‘সাজনার’ দিকে রওনা দেব। ফ্রেশ হয়ে লিফট বেয়ে হোটেলের লবিতে এসে দেখি সেখানে ‘এলিনা’, মিষ্টি একটি মেয়ে, বয়স প্রায় সাড়ে তিন, হাতে একগোছা ফুল। সে ‘গোছা’ যে আমার জন্য নয় সে টের পাই। কেননা জেনেভায় প্রায় আসা হয়, অনেকটা ঢাকা-চাটগাঁ সফরের মত। কোনবারই মেয়েটি আসেনি। এবার আমার সফর-সংগী এলিনার দিদিমা, সুমনা। এগিয়ে এসে ফুলের তোড়া সে তাকেই দিলো। এলিনার বাবাকে বলি, ‘এতবার এলাম, কই তোমার মেয়ে তো কখনো আসেনি এক গোছা বাদ দাও, একটি ফুল নিয়েও আমার জন্যে আসেনি।’ এলিনার মা, রিমি সম্পর্কে আমার মামাতো বোন (বড় মামার মেয়ে) শিউলীর মেয়ে। বিয়ের পর সে সুইজারল্যান্ড চলে আসে। সুমনা এলিনাকে আদর করে লিফটের দিকে চলে যায়। কিছুক্ষন পর এলিনা নেমে এলো, হাতে একটি পুতুল। এলিনা এসেছিলো তার বাবা সসীম গৌরীচরণ ও অরুন জ্যোতি বড়ুয়ার সাথে। দুজনেই দীর্ঘদিন ধরে সুইজারল্যান্ডে আছে। অকৃতদার অরুন বড়ুয়ার কম করে হলেও বছর ত্রিশেক তো হবেই। সসীম ১৯ বছর ধরে। অকৃতদার অরুন বড়ুয়া পরের উপকার ও সমাজসেবা করে বেড়ান, প্রায় ক্ষেত্রে গাঁটের পয়সা খরচ করে, দেশে ও বিদেশে। নিকটজন, আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও পরের জন্যেও। তিনি বলেন, কেউ সাহায্য চাইলে আমি চুপ থাকতে পারিনা। সুইজারল্যান্ডে তাকে চেনে না এমন বাংলাদেশি বোধকরি পাওয়া যাবেনা। একনিষ্ঠ মানবাধিকার কর্মী, দেশে-বিদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জানমাল রক্ষার দাবিতে অত্যন্ত সোচ্চার। কখনো তাকে দেখা যায় জেনেভা জাতিসংঘ ভবনের সামনে যে ঐতিহাসিক ভাঙ্গা চেয়ার, তার নিচে একা ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদ করে চলেছেন। সাহসী বক্তব্য রাখেন নানা সময়, অনেকে যা বলতে নানা কারনে ভয় পান, তিনি তা নির্বিঘ্েন বলেন। কাউকে খুব একটা পরোয়া করেননা। মাস দুয়েক আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রী জেনেভা এলে তিনি (মন্ত্রী) স্থানীয় প্রবাসী বাংলাদেশিদের সাথে বাংলাদেশ দূতাবাসে মত বিনিময় করেন। সেখানে বেঁটে-খাটো অরুন জ্যোতি বড়ুয়া মন্ত্রীর সামনে সামপ্রতিক সময়ে দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়িন-নির্যাতনের বক্তব্য তুলে ধরে বর্তমান সমালোচনা করেন। তার বক্তব্য রাখার এক পর্যায়ে এক বাংলাদেশী তরুণ, তিনি (অরুন বড়ুয়া) দেশের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছেন বলে বাধা দিয়ে থামিয়ে দিতে চাইলে, খোদ পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওই তরুণকে কিছুটা ভর্ৎসনা করেন বলে অরুন বড়ুয়া জানান। জেনেভায় যে সমস্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আছে, যে সমস্ত মানবাধিকার নেতা-কর্মী আছেন, তাদের কারো কারো সাথে তার বেশ ভাব। অরুন বড়ুয়া আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এমনি এক চমৎকার সুইস মহিলার সাথে। নাম নিকোলা ফুরে, প্রকৃতির জন্যে যিনি ছিলেন নিবেদিত-প্রাণ। বছর কয়েক ক্যান্সারে ভুগে সপ্তাহ তিনেক আগে ৮৩ বছরের নিকোলা ফুরে মারা গেছেন। ক্যান্সার তাকে কাবু করতে পারেনি। মরণের আগ তক ছিলেন সক্রিয়। তার কথা সুইজারল্যান্ড সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এই পাতায় প্রথম সংখ্যায় বিস্তারিত লিখেছি। যাই হোক-
‘সাজনা’, আগেই লিখেছি বাংলাদেশী মালিকানায় ভারতীয় তান্দুরি রেস্তোরাঁ। আমাদের হোটেল থেকে মিনিট তিনেক হাঁটার দূরত্বে এই রেস্তোরাঁ। সেখানে পৌঁছুতেই মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে রেস্তোরার ‘মালকিন’ সাজিয়া ভাবি এগিয়ে এলেন। তখন পৌনে এক। দুপুর আড়াইটায় জেনেভা প্রেস ক্লাবে আমার নির্ধারিত এপয়েন্টমেন্ট, ক্লাবের কর্মকর্তা সুইস তরুণ, তবিয়াস ক্লাকের্র সাথে। তাগিদ দেই রেস্তোরাঁর মালিক খলিলুর রহমানকে। প্রেস ক্লাবে উনিও সাথে যাবেন। কেননা যে সম্মেলনের কারণে আমার জেনেভা আসা, তিনি তার অন্যতম উদ্যোক্তা। তিনি সুইজারল্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান। তিনিও সুইজারল্যান্ডের অন্যতম সক্রিয় ব্যক্তি- দেশের রাজনীতি ও মানবাধিকার নিয়ে। ব্যবসার পাশাপাশি কী করে যে তিনি এত সামাজিক কর্মকান্ড এবং রাজনীতি করেন ভাবতেই অবাক লাগে। ‘সাজনায়’ গেছি কিন্তু না খেয়ে ফিরেছি এমনটি কখন হয়েছে মনে নেই। লাঞ্চ-আওয়ারে গেলে লাঞ্চ, ডিনার-আওয়ারে গেলে ডিনার করতেই হবে। নিদেন পক্ষে সবজি, দেশি ডাল ও চিকেন দিয়ে ‘নান’ খেতেই হবে। তাই মাঝে মধ্যে বাইরে কোথায়ও খেয়ে সেদিকে যাই। আমাদের একদিকে প্রেস ক্লাবে যাবার তাড়া, অন্যদিকে খলিল ভাইয়ের আমাদের লাঞ্চ করানোর তাড়া- দুটোর সাথে কমেপ্রামাইজ করে তড়িঘড়ি করে খেয়ে রওনা দিলাম বাস স্টপজের দিকে। জেনেভা রেল স্টেশন লাগোয়া এই বাস স্টপেজ। হোটেল থেকে দেয়া ছিল শহরে ঘুরে বেড়ানোর টিকেট। ফলে আমাদের জন্য টিকেট কাটতে হয়নি। ভেতরে ভেতরে ভয় ছিল এই ভেবে ঠিক সময় মত পৌঁছুতে পারবো তো? কিন্তু লক্ষ্য করি খলিল ভাই নির্বিকার। তিনি বলেন, আমরা নির্দিষ্ট সময়মত পৌঁছে যাব। হল্যান্ডের মত সুইজারল্যান্ডেও যানবাহনে ‘মাস্ক’ পরা বাধ্যাতামূলক। সাথে ছিলেন অরুন বড়ুয়া। সেখানে পৌঁছে তার খেয়াল হলো তার কাছে মাস্ক নেই। দৌড়ে গেলেন পেছনে ফেলে আসা শপিং সেন্টারে। একটু বাদে ফিরে এলেন। ইতিমধ্যে বাসও চলে এলো। সুইজারল্যান্ডে কম করে হলেও ১৫-২০ বার আমার আসা হয়েছে। কোন সময় বাস-ট্রেনে চোখে পড়েনি টিকেট চেকারের। অন্যদিকে হল্যান্ডে প্রায়শ দেখা যায় এদের উপস্থিতি। ফলে জেনেছি এখানে অনেকেই বিনা-টিকেটে যাতায়ত করেন। এই কর্মটি জীবনে কখনো করা হয়নি, এখনো না। সে হিসাবে আমি একজন ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘ল এবাইডিং সিটিজেন’।
চমৎকার স্থানে জেনেভা প্রেস ক্লাব। চারিদিকে সবুজে-সবুজে ঢাকা। প্রথম যে-বার এসেছিলাম ঘুরে-ঘুরে দেখেছিলাম। মনে মনে ভাবি পিকনিক করার উপযুক্ত জায়গা। জাতিসংঘ ভবন থেকে খুব একটা দূরে নয়। ব্রাসেলসসে যে ইউরোপীয় প্রেস ক্লাব আছে, তার সদস্য বিধায় জেনেভা প্রেস ক্লাবের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার অধিকার আমার রয়েছে। সেই সূত্রে এই ক্লাবের সাথে পরিচয় ও সম্পর্ক মোটামুটি ভালো তা দাবি করতে পারি। খুব বেশিদিনের নয় এই ক্লাব। মাত্র ১৯৯৭ সালে এই ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হলেও ইতিমধ্যে এই ক্লাবে ৩০টি দেশের রাষ্ট্রীয় ও সরকার প্রধান এতে আসেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, কফি আনান, দালাই লামা, হেনরি কিসিংগার ও নোয়াম চমস্কি। বিগত ২৪ বছরে জেনেভা প্রেস ক্লাবে শতাধিক সংবাদ-সম্মেলন ছাড়াও মোট ১৮০০ অনুষ্ঠান হয়। তবে এর শারীরিক গঠন আরো সুন্দর হওয়া খুব দরকার ছিল। সুইজারল্যান্ড বলে কথা। যাই হোক, প্রেস ক্লাবের কাজ সেরে আমরা ফিরে চলি বাস স্ট্যান্ডের দিকে। মাঝে একদিন বাদে সম্মেলন, যে কারণে আমার আসা। আগেই বলেছি আমার সফর-সঙ্গীর লক্ষ্য ভিন্ন। সে বলে, আমি একটু এদিক-ওদিক, শপিংয়ে যাব। আমার হাতে অনেক কাজ। আরো তিনটি মিটিং আছে, বলা চলে জনসংযোগ জাতীয়। সম্মেলন প্রস্তুতির অনেক কাজ এখনো বাকি। এগিয়ে যাই হোটেলের দিকে। একটু বিশ্রাম নিয়ে যে আবার বেড়োতে হবে।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট