রমণ বাড়তে থাকলে আক্রান্তদের একটি অংশকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। এতে করে ধীরে হলেও হাসপাতালে রোগী বাড়বে। যা এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি হলেও এখনকার আক্রান্ত রোগীদের শরীরে জটিলতা কম দেখা যাচ্ছে বলে জানান বেসরকারি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের জিএম (মহাব্যবস্থাপক) মোহাম্মদ সেলিম। তিনি বলছেন, আক্রান্তদের অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হলেও জটিলতা কম। আগে রোগীদের যে হারে অঙিজেন সাপোর্ট দরকার পড়তো, এখন তাও লাগছেনা। ৫/৬ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন। আগে আক্রান্ত রোগীদের বেশিরভাগেরই ন্যূনতম ১২/১৫ দিন হাসপাতালে থাকতে হতো। সে তুলনায় এখন মানুষের ভয় বা আতংক কম বলে জানান মোহাম্মদ সেলিম।
কোন হাসপাতালে কত রোগী : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৯৩ জন। এর মধ্যে করোনা আইসিইউতে ২ জন রোগী চিকিৎসাধীন ছিল। ১০ দিন আগেও (গত ১৫ জানুয়ারি) মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৬০ জনের মতো। আর ১ জানুয়ারি ৩৩ জন রোগী ভর্তি ছিল এই করোনা ইউনিটে। প্রসঙ্গত, সর্বশেষ উচ্চ সংক্রমণ পরিস্থিতিতে তিন শতাধিক শয্যায় করোনা রোগীর চিকিৎসা দেয় চমেক হাসপাতাল। তবে সংক্রমণ কমে আসায় এ শয্যা কমিয়ে একশ শয্যায় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু একশ শয্যার এ ইউনিটে বর্তমানে শয্যার প্রায় সমান সংখ্যক করোনা রোগী ভর্তি রয়েছে। ক্রমবর্ধমান রোগীর চাপ সামাল দিতে প্রয়োজন হলেই শয্যা বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক হিসেবে সদ্য যোগ দেয়া ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান। গতকাল সোমবার তিনি আজাদীকে বলেন, তিন শতাধিক রোগীর সংস্থানে আমাদের প্রস্তুতি আছে। সংক্রমণ ও রোগী কমায় সাময়িক সময়ের জন্য শয্যা কমিয়ে দেয়া হয়েছিল। করোনা রোগীর চিকিৎসা দেয়া হতো, এমন বেশ কয়টি ওয়ার্ডে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। এখন প্রয়োজন হলেই করোনা ইউনিটের আওতায় এনে ওই সব ওয়ার্ডে পুনরায় করোনা রোগী ভর্তি করা হবে। সব ধরনের প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা নেয়া আছে বলেও জানান চমেক হাসপাতালের নতুন এ পরিচালক।
আইসিইউতে ১২ জনসহ সবমিলিয়ে ৪২ জন রোগী ভর্তি রয়েছে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। এ তথ্য নিশ্চিত করে হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, সপ্তাহখানেক আগেও রোগীর সংখ্যা ২০/২৫ জনের বেশি ছিলনা। এখন ৪০ জনের বেশি। অর্থাৎ পর্যায়ক্রমে রোগী বাড়ছে। তবে রোগীদের জটিলতা কম হওয়ায় আগের মতো পরিস্থিতি আশঙ্কা কম বলে মনে করছেন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি।
ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি হাসপাতালে গত ২ মাসের মধ্যে গতকাল ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ বলে জানান হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ডা. মামুনুর রশীদ। করোনা আক্রান্ত ও উপসর্গযুক্ত মিলিয়ে মোট ১৩ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন জানিয়ে ডা. মামুনুর রশীদ বলেন, অথচ সপ্তাহখানেক আগে সবমিলিয়ে ৩/৪ জন রোগী ছিল। এখন দিন দিন হাসপাতালেও রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
বেসরকারি মা ও শিশু হাসপাতালে ৫৪ জন রোগী ভর্তি ছিল গতকাল। এর মাঝে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ১৬ জন। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই রোগীর সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে বলে জানালেন মা ও শিশু হাসপাতালের কার্যনির্বাহী কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি রেজাউল করিম আজাদ। তিনি আজাদীকে বলেন, এক সপ্তাহ আগে সবমিলিয়ে ১০/১২ জন রোগী ভর্তি ছিল। কিন্তু এরপর থেকেই রোগীর সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বেড়েছে। সর্বশেষ সোমবার করোনা রোগীর সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়েছে।
রোগী বাড়ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও : বর্তমানে ২৮টি কেবিনে করোনা রোগী ভর্তি রয়েছে বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে। এর বাইরে আইসিইউতে ভর্তি রয়েছে আরো ৯ জন। এ তথ্য নিশ্চিত করে হাসপাতালের এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) ডা. এটিএম রেজাউল করিম আজাদীকে বলেন, করোনা রোগীদের চিকিৎসায় আমাদের নির্ধারিত ২৮টি কেবিনেই রোগী ভর্তি। চাপ বাড়তে থাকায় হাসপাতালের আরো একটি ফ্লোর চালুর কথা চিন্তা করছি। তবে অতিরিক্ত আরো দশটি আইসিইউ করোনা রোগীদের জন্য আমরা ইতোমধ্যে চালু করেছি। বর্তমানে করোনা রোগীদের জন্য ২০টি কেবিন বরাদ্দ রাখা হয়েছে বেসরকারি ন্যাশনাল হাসপাতালে। এর মধ্যে সোমবার (গতকাল) ২০ জন রোগী ভর্তি বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. মো. আমজাদ হোসেন। আইসিইউ প্রস্তুত থাকলেও করোনা আক্রান্তদের মাঝে আইসিইউতে রাখার মতো রোগী এখনো পাওয়া যায়নি জানিয়ে ডা. আমজাদ বলেন, ৮/১০ দিন আগে দৈনিক ১/২ জন করে রোগী ভর্তি হতো। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নির্ধারিত ১৮টি কেবিনে ১৪ জন রোগী ভর্তি রয়েছে বলে জানান হাসপাতালের জিএম মোহাম্মদ সেলিম। যদিও আইসিইউ ও এইচডিওতে রোগী নেই বলে জানান তিনি। আক্রান্তদের শরীরে জটিলতা কম
জানিয়ে মোহাম্মদ সেলিম বলেন, জটিলতা না থাকলেও আক্রান্ত অনেকে ভয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। তবে খুব অল্প সময়ে তারা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন। আগে রোগীদের অঙিজেন সাপোর্ট প্রয়োজন হতো। এখন তেমন করে অঙিজেনের সাপোর্ট দরকার হচ্ছে না। হাসপাতালে ভর্তি হলেও সবমিলিয়ে ৫/৭ দিনের মধ্যে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন।
বেসরকারি ম্যাঙ হাসপাতালের কেবিনে ৯ জন ও আইসিইউতে আরো ২ জন করোনা রোগী চিকিৎসাধীন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির জিএম রঞ্জন প্রসাদ দাশ। এক সপ্তাহ আগে রোগীর সংখ্যা বড় জোর ৪ থেকে ৫ জন ছিল বলেও জানান তিনি।
সিএসসিআর হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত ৬ জন রোগী ভর্তি রয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির আরএমও ডা. এমজাদ হোসেন। এর মধ্যে দুজন রয়েছেন আইসিইউতে। কয়েকদিন ধরে ২/১ জন করে রোগী ভর্তি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতিমাত্রায় সংক্রমণ বাড়লেও হাসপাতালে রোগীর চাপ এখনো বাড়েনি। যদিও কয়েকদিন ধরে রোগীর সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বাড়ছে। তবে এই সময়ে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে জটিলতা তেমন দেখা যাচ্ছেনা। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে অঙিজেন সাপোর্টও দরকার পড়ছেনা। ফলে সিংহ ভাগ রোগী নিজ বাসায় আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সুস্থ হয়েও উঠছেন। টিকা গ্রহণের সুবাদেই আক্রান্তদের শরীরে জটিলতা কম দেখা যাচ্ছে। যার কারণে এখনো যারা টিকা নেননি সবাইকে টিকা গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা। তবে টিকা নিলেও অবশ্যই মাস্ক পরার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী।