যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে গত ৩০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রথম টেলিভিশন বিতর্ককে দেশটির স্মরণকালের সবচাইতে ‘বাজে’ প্রেসিডেন্ট–বিতর্ক হিসাবে আখ্যায়িত করলো বৃটিশ পত্রিকা, ‘দি সান’। অন্যদিকে নিউজ উইক লিখেছে, ‘প্রেসিডেন্ট–বিতর্ক তিনটি ব্যর্থতার জন্ম দিয়েছে। প্রথম ব্যর্থতা– হোয়াইট সুপ্রিমেসি বা শেতাঙ্গ আধিপত্যবাদকে নিন্দা জানাতে ট্রাম্পের ব্যর্থতা, বিতর্কে উত্তেজনা তৈরিতে জো বাইডেনের ব্যর্থতা এবং সঞ্চালক ক্রিস ওয়ালসে এতটাই ব্যর্থ হয়েছিলেন যে, ওল্ফ ব্লিটজার (সিএনএন সাংবাদিক) আমেরিকার কাছে এই হতাশার জন্যে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন’। এবিসি ভাষ্যকারের মতে, ‘এটি ছিল যুক্তরাষ্টের গত ৪০ বছরের সব চাইতে বাজে প্রেসিডেন্ট–বিতর্ক’। হল্যান্ডের সময় ভোররাত তিনটা পাঁচ মিনিটে শুরু হয় ৯০ মিনিটের এই প্রথম বিতর্ক। ট্রাম্প–বাইডেনের লাইভ বিতর্ক দেখবো বলে সারারাত জেগে ছিলাম। বিতর্ক শেষে ভাষ্যকারদের মন্তব্য শুনে ভোর পাঁচটার দিকে বিছানায় গিয়ে ভাবছিলাম, এই নিম্ন–মানের বিতর্ক দেখার জন্যে এই রাত–জাগাটা সঠিক ছিল কিনা। নব্বই মিনিটের এই প্রথম প্রেসিডেন্ট বিতর্ক যে ৬–টি বিষয়কে ঘিরে তা হলো – প্রার্থীর রেকর্ড, সুপ্রিম কোর্ট, কোবিড –১৯, জাতি ও সহিংসতা এবং নির্বাচনের ইন্টিগ্রিটি বা অখণ্ডতা। কিন্তু বেশির ভাগ সময় দেখা গেল দুই প্রার্থীর মধ্যে মাইক্রোফোন নিয়ে কাড়াকাড়ি এবং একে অন্যকে লক্ষ্য করে ‘দয়া করে বাধা দেয়া বন্ধ করুন’ জাতীয় শব্দাবলী বেশি উচ্চারণ করতে। ফলে বিতর্কের যে সৌন্দর্য্য ও আকর্ষণ তা সম্পূর্ণভাবে ছিল অনুপস্থিত। বাংলাদেশে স্কুল–কলেজ ছাত্র–ছাত্রীদের যে বিতর্ক টেলিভিশনের পর্দায় দেখি সে তুলনায় ট্রাম্প–বাইডেন বিতর্ক ছিল একেবারে নিম্নমানের। অবশ্য তার পেছনে যার অবদান ছিল বেশি তিনি হলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বোধকরি এই সমস্ত কারণে রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা এই বলে মন্তব্য করেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই বিতর্কে তার আচরণের মধ্যে দিয়ে বিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের যেটুকু মান–সম্মান, ইমেজ ছিল তাও ধুলায় মিশিয়ে দিলেন’।
বিতর্কের শুরু থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন উত্তেজিত ও আক্রমণাত্মক। তিনি খুব দৃষ্টিকুটু ও অসৌজন্যমূলকভাবে তার প্রতিপক্ষ ডেমোক্রেটিক দলীয় প্রার্থী, জো বাইডেনকে বক্তব্য রাখার সময় বার বার বাধা দিচ্ছিলেন এবং তাকে (বাইডেন) থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। পুরো ৯০ মিনিটের প্রায় পুরো অংশ জুড়ে তিনি বলে গেছেন অনর্গল মিথ্যে কথা, যা সত্য নয় তেমন বিষয়ে কৃতিত্ব দাবি করেছেন। তার আচরণে বিরক্ত হয়ে বিতর্কের সঞ্চালক, ফঙ নিউজের সিনিয়র সাংবাদিক, ক্রিস ওয়ালেস ট্রাম্পকে অনেকবার সংযত হতে ও চুপ থাকতে বলতে বাধ্য হন। সঞ্চালক বার কয়েক প্রেসিডেন্টকে তার প্রতিপক্ষকে বক্তব্য রাখার জন্যে সুযোগ দিতে বলেন। কিন্তু নিলর্জ্জ ও বেহায়া ট্রাম্প সঞ্চালকের অনুরোধ উপেক্ষা করে বার বার মাইকের সামনে মুখ এনে বলতে থাকেন, ঠিক না, ফেইক নিউজ ইত্যাদি ইত্যাদি। বক্তব্য রাখার সময় বার বার ব্যাঘাত ঘটাতে থাকলে ত্যক্ত–বিরক্ত হয়ে মার্জিত ও ভদ্র হিসাবে পরিচিত জো বাইডেন ট্রাম্পকে এক পর্যায়ে ‘ক্লাউন’ হিসাবে আখ্যায়িত করেন। অবশ্য সাথে সাথে তিনি এই অশোভন শব্দ উচ্চারণের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেন। ট্রাম্পের ক্রমাগত মিথ্যে বলে চলায় বাইডেন ট্রাম্পকে ‘মিথ্যেবাদী’ হিসাবেও আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ট্রাম্প ‘আমেরিকার সব চাইতে জঘন্যতম প্রেসিডেন্ট‘। বিতর্কের কোন নিয়ম–নীতিমালা না মেলে ট্রাম্প জো বাইডেনের বক্তব্য রাখার সময় বাধা দিতে থাকলে তিনি ট্রাম্পের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘শাট আপ’। জো বাইডেনের ২২ বছরের নাতনী (দ্বিতীয় ছেলে হান্টার বাইডেনের মেয়ে) নাওমি বাইডেন টুইটারে লিখেন, ‘আমি যদি মঞ্চে উপস্থিত থাকতাম, তাহলে পাঁচ মিনিটের মাথায় ট্রাম্পের গালে চড় না মেরে থাকতে পারতাম না এবং আমি মনে করি এই ধরনের মনোভাব কেবল আমার নয়, অনেকের’। আসলেও তাই। অতলান্তিকের এ–পাড়ে বসে ট্রাম্পের অভদ্র আচরণ ও গোয়ার্তুমি দেখে আমার ভেতরে এই ধরনের মনোবাঞ্ছা বার কয়েক যে চাড়া দিয়ে উঠেনি তা নয়।
তবে বিতর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এমন আচরণে অবাক হইনি আমি, অবাক হননি অনেকেই যারা বিগত চার বছর ধরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাজ–কারবার, কথাবার্তা সম্পর্কের মোটামুটি ওয়াকেবহাল। মোদ্দা কথা নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ট্রাম্প তত রীয়া হয়ে উঠছেন। প্রাক–নির্বাচনী অনেকগুলি জরিপে তিনি বাইডেনের চাইতে অনেক পিছিয়ে আছেন। নির্বাচন যদি সঠিক হয়, জনগণ যদি ভোট দিতে সক্ষম হন, তাহলে জো বাইডেনকে যে তিনি কোনোভাবেই হারাতে পারবেন না, সে তিনি খুব ভালো করেই জানেন। আর সে কারণে তিনি শুরু থেকেই বিতর্কের মূল ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে জো বাইডেনকে ব্যক্তিগত ইস্যুতে নাজেহাল করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন, যদিও তাতে তিনি খুব একটা সফল হতে পারেননি। হয়তো পারতেন, যদি সঞ্চালক ট্রাম্পকে অনেকটা ধমকের সুরে বার কয়েক থামিয়ে না দিতেন। পাঠকের কেউ কেউ হয়তো অবাক হচ্ছেন এই ভেবে যে আমেরিকার মত গণতান্ত্রিক দেশে জনগণ নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন কিনা সেই শংকা প্রকাশ করছি বলে। হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রেও ভোটে কারচুপি হয়, কারচুপি হয় ভোট গণনায়। সে আমরা দেখেছি বুশ–গোরের নির্বাচনে, যা শেষতক সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। যাই হোক – পরাজয় নিশ্চিত জেনে ট্রাম্প অনেক আগ থেকেই এই