হালদার আশি ভাগ দূষণ কমবে যেভাবে

নগরীর বর্জ্যে বিপদ

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২০ জুন, ২০২১ at ১০:২৮ পূর্বাহ্ণ

প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে। মা মাছ ও ডলফিন রক্ষায় নদীর পাড়ে স্থাপন করা হয়েছে সিসিটিভি। তবুও মাছে, ফসলে কিংবা বাণিজ্যে চট্টগ্রামের গর্ব হালদা নদী ক্রমে ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে। একশ বছর ধরে নানা অত্যাচার সয়ে টিকে আছে হালদা। বহু বছর ধরে চট্টগ্রামের মৎস্যক্ষেত্রে অবদান রাখা নদীটি তার বৈশিষ্ট্য হারাতে শুরু করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যথাযথ পদক্ষেপ নিলে এই নদী চট্টগ্রামের সম্পদে পরিণত হবে। নগরীর একটি খাল উন্‌্মুক্ত করে দিলেই হালদার বিদ্যমান দূষণের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কমে যাবে।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলেন, কিছু বৈশিষ্টের কারণে হালদা নদী বাংলাদেশের অদ্বিতীয় নদী। এটি রুই জাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিগনি) দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র। এখান থেকে সরাসরি মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। যুগ যুগ ধরে স্থানীয় অধিবাসীরা মাছের ডিম সংগ্রহ করে নিজস্ব পদ্ধতিতে রেণু উৎপাদন করে দেশের মৎস্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। কিন্তু নানামুখী দূষণ এবং কৃত্রিম নানা আয়োজনে হালদায় মা মাছের স্বাভাবিক চলাচল এবং ডিম ছাড়ার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হুমকির মুখে পড়ছে। অবশ্য এক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকেও দায়ী করা হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, রামগড়ের পাতাছড়া ইউনিয়ন থেকে শুরু হওয়া হালদা নদী নানা বাঁক পেরিয়ে ১২৫ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কর্ণফুলী নদীতে এসে মিশেছে। এই দীর্ঘ পথে উভয় পাড়ে ফসলে, ফলনে হালদার ভূমিকা ছিল অনন্য। হালদা শুধু মাছই নয়, ফলনেও পুরো জনপদকে সমৃদ্ধ করেছিল। কিন্তু বিগত একশ বছরে হালদার এগারটি বাঁক কেটে সোজা করা হয়েছে। নৌ চলাচলের সুবিধার জন্য এটা করা হলেও হালদা প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের সর্বনাশ করা হয়েছে। ১১টি বাঁক কেটে হালদার দৈর্ঘ কমানো হয়েছে ২৫ কিলোমিটার। বর্তমানে হালদা নদীর দৈর্ঘ ৯৮ কিলোমিটার। বাঁকগুলো সোজা করার কারণেই মূলত হালদার প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের ক্ষেত্রগুলোর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেছে। বর্তমানে নাপিতের ঘোনা, হরেকৃঞ্চ মহাজন টেক ও কেরামতলীর বাঁকের অস্তিত্ব রয়েছে; যেখানে মা মাছ ডিম ছাড়ে। বাঁক সোজা করা না হলে হালদায় মা মাছের আনাগোনা এবং ডিম ছাড়ার পরিমাণ আরো বেশি থাকত। শুধু মৎস্য প্রজনন নয়, হালদার বাণিজ্যিক গুরুত্বও কমে গেছে। এক সময় চাক্তাই থেকে বড় বড় নৌকা বোঝাই করে পণ্য সামগ্রী ফটিকছড়ির নারায়ণহাট পর্যন্ত চলাচল করত। নাজিরহাট, ফটিকছড়িসহ উত্তর চট্টগ্রামের বিস্তৃত এলাকার প্রয়োজনীয় নানা পণ্য চাক্তাই থেকে নৌকাযোগে হালদা হয়ে গন্তব্যে যেত। নাজিরহাট ব্রিজের নিচে বিশাল বিশাল নৌকা ও ট্রলারের বহর অপেক্ষা করত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। একই সাথে হারিয়েছে নৌ-বাণিজ্যের রুটও। বর্তমানে চাক্তাই থেকে মেখল বা ছিপাতলী পর্যন্ত নৌকা চলাচলের সুযোগ রয়েছে। এর উপরে আর নৌকা যাতায়াত করতে পারে না।
হালদা নদীর প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে বাঁক কেটে দেওয়া, নির্বিচারে মা মাছ নিধন, হালদার দুই পাড়ে তামাক চাষ, একটি কাগজ কল ও একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষণ এবং নগরীর ময়লা-আবর্জনার প্রবাহ অন্যতম। এর মধ্যে সরকারি নানা উদ্যোগে বেশ কিছু সংকটের সমাধান হয়েছে। বিশেষ করে মানিকছড়িতে এখন আর তামাক চাষ হয় না। দেড়শ তামাক চাষির সকলকে পুনর্বাসনের মাধ্যমে মূল চাষাবাদে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এখন হালদাপাড়ে মাছের জন্য ক্ষতিকর কোনো বিষাক্ত চাষাবাদ নেই। হালদা থেকে মা মাছ নিধনও প্রায় শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও অনেক বেশি সচেতন। সকলের সম্মিলিত নজরদারিতে হালদা এখন অনেক বেশি নিরাপদ। হালদা পাড়ের যে দুটি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে দূষণের জন্য দায়ী করা হয়েছিল সেগুলো বন্ধ রয়েছে। এতে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য আর নদী দূষণ করছে না।
তবে নতুন আপদ হিসেবে নগরীর বর্জ্যই এখন হালদা দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে। নগরীর বর্জ্য সরাসরি গিয়ে হালদা নদী দূষণ করছে। বিশেষ করে বামনশাহী খাল হয়ে বিপুল পরিমাণ ময়লা-আবর্জনা আগে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ত। এখন তা হালদায় গিয়ে পড়ছে। অনন্যা আবাসিক এলাকার সন্নিকটে একটি বাঁধ কেটে বামনশাহী খাল উন্মুক্ত করে দিলে হালদায় শহরের ময়লা যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। এতে হালদা নদী দূষণের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কমে যাবে বলে জানান হালদা বিশেষজ্ঞ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা নদী গবেষণা ল্যাবরেটরির সমন্বয় এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুুরুল কিবরিয়া। তিনি বলেন, বামনশাহী খাল থেকে হালদাকে রক্ষা করা গেলে এর দূষণ একেবারে কমে যাবে। নদী ফিরে পাবে স্বাভাবিকতা। এতে হালদার হারিয়ে যাওয়া বৈশিষ্ট্যগুলো ফিরে আসতে শুরু করবে। তিনি বলেন, দূষিত হয়ে যাওয়া নদীকে সুস্থ করে তোলার বৈশ্বিক উদাহরণ হিসেবে ইংল্যান্ডের টেমসের নাম বলা হয়। বামনশাহী খালের ময়লা-আবর্জনা বন্ধ হলে আমরা টেমসের পরিবর্তে হালদার নাম বলতে পারব।
হালদা নদী দূষণমুক্ত করার ক্ষেত্রে সরকারি নানা উদ্যোগের প্রশংসা করে তিনি বলেন, আমরা বহু সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। হালদা নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে, হচ্ছে। এখন দূষণ সংকটের উত্তরণ ঘটাতে পারলে হালদা চট্টগ্রামের বড় সম্পদে পরিণত হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাবার আলোয় আলোকিত
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