দৈনিক সংবাদপত্রে ক্রীড়া জগৎ নিয়ে প্রতিদিন খবর ছাপা হয়। এখানে থাকে বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় হার জিতের খবর। কোন ব্যক্তি, ক্লাব কিংবা দেশ জিতে আবার কেউ হারে। তবে কোন ব্যক্তি বিশেষের যুগপৎ হার জিতের খবর স্বাভাবিক নয়। ঠিক এমনই এক খবর প্রকাশিত হয় গত ৮ জানুয়ারী দৈনিক আজাদী সহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে। দৌড়বিদ টুকু জামিল ম্যারাথন দৌড় জেতেন কিন্তু হেরে গেলেন জীবনের ম্যারাথনে। দীর্ঘ ২১ কিলোমিটার ম্যারাথন দৌড় শেষ করে ফিনিস লাইনে এসে ‘ভি’ চিহ্ন উঠিয়ে বিজয়ের আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন পটুয়াখালীর দৌড়বিদ টুকু জামিল। কিন্তু এই বিজয়ের আনন্দ মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায় তার হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণে। মর্মান্তিক এই ঘটনা ঘটে ০৭ জানুয়ারী শুক্রবার চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে। ৪০ বছর বয়সী টুকু জামিল এখানে আয়োজিত হাফ ম্যারাথন প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে পুরো পথ পাড়ি দিয়েছিলেন পূর্ণদমে। একুশ কিলোমিটার অতিক্রম করে বিজয়ের হাসি হাসছিলেন । কিন্তু মুহুর্তেই তিনি লুঠিয়ে পড়েন মাঠিতে। হার্ট অ্যাটাকের তীব্র ব্যথায় কাতরাতে থাকেন । সেখানে উপস্থিত সকলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ম্যারাথন আয়োজকদের আনন্দ বেদনায় পথবর্সিত হয়। টুকু ম্যারাথন জেতেন কিন্তু হেরে যান হৃদরোগের কাছে। হৃদরোগের বিভিন্ন ঝুকিপূর্ণ উপাদান ও হৃদরোগের উপসর্গ এতদিন হয়ত তার মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় ছিল। ম্যরাথন দৌড়ে তা প্রকট হয়। যা হার্ট অ্যাট্যাক পর্যন্ত পড়ায় এবং মৃত্যুর কারণ হিসাবে দেখা দেন। অলিম্পিক ম্যারাথনে হার্ট অ্যাটাক জনিত কারণে ট্রাকে মৃত্যুবরণকারী অ্যাথলেটদের তালিকা দীর্ঘ এক সমীক্ষায় প্রকাশ অলিম্পিকে প্রতি এক লক্ষ অংশগ্রহণকারীদের ০.৬ থেকে ১.৯ জন হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করে। ম্যারাথনের মতো দীর্ঘ দূরত্বেও দৌড় প্রতিযোগিতা ছাড়াও অন্যান্য প্রতিযোগীতামূলক খেলায় অংশগ্রহণকারীদের কেউ কেউ হার্ট অ্যাটাকে হঠাৎ মৃত্যুবরণ করে। এবার শীত মৌসুমের শুরুতেই চট্টগ্রাম অঞ্চলে কর্মরত জনৈক পুলিশ কর্মকর্তার বেডমিন্টন খেলার সময় হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুও খরব প্রকাশিত হয়েছিল। বিগত ইউরো কাপে ডেনমার্কের মিডফিল্ডার এরিকসন ইংল্যান্ডের রিরুদ্ধে খেলার সময় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে মাঠে লুটিয়ে পড়েন। পরবর্তীতে কোপেনহেগেন হাসপাতালে অস্ত্রপচারের মাধ্যমে তিনি সেরে ওঠেন। এভাবে দেখা যায় বিভিন্ন খেলাধুলা ও অ্যাথলেটিকস এর সাথে হার্ট ডিজিস এর যোগসুত্র স্পষ্ট। তা বিশ্বজুড়ে ‘অ্যাথল্েটস হার্ট’ নামে বহুল পরিচিত। তীব্র মাত্রার প্রতিযোগিতামূলক ব্যায়াম যেমন ম্যারাথন দৌড়, নৌকা বাইচ, সাইকেলিং, ফুটবল, বেস বল ইত্যাদির ক্ষেত্রে তা এক ধরনের অভিযোজন প্রক্রিয়া। এতে হৃদস্পন্দন মন্তর হয়, হৃদপিন্ডের আকার বড় হয় এবং তার রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় যা ব্যায়াম চলাকালীন বাড়তি রক্ত সরবরাহের চাহিদা মেঠায়। এই প্রকিৃয়ায় হৃদপিন্ড অধিকতর সহনশীল হয় এবং এতে ব্যায়ামের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। দৈনিক এক ঘন্টার অধিক ব্যায়াম চালিয়ে যাওয়া সব ক্রীড়াবিদের ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন ঘটে। শরীরবৃজ্বীয় এই পরিবর্তন তিন মাস ব্যায়ামের বাইরে থাকলে চলে যায়। তার কোন চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না। তবে তা কখনও কখনও হৃদরোগের উপসর্গকে আড়াল করে বয়স্ক ক্রীড়াবিদদের ক্ষেত্রে তা অপ্রত্যাশিত হার্ট অ্যাটাক ও হঠাৎ মৃত্যুর কারণ হিসাবে দেখা দিতে পারে। এই অবস্থায় ব্যায়াম হিতে বিপরীত হিসাবে দেখা দেয়। এ কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে ব্যায়ামে হৃদপিন্ডের উপকার ও হৃদরোগের ঝুঁকি নিয়ে বিতর্কের শুরু। লন্ডনের তৎকালীন সার্জন এফসি স্কাই অক্সফোর্ড কেমব্রিজের নৌ প্রতিযোগিতাকে মানুষের প্রতি নিষ্ঠুরতা হিসাবে আখ্যায়িত করেন এবং মতামত ব্যক্ত করেন যে এ ধনের তীব্র মাত্রার প্রতিযোগিতামূলক ব্যায়াম হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাক ঘটাতে পারে। তার এই ভবিষ্যত বানী পরবর্তীতে বাস্তবে রূপ নেয়। বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় এমনকি ফুটবল প্রতিযোগীতায় হার্ট অ্যাটাক ও হঠাৎ মৃত্যুর ঘটনা তার সন্দেহ প্রমাণ করেছে। একই কারণে সেই সময়কার সাতবার বোষ্টন ম্যারাথন চ্যাম্পিয়ন ক্লারেন্ড ডিমার পাঁচ বছরের জন্য নিজেকে ম্যারাথন থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। ডিমারের চিকিৎসক তাকে সতর্ক করেন যে তিনি হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিতে রয়েছেন। দৌড়বিদ ডিমার তখন তার ফর্মের শীর্যে অবস্থান করছিলেন।
ক্রীড়া ও ব্যায়ামে হার্ট অ্যাটাক কিভাবে?
এটা আজ প্রতিষ্ঠিত যে শারীরিক কর্মসাধন, খেলাধুলা ও ব্যায়াম হৃদরোগ তথা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়। অলস জীবন যাত্রা হৃদরোগের স্বতন্ত্র ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান। এক্ষেত্রে এই ঝুকি কর্মমুখর ও ব্যায়ামে অভ্যস্তদের তুলনায় শতকরা ৪০ ভাগের বেশী। সামগ্রীকভাবে অলস জীবন যাত্রা ধূমপানের অভ্যাসের মতোই প্রাণঘাতি। কারণ বিশ্বজুড়ে অলস মানুষর সংখ্যা ধূমপায়ীদের চেয়ে বেশী।
হৃৎপিণ্ডের সরাসরি উপকার ছাড়াও ব্যায়ামে রক্তচাপ কমে রক্তের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ে এবং গ্লুকোজের মাত্রা কমে, রক্তের ক্ষতিকারক কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে এবং উপকারী কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে। ব্যায়ামে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রিত থাকে এবং শরীরের সামগ্রীক ফিট্নেস বজায় থাকে। হৃদরোগ প্রতিরোধ ছাড়াও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত ব্যক্তির পূণর্বাসনে ব্যায়াম গুরুত্বপূর্ণ। এতে হাসপাতালে পুন ভর্তির প্রয়োজন কমে আসে। সমীক্ষায় দেখা গেছে ব্যায়ামে অভ্যস্ত ব্যক্তিদের গড় আয়ু অন্যান্যদের তুলনায় ৪-৭ বছর বেশী। তাই ব্যায়ামকে সুস্থ হৃদপিণ্ডের চাবিকাঠি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশন ও আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি এর সুপারিশ মতে একজন বয়স্ক ব্যক্তি প্রতি সপ্তাহে ১৫০ মিনিট মাঝারি মানের ব্যায়াম ( যেমন তাড়াতাড়ি হাটা) কিংবা ৭৫ মিনিট তীব্র মানের ব্যায়াম (যেমন জগিং) করবে। ব্যায়ামের উপকারিতা এমনই যে, কিছু ব্যায়ামও একেবারে ব্যায়াম না করার চেয়ে উপকারী। শারীরিক কর্মসাধন ও ব্যায়াম বাড়ায় সাথে হৃৎরোগের ঝুঁকিও কমে আসে আনুপাতিক হারে। তবে সপ্তাহে সর্বোচ্চ নয় ঘন্টার মাঝারি মানের ব্যায়াম পর্যন্ত এই সুফল পাওয়া যায়। এই সীমা অতিক্রম করলে তা বাড়তি কোন সুফল দেখায় না। বরঞ্চ তা হতে পারে বিপদের কারণ। ম্যারাথনের মতো তীব্র মাত্রার প্রতিযোগিতামূলক ব্যায়াম ( যেখানে ৬ এর অধিক মেট্স খরচ হয়) কারো কারো ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক ও হঠাৎ মৃত্যুর আশংকা বৃদ্ধি করে। এই ঝুঁকি বয়োবৃদ্ধির সাথে বাড়তে থাকে। প্রায় ক্ষেত্রে তা ইস্কোমিয়া জনিত হৃদরোগের কারণে ঘটে। এক্ষেত্রে আক্রান্ত ক্রীড়াবিদদের হৃৎপিন্ডের রক্তনালীতে আগে থেকেই ব্লক থেকে থাকে তাদের ‘অ্যাথলেট হার্ট’ তাদেরকে সহিঞ্চু করে তোলাতে তারা একদিন ইস্কোমিয়াজনিত বুক ব্যথা কিংবা অন্য কোন উপসর্গ অনুভব করেনি। তীব্রমানের প্রতিযোগিতামূলক এই পরিস্থিতি হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ বৃদ্ধি করলে দেখা দেয় বিপত্তি। পাশাপাশি তীব্র ব্যয়াম জনিত করোনারী রক্তনালীর সংকোচন ও চাপ ব্লকের স্থানে রক্তজমাট বাঁধা তরান্বিত করে। এভাবেই ঘটে যায় হার্ট অ্যাটাকের মতো প্রাণঘাতি ঘটনা এবং দেখা দেয় তীব্র বুক ব্যথা ও শ্বাসকষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তি হৃৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে এবং হঠাৎ মৃত্যু বরণ করে। তবে এই পরিস্থিতিতে সিপিআর এর মাধ্যমে বুকে ম্যাসাজ ও মুখে মুখে কৃত্রিম শ্বাস দিতে পারলে এই মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। এভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাচিঁয়ে তোলে নিকটস্থ সিসিইউতে উন্নত জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসার মাধ্যমে এই মৃত্যু থেকে রক্ষা করা যায়।