নির্বাচনকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ করে তুলতে যাবতীয় অভিযোগ তুলছেন। ডাকযোগে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোট দিয়ে ডেমোক্র্যাট দল নির্বাচনে কারচুপি করতে চাইছে এবং তার জয়কে ছিনিয়ে নিতে চাইছে বলে ট্রাম্প দাবি করে চলেছেন অনেক আগ থেকে। তিনি দাবি করেন, বিভিন্ন রাজ্যে লক্ষ লক্ষ ব্যালট পাঠানো হচ্ছে, যার কারণে ব্যাপক হারে ভোট কারচুপি হবে এবং তা করছে ডেমোক্র্যাট দল। তিনি আসন্ন ৩ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ‘একটি জালিয়াতির নির্বাচন’ হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, ‘ভোট জাল না হলে তিনি তার বিজয় সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত’। সিএনএনের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংয়ের মতে, ২০২০ সালেও লক্ষ লক্ষ ব্যালট ভোট দেয়া হয়েছিল ডাকযোগে। এমন কী ২০২০ সালের প্রাইমারিতেও তাই ঘটেছে। কিন্তু ব্যাপক ভোট জালিয়াতির ঘটনা ঘটেনি। তিনি দাবি করেন, পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় ডাক বিভাগের কর্মীরা ব্যালট বিক্রি করছেন। কিন্তু সিএনএন–র তদন্তে এই ধরনের কোন ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই বলে জানানো হয়। পশ্চিম ভার্জিনিয়ার সেক্রেটারী অব স্টেটও এই তথ্য নিশ্চিত করেন। ট্রাম্পের অধীনস্থ রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা তার এই ধরনের দাবি সত্য নয় বলে উড়িয়ে দিলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প একই বিষয় বারবার উচ্চারণ করে চলেছেন এবং গতকালের বিতর্কে নতুন করে তা তুললেন। আমেরিকার ইতিহাসে যা কোনোদিন শোনা যায়নি এবং শুনিনি সেই ধরনের কথাবার্তাও এবার শোনা যাচ্ছে খোদ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখে। ট্রাম্প বিতর্কের এক পর্যায়ে তার লাঠিয়াল বাহিনী (প্রাউড বয়েস) সদস্যদের প্রস্তুত থাকার জন্যে আহবান জানান এবং বলেন, ‘আপনারা স্ট্যান্ড–বাই প্রস্তুত থাকুন’ এবং সাথে সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা উত্তরে লিখেন, ‘আমরা প্রস্তুত স্যার’। অনেকেই সন্দেহ করছেন, তার অন্ধ সমর্থক এই ‘আর্মড গর্বিত ছেলেরা’ ভোট কেন্দ্রে টহল দেবে। তাদের কাজ হবে বাইডেন সমর্থকদের, বিশেষ করে কালো–ভোটারদের ভয়–ভীতি প্রদর্শন করে ভোটদানে নিবৃত করা। এই ধরনের ঘটনা আমরা ঘটতে দেখি বাংলাদেশ, ভারত এবং অনুন্নত দেশে। জয় নিয়ে নিশ্চিত নন ট্রাম্প, তারপরও তার ক্ষমতা চাই, সে যে ভাবেই হোক না কেন। তাই তিনি বলেন, ‘আমি জিতবোই, পরাজিত তখনই হবো যদি ডেমোক্র্যাট পার্টি ভোটে কারচুপি করে’। নির্বাচনে হেরে গেলে তিনি তা মেনে নেবেন কিনা বিতর্কে প্রশ্ন করা হয় ট্রাম্প ও বাইডেনকে। বাইডেন স্পষ্ট করে বলেন, তিনি মেনে নেবেন। একই প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্প তাই বললেন, যা সবাই আশংকা করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে দেখতে হবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে কিনা। কারণ ডাকযোগে ব্যালট নিয়ে অনেক কারচুপি চলছে’।
বিতর্কে ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসী’ বা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের নিন্দা করবেন কিনা। তিনি তা করতে সম্মত হননি। তার দিকে অভিযোগের তীর সঞ্চালক ক্রিস ওয়ালেস এবং জো বাইডেন দুজনের দিক থেকেই। সেই কারণে অনেকটা অসহায় ট্রাম্প ক্রিসকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘মনে হচ্ছে বিতর্ক ওনার (বাইডেন) সাথে হচ্ছে না, বিতর্ক হচ্ছে আপনার সাথে’। করোনা মোকাবেলায় ব্যর্থতা, ভ্যাকসিনের ব্যাপারে মিথ্যে দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ধস, বহিঃবিশ্বে মিত্র হারানো, ওবামা–কেয়ার, বর্ণবাদী, মিথ্যেবাদী এমনি ধরনের নানা অভিযোগ উঠে আসে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। সেগুলির উত্তর দিতে গিয়ে ট্রাম্প বারবারই লক্ষচ্যুত হয়েছেন। তিনি তার মেজাজকে বিতর্কের শুরু থেকে সংযত রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন, যার ফলে ‘ট্র্যাক–চ্যুত’ হয়েছেন বারবার। ট্রাম্প এক পর্যায়ে বাইডেনকে আক্রমণকে করে বলেন, ‘৪৭ মাসে তিনি (ট্রাম্প) দেশের জন্যে যা করেছেন, বাইডেন তার ৪৭ বছরের রাজনীতিতে করতে পারেননি’। এর বাইরেও ট্রাম্প সুযোগ পেয়েছিলেন বাইডেনকে আক্রমণের। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন, মন্তব্য রাজনৈতিক ভাষ্যকরদের। নির্বাচনের আর মাত্র চার সপ্তাহ বাকি। যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে এত অনিশ্চয়তা, উত্তেজনা দেখা দেয়নি। ধারণা করা হয়, ট্রাম্প যদি হেরে যান তাহলে তিনি যে সহজে পরাজয় মেনে নেবেন না, তা অনেকটা নিশ্চিন্ত। সেটি তিনি নিজেও অনেকবার বলেছেন। হয়তো শেষে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াবে। সুপ্রিম কোর্টে রিপাবলিকান–সমর্থক বিচারপতিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সমপ্রতি ডেমোক্র্যাট–ঘেঁষা লিবারেল বিচারপতি, রুত গিন্সবার্গ মারা যাবার পর শূন্যস্থানে নতুন বিচারপতি নিয়োগ দেবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইতিমধ্যে তিনি এনি কোনি বারেটের নাম ঘোষণা করেন এবং ৩ নভেম্বর নির্বাচনের আগেই তার প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে চান। যদি সক্ষম হন তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে ডানপন্থী হিসাবে পরিচিত বিচারকের সংখ্যা দাঁড়াবে ৬, অন্যদিকে ডেমোক্র্যাট–সমর্থিত লিবারেল হিসাবে পরিচিত বিচারপতির সংখ্যা ৩। ট্রাম্প বিগত ৪ বছরে ৩ জন বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছেন। হয়তো তার ভরসা এরাই তাকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সহায়কের ভূমিকা পালন করবেন। এখন গণতন্ত্রের দাবিদার যুক্তরাষ্ট্রের বিচারকরা সত্যিকার গণতন্ত্র সুরক্ষায় কী ভূমিকা পালন করেন সেটিই দেখার বিষয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট