রোহিঙ্গা বসতি, অপদখল ও সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে কক্সবাজারে গত কয়েক বছরে প্রায় ১৫ হাজার একর বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। এতে মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে এশিয়ান হাতির বাসস্থান, বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র। ধ্বংস হয়ে গেছে হাতি চলাচলের আন্তঃদেশীয় কয়েকটি করিডোরও। এর ফলে কক্সবাজারে হাতির সাথে মানুষের সংঘর্ষ হচ্ছে। আর এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে উখিয়া, টেকনাফ ও রামুতে ধ্বংস হওয়া ৩ করিডোর পুনর্নির্মাণসহ হাতিরক্ষায় একটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সরকার।
বর্তমানে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা চলছে বলে জানান চট্টগ্রাম অঞ্চলের বনসংরক্ষক আবদুল আওয়াল সরকার। বনবিভাগের ২০১৭ সালের প্রতিবেদন মোতাবেক, কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও রামুর আংশিক এলাকায় সাম্প্রতিককালে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বনাঞ্চলে ৬৩টি এশিয়ান হাতির বাস রয়েছে। এসব এলাকায় আছে তিনটি হাতি চলাচলের বৃহৎ করিডোর। এই করিডোরগুলো হলো- ২.৩৬ কি.মি. দীর্ঘ ও ০.৬৭ কি.মি. প্রস্থ আয়তনের পানেরছড়া-তুলাবাগান করিডোর, ৪.৪২ কি.মি. দৈর্ঘ্য ও ১.০ কি.মি প্রস্থ আয়তনের রাজারকুল-নাইক্ষ্যংছড়ি করিডোর এবং ৪.৩৫ কি.মি. দৈর্ঘ্য এবং ১.১৩ কি.মি. উখিয়া-ঘুমধুম (কুতুপালং-নাইক্ষ্যংছড়ি-ঘুমধুম-তমব্রু-আজোয়া এলাকায় ব্যাপৃত) করিডোর। এই তিন করিডোর দিয়ে উখিয়া, টেকনাফ ও রামুর আংশিক এলাকায় বাস করা ৬৩টি এশিয়ান হাতি বান্দরবান ও মায়ানমারে চলাচল করতো। কিন্তু রামু ক্যান্টনমেন্ট স্থাপনের ফলে পানেরছড়া-তুলাবাগান করিডোর কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে ২০১৭ সালে অনুপ্রবেশ করা বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার বসতি স্থাপন করায় উখিয়া-ধুমধুম করিডোরটি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এতে এসব এলাকায় বাস করা এশিয়ান হাতিগুলোর চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে হাতিগুলো সংকুচিত স্থানে আটকা পড়ে। সৃষ্টি হয় চরম খাদ্য সংকট, প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র। যার ফলে কক্সবাজারে হাতির সাথে মানুষের সাংঘর্ষিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই কারণে ইতোমধ্যে হাতির আক্রমণে ১২জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজার ও কক্সবাজার সন্নিহিত পার্বত্য বনাঞ্চলে গত দুই বছরে একই সংখ্যক স্থানীয় লোক মারা যায়। আবার মানুষের আক্রমণে গত দুই বছরে অন্তত ১৫টি বন্যহাতি মারা গেছে বলে জানান স্থানীয় পরিবেশবাদীরা।
স্থানীয় পরিবেশবাদীদের মতে, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে প্রতিবছর মানুষের হাতে অপমৃত্যুর শিকার হচ্ছে অসংখ্য বন্য হাতি।
কক্সবাজারের পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) কক্সবাজার এর প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন দাবি করেন, গত ২ বছরে কক্সবাজার ও আশেপাশের বনাঞ্চলে বৈদ্যুতিক শক ও গুলি করে অন্তত ১৫টি বন্য হাতিকে হত্যা করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের বনসংরক্ষক আবদুল আওয়াল সরকার বলেন, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বনাঞ্চলের ‘ইকোসিস্টেমস পিলার’ বন্য হাতি এখন মহাবিপন্ন। সম্প্রতিককালে বনাঞ্চল কমে যাওয়া এবং খাদ্য সংকটে পড়ে লোকালয়ে হানা দেয়ার কারণে মানুষের সাথে সংঘাতে মহাবিপন্ন হয়ে পড়েছে এই প্রাণিটি। তিনি জানান, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজার্ভ ন্যাচারের মাধ্যমে সর্বশেষ জরিপে দেশে ২৬৮টি এশিয়ান হাতি পাওয়া গেছে। আর এই হাতিকে যেন হত্যা করা না হয় সেজন্য বনবিভাগের উদ্যোগে সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি উখিয়া, টেকনাফ ও রামুতে সাম্প্রতিককালে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ৩ করিডোর পুনর্নির্মাণসহ হাতিরক্ষায় একটি ‘বিশেষ’ প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সরকার। সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের সাথে সমন্বয় করে জরুরিভাবে গৃহীত এই বিশেষ প্রকল্পটির আওতায় তিনটি করিডোর পুনর্নির্মাণসহ হাতির বাসস্থান, বিচরণক্ষেত্র ও প্রজননক্ষেত্রের উন্নয়নের কাজ করা হচ্ছে।
পরিবেশবিদগণ বন্য হাতিকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বনাঞ্চলের ‘ইকোসিস্টেমস পিলার’ বা বাস্তুসংস্থানতন্ত্রের ‘খুঁটি’ বলে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু দিন দিন আবাসস্থল কমে যাওয়ার পাশাপাশি মানুষের হামলায় এখন মহাবিপন্ন আমাদের বৃহত্তম এই স্থলজ বন্য প্রাণীটি। বিজ্ঞানীদের আশংকা, আমাদের পরিবেশ থেকে এই ‘কি-স্টোন প্রজাতি’ (যেসব অঞ্চলে হাতির আবাস রয়েছে) হারিয়ে গেলে সেসাথে বিলুপ্ত হয়ে যাবে আরো বহু প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণি।