আর ক’দিন পর নতুন বছর শুরু হচ্ছে। নতুন বছরে শুরু হয় নতুন একটি খাতা খোলা, হিসাব-নিকাশ হালনাগাদ করার মাধ্যমে। দোকানগুলোতে আগের মতো এ চিত্রের দেখা মেলে না বেশ ক’বছর ধরে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে হাতে লেখা কমে যাচ্ছে। প্রযুক্তির সাথে সাথে গত বছর থেকে শুরু হওয়া করোনার প্রভাবে হালখাতার চিরচেনা লাল রং ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে।
১০ থেকে ১৫ বছর আগেও আড়ত ও দোকানগুলোতে হালখাতার জাঁকজমক অনুষ্ঠান দেখা যেত। এখন তা আর নেই। আগে ব্যবসায়ীরা মুখের কথায় বিশ্বাস করে লাখ লাখ টাকা বাকি দিতেন। তার বেশিরভাগ উসুল হতো হালখাতার দিনে। এখন বেশিরভাগ ব্যবসায়ী লেনদেন সারেন ব্যাংকের মাধ্যমে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পাল্টে গেছে আয়োজনের ধরন। সেই দিন আর নেই, নেই সেই হালখাতা উৎসবও। অথচ সর্বজনীন উৎসব হিসেবে ‘হালখাতা’ ছিল বাংলা নববর্ষের প্রাণ। গত বছরের মতো এ বছরও নববর্ষের আগে করোনার সংক্রমণে ঊর্ধ্বগতি। নববর্ষের দিন থেকে সর্বাত্মক লকডাউনের চিন্তা আছে সরকারের। তাই হালখাতার বিকিকিনিতেও বেহাল অবস্থা। দেশের সবচেয়ে বড়ো ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ এবং স্বর্ণ ও ওষুধের বাজারখ্যাত হাজারি গলিকে ঘিরে জমজমাট থাকত হালখাতার চিরচেনা কিছু বাইন্ডিং হাউস। রং ফ্যাকাসে হতে শুরু করলেও এ বছরও কিছু হালখাতা তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ক্রেতার দেখা নেই।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারোটি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। এরপর মুঘল সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। একই সাথে শুরু হয় বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। মোগল আমল থেকেই পয়লা বৈশাখে অনুষ্ঠান করা হতো। প্রজারা চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করতেন। পয়লা বৈশাখে জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করানোর পাশাপাশি আনন্দ উৎসব করতেন। এছাড়া ব্যবসায়ী ও দোকানদার পহেলা বৈশাখে হালখাতা করতেন।
তবে ডিজিটালের ভিড়ে বাঙালির ঐতিহ্য হালখাতা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যের হালখাতা উৎসব অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং তথা তথ্য প্রযুক্তির পৃথিবীর কাছে টিকতে পারছে না।
নগরীর হাজারী গলি, চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জে এ আয়োজন এখনো কিছুটা আছে। ব্যবসায়ীরা জানান, অধিকাংশ নতুন খাতা শুরু করেন নিজ নিজ সৃষ্টিকর্তার নামে। হিন্দুরা পয়সায় সিঁদুর মেখে নতুন খাতায় ছাপ দিয়ে থাকেন। এরপর শুরু করেন নতুন বছরের লেনদেনের হিসাব। হালখাতা শুধু হিসাবের নতুন খাতা খোলার বিষয় নয়, পাওনা আদায়ের পাশাপাশি ক্রেতাদের আপ্যায়নের বিষয়টিও জড়িয়ে আছে।
খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, চিরচেনা হাতে লেখা খাতার ব্যবহার বেশি একটা দেখা যায়নি। দোকানে কম্পিউটার বা মোবাইলের মাধ্যমে পণ্য বেচাকেনার হিসাব রাখা হচ্ছে। ফলে ক্যাশিয়ারের পাশে থাকা চিরচেনা লাল কাগজে মোড়ানো হিসাবের হালখাতার বইটি চোখে পড়েনি। এছাড়া হালখাতা অনুষ্ঠানের আগ্রহ নেই নতুন প্রজন্মের ব্যবসায়ীদের কাছে। তাই বাংলা বছর শেষে, দোকানে দোকানে যে হালখাতার অনুষ্ঠান হতো তাও আজ হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রবীণ স্বর্ণ ব্যবসায়ী মিসির আলী বলেন, আগে হালখাতা উৎসবে অন্যরকম একটা আনন্দ ছিল। যার যার সাধ্য মতো কার্ড ছাপানো হতো আর কার্ডে লেখা থাকত ‘এলাহী ভরসা’। হিন্দুরা লিখত ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধিদাতা গণেশায় নমঃ’ ও ‘শুভ হালখাতা’। ব্যাপক পরিসরে উৎসব আনন্দে হালখাতা পালন করা হতো। কিন্তু বর্তমানে চাকরিজীবী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীরা প্রায় সবাই ইংরেজি মাসের ওপর ভিত্তি করে আয়-ব্যয় করেন। নগদ বিক্রি অথবা বাকি লেনদেন সবই হয় ইংরেজি মাসের ওপর ভিত্তি করে। তাই ধীরে ধীরে পহেলা বৈশাখে হালখাতা প্রথা হারিয়ে যাচ্ছে।