করণীয়ঃ
< ম্যরাথন সহ যে সকল তীব্র মাত্রার প্রতিযোগিতাপূর্ণ ক্রীড়ায় অংশ গ্রহনের পূর্বে চল্লিশ বছর বয়শোদ্ধ সকল প্রতিযোগীর চেকআপ আবশ্যক।
< ব্যায়াম চলাকালীল অস্বাভাবিক কিংবা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, শ্বাসরোধী বুকব্যথা দেখা দিলে কিংবা , হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়লে ব্যায়াম বন্ধ করে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ বাঞ্ছনীয়।
< খেলার মাঠে উপস্থি কর্তৃপক্ষীয় সকলকে হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ শনাক্ত করতে হবে। অংশগ্রহণকারী কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাৎক্ষনিক সিপিআর শুরু করতে হবে। ফাস্ট এইড বক্সের সাথে সিপিআর দেওয়ার সরঞ্জাম থাকা আবশ্যক। বিশ্বকাপ ফুটবলে এই ধরনের সিপিআর প্রদানকারী টিম রাখা বাধ্যমূলক করা হয়েছে। এই দৃষ্টান্ত সব ধরনের প্রতিযোগীতা মূূলক ক্রীড়ার ক্ষেত্রে পালন করে চলে আবশ্যক।
< হৃদরোগীদের যেকোন ব্যায়ামের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ আবশ্যক। কিছু কিছু হৃদরোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসক ব্যায়াম করা নিষেধ করেন যেমন, হার্ট ফেইলিউর উপসর্গ, ছন্দহীনতা, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ, ভাল্বের গুরতর রোগ, কার্ডিও মায়োপ্যাথি ইত্যাদি।
< ম্যারাথন সাইকেলিং ইত্যাদি তীব্র মাত্রার প্রতিযোগিতাপূর্ণ ক্রীড়া ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ সাপেক্ষে হার্টের সিটি করোনারী এনজিগ্রাফির মাধ্যমে উপসর্গহীন হৃদরোগ সনাক্ত করা সম্ভব। এক্ষেত্রে চিকিৎসক প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণকারীর ঝুঁকির ব্যাপারে সঠিক পরামর্শ দেন।
< প্রতিযোগীতার আগে সচরাচর উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সাময়িক বন্ধ রাখা হয়। অন্যথায় ব্যায়াম পরবর্তী নিম্ন রক্তচাপ ক্ষতিকারক হতে পারে। তবে বিটা ব্লকার শ্রেণীর ওষুধ (যা আগে থেকে চলছিল) গ্রহন অব্যাহত থাকবে। ম্যারাথন দৌড়ের ৫-৭ দিন আগ থেকে কোলেষ্টেরল কমানোর ওষধ (ষ্ট্যাটিন) বন্ধ রাখতে হবে। তবে অ্যসপিরিন, যা আগে থেকে চলছিল তা চলতে থাকবে।
< দীর্ঘস্থায়ী ব্যায়ামে রক্তের ট্রোপেনি এর মাত্রা বাড়ে। আবার হার্ট অ্যাটাক সনাক্ত করতে বহুল প্রচলিত রক্ত পরীক্ষা এই ট্রোপোনিন। তাই এক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক সনাক্তকরণে এই পরীক্ষা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। ইসিজি ও অন্যান্য লক্ষণ থেকে এ পরিস্থিতিতে হার্ট অ্যাট্যাক সনাক্ত করা হয়।
সুস্থ, সবল শরীর গঠনে ও আনন্দ উপভোগ জন্য ম্যারাথন সহ বিভিন্ন ক্রীড়ার আয়োজন। একটা সুস্থ হৃদযন্ত্র নিয়ে সবাই ব্যায়াম ও খেলায় অংশগ্রহণ করুক তারা হার্ট অ্যাটাকের ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত থেকে ক্রীড়াক্ষেত্রে সফলতা বয়ে আনুক- এই হোক সকলের প্রত্যাশা।
লেখক : হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল