বৈশাখ মাস চলে গেলেও দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে মা মাছ ডিম না ছাড়ায় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে একটি জো চলে গেছে। ডিম সংগ্রহকারীরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করলেও মাছ ডিম ছাড়েনি। গত বছর রেকর্ড পরিমাণ ডিম সংগ্রহ হলেও এক বছরের ব্যবধানে এবার মাছের ডিম না ছাড়ার পেছনে নানা ধরনের সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করছেন অনেকেই। কেউ কেউ হালদার উজানে স্লুইচ গেট এবং রাবাব ড্যাম নির্মাণের ফলে ক্রমে হালদা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন।
অবশ্য হালদা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন আর জো’র প্রয়োজন নেই। বৃষ্টি হলেই মাছ ডিম ছাড়বে। হালদা নদীতে প্রচুর মাছের আনাগোনা চলছে এবং বৃষ্টির অপেক্ষা করছে বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, হালদা নদী থেকে গত বছর ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। অধিদপ্তরে সংরক্ষিত তথ্যের বরাত দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ৬১৬ জন ডিম সংগ্রহকারী এই ডিম সংগ্রহ করেছিলেন। যা বিগত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। গত বছর ২২ মে ছাড়া ওই ডিম সংগ্রহ করে কোটি কোটি পোনা উৎপাদন এবং বিক্রি করা হয়েছে। হালদা নদী জুড়ে পরিচালিত নানা ধরনের কার্যক্রমের ফলে ডিম আহরণের পরিমাণও বেড়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মা মাছ শিকার, অবৈধ নৌযান চলাচল এবং বালি উত্তোলন বন্ধ করার সুফল মিলেছিল গত বছর। এবারও রেকর্ড পরিমাণ ডিম পাওয়ার আশায় হালদা পাড়ে সংগ্রহকারীরা অপেক্ষা করছেন। কিন্তু বৈশাখ মাস পুরোপুরি চলে গেলেও মাছ ডিম না ছাড়ায় তাদের মাঝে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। হালদা পাড়ে মাছের ডিম ছাড়ার অপেক্ষায় থাকা ডিম সংগ্রহকারী মোহাম্মদ জামশেদুল আলম গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা অপেক্ষা করছি। গত ১০ থেকে ১৪ মে একটি জো ছিল। আমরা বেশ আশাবাদী ছিলাম। গত বছরের চেয়ে এবার বেশি ডিম সংগ্রহ করতে পারব- এমন একটি আশা ছিল আমাদের। কিন্তু মাছ ডিম ছাড়েনি। আমরা হতাশ হয়েছি। তিনি ইতোমধ্যে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছেন বলেও জানান। তিনি বলেন, ২৪ থেকে ২৮ মে একটি জো আছে। আশা করছি ওই জো’তে মাছ ডিম ছাড়বে। মোহাম্মদ জামশেদ বলেন, হালদা নদীর গড়দুয়ারা, কান্তার আলী চৌধুরী ঘাট, সাত্তার ঘাট, অংকুরী ঘোনা, মদুনাঘাট, নাপিতের ঘোনা ও মাদার্শাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে শত শত ডিম সংগ্রহকারী নৌকাসহ লোকবল নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
হালদা গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেন, একটি জো মিস হয়েছে, তবে উদ্বেগের কিছু নেই। ডিম ছাড়ার সময় পার হয়ে যায়নি। তিনি বলেন, গত বছর রেকর্ড পরিমাণ ডিম সংগ্রহ হয়েছিল। এবারও ভালো পরিমাণ ডিম সংগ্রহ হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, বৃষ্টি না হওয়ায় মাছ ডিম ছাড়তে পারছে না। বৃষ্টি হলেই মাছ ডিম ছাড়বে। তিনি বলেন, ঈদের দিন যেই বৃষ্টি চট্টগ্রাম শহরে হয়েছে সেই বৃষ্টি ফটিকছড়ি বা মানিকছড়ির দিকে হলেই মাছ ডিম ছাড়তো। নদীতে মা মাছের স্বাভাবিক আনাগোনা চলছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন আর জো’র প্রয়োজন হবে না। বৃষ্টি হলেই মাছ ডিম ছাড়বে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
চট্টগ্রাম আবহাওয়া ও ভূ-প্রাকৃতিক কেন্দ্রের উপ-পরিচালক সৈয়দ আবুল হাসানাৎ গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, আরব সাগরে সৃষ্ট একটি ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব বিরাজ করছে আবহাওয়াতে। এটা চলে যাওয়ার পর বঙ্গোপসাগরে ঝড় সৃষ্টি হতে পারে। এটা হলেই এই অঞ্চলে বৃষ্টি হবে। তিনি আগামী ২৪/২৫ মে’র আগে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের তেমন সম্ভাবনা নেই বলেও উল্লেখ করেন।
হালদা বিশেষজ্ঞ এবং মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বৃষ্টির অভাবে মা মাছ ডিম ছাড়ছে না বলে মন্তব্য করলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, হালদার উজানে অসংখ্য বাঁধ দেয়া হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে স্লুইচ গেট ও রাবার ড্যাম। এর ফলে হালদার স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। যার প্রভাব পড়েছে হালদার স্বাভাবিক চরিত্রে। এতে করে মাছ ডিম ছাড়ছে না বলেও তারা মন্তব্য করেন।
হালদা পাড়ের বাসিন্দা এবং ওয়াসার বোর্ড সদস্য সাংবাদিক মহসীন কাজী গতকাল বলেছেন, রাবার ড্যাম এবং স্লুইচ গেটের কারণে হালদা মরে যাচ্ছে। হালদার প্রাণ বাঁচিয়ে রেখেছে এখন কর্ণফুলীর জোয়ারের পানি। তিনি হালদার স্বাভাবিক চরিত্র নষ্ট করে দেয়ার মাধ্যমে হালদাকে মেরে ফেলা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, হালদা নদী থেকে ২০১৯ সালে ৭ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে ২২ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৭ সালে এক হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে মাছ পুরোমাত্রায় ডিম ছাড়েনি। মাত্র ৭৩৫ কেজি নমুনা ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি, ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি, ২০১৩ সালে ৬২৪ কেজি এবং ২০১২ সালে এক হাজার ৬০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। নদী দূষণ রোধসহ বিভিন্নমুখী পদক্ষেপে গত বছর রেকর্ড পরিমান ডিম সংগ্রহ হয়েছিল বলে উল্লেখ করে মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এবারও হালদা নদী নিয়ে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন এবং জেলা মৎস্য অধিদপ্তর প্রচুর কাজ করেছে। এর সুফল মিলবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্বিদ্যিালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী বলেন, প্রাকৃতিক অনুকূল পরিবেশ না হলে মা মাছ ডিম ছাড়ে না। পূর্ণিমা অমাবস্যার তিথিতে পর্যাপ্ত বৃষ্টির ফলে নদীতে ঢল নেমে স্রোত বাড়লে, পানির তাপমাত্রা কমলে (২৭-২৯ ডি: সে) প্রচুর পরিমাণ ডিম ছাড়ে। এবার এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়নি। তাই ডিম ছাড়েনি। তিনি বলেন, এবারো পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে ঢল নামবে। তখন ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা আছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে আগামী ২২ থেকে ২৯ মে এর মধ্যে ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা আছে। ওই সময়েও বৃষ্টি না হলে জুন মাসের ৭ থেকে ১৪ তারিখের ভেতর বা ২১ থেকে ২৮ তারিখের মধ্যে ডিম ছাড়ার একটা চান্স আছে। যদি এর মধ্যে না ছাড়ে তাহলে এ বছর আর ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা নাই। তিনি বলেন, ২০০৪ সালেও বিলম্বে ডিম ছেড়েছিল। ওই বছর এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়নি। পরে ১৭ জুন থেকে বৃষ্টি হয়। ২০ জুন মা মাছ ডিম ছাড়ে। এবারও তাই এখন পর্যন্ত ডিম ছাড়েনি বলে উদ্বেগের কিছু নাই।
এ গবেষক বলেন, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হলে উজানের পানি এসে হালদা নদীতে ঢল নামে। এতে তীব্র স্রোত সৃষ্টি হয়। এর ফলে পানির তাপমাত্রা ২৭-২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে ১৪-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকলে ডিমে তা দেয়ার উপযুক্ত হয়। ওই সময় প্রবল স্রোতের কারণে পানি ঘূর্ণনের ফলে ডিম পরিপক্ব হয়ে ফোটে এবং পোনার জন্য অঙিজেন প্রাপ্তি বাড়ে। এ রকম প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি হলে অর্থাৎ দুই-তিন দিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি হলে হালদা নদীতে প্রবল স্রোতসহ অন্যান্য ভৌত-রাসায়নিক ফ্যাক্টরগুলো সৃষ্টি হলে ডিম দেয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।