হল্যান্ড থেকে

ড্রাগস, অপরাধের ভূস্বর্গ দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়া (২)

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ

কলম্বিয়া! দেশটির নাম উচ্চারিত হলে প্রথমে যে ছবিটি ভেসে আসে তা হলো ড্রাগস, মুক্তিপণের লক্ষ্যে অপহরণ সহ তাবৎ অপরাধের একটি স্বগর্রাজ্য‘, যেখানে প্রভাব বিস্তারের জন্যে ফার্ক (ঋঅজঈ), জাতীয় মুক্তি বাহিনী (ঊখঘ)-র মত বামপন্থী গেরিলা বাহিনী সহ বেশ কটি বিপ্লবী সশস্ত্র বাহিনীর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও লড়াই চলমান দীর্ঘদিন ধরে। মাদকদ্রব্য কোকেন চাষ ও পাচারের কেন্দ্রস্থল হওয়াতে কলম্বিয়া আক্ষরিক অর্থে পরিণত হয়েছে অপরাধের ভূস্বর্গে। এক তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ আমেরিকার এই বিশাল দেশটিতে সংঘটিত অপরাধের হার বিশ্বের শীর্ষ তালিকায়। ষাট দশকের মাঝামাঝি শুরু হওয়া কলম্বিয়ার সংঘাত বিগত কয়েক বছরে কিছুটা কমলেও শেষ সে দূর অস্ত। সরকার, আধাসামরিক গোষ্ঠী, অপরাধ সিন্ডিকেট, ফার্ক ও ই এল এন সবাই কলম্বিয়ায় নিজেদের আধিপত্য ও প্রভাব বাড়ানোর জন্যে লড়াই করে চলেছে। অনেকের অভিযোগ, এই সংঘাতে বহুজাতিক কোম্পানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবদান একেবারে খাটো করে দেখা যাবেনা। যে দেশের সামগ্রিক চিত্র এই সেই দেশটি আর যে কারণে হোক না কেন, বেড়ানোর জন্যে নিঃসন্দেহে আদর্শ স্থান নয়। বিষয়টা আর পাঁচ দশ জনের মত আমার অজানা ছিলনা। কিন্তু আমার যে যেতে হবে। অবশ্যই বেড়াতে নয়, কাজে। আর তাই আশপাশের যারা শোনে কলম্বিয়া যাচ্ছি, তারা চমকে উঠে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘সাবধান, রাত তো বটেই দিনের বেলাও একা পথ চলবেন না।একই সাবধানী বার্তা আমাদের ইমেইল বার্তায় জানিয়ে দেয়া হয়। সম্মেলনের আয়োজক সংস্থা একটি দীর্ঘ সাবধানী তালিকা ও পরামর্শ পাঠিয়েছিল। তাতে ছিল, হোটেলের বাইরে একা বের হবেন না, কম করে হলেও দুজন একসাথে যেন বের হোন, কোথায়ও যেতে টেক্সি নিতে হলে হোটেল রিসেপশনকে বলে ডেকে নেবেন, রাস্তা থেকে টেক্সি না নেয়া, বাইরে কোথায়ও ডলার না ভাঙ্গানো, পরিবর্তে রাজধানী বোগোতা এয়ারপোর্টে ভাঙানোর পরামর্শ, রাস্তায় মোবাইল ফোন ব্যবহার এড়িয়ে চলা, ট্যাপের পানি না খেয়ে বোতলের পানি পান করার পরামর্শ, এমন কী দাঁত মাজার জন্যে বোতলের পানি ব্যবহার করা ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে যাত্রার মিনিমাম ১০ দিন আগে বাধ্যতামূলক ইয়েলো ফিভার ভেকসিনেশনবা হলুদ জ্বরের টিকানেয়া। টিকা যে নেয়া হয়েছে তার প্রমাণস্বরূপ হলুদ বইসাথে রাখা যা বিমানবন্দরে চাইতে পারে বলে বলা হয়েছিল। যাবার ঠিক এগার দিন আগে ৮০ ইউরো, প্রায় বার হাজার টাকা জমা দিয়ে হলুদ টিকানিয়েছিলাম। এই টিকা হলুদ জ্বরেরবিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে। হলুদ জ্বর হলো এমন একটি ভাইরালসংক্রমণ যা আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় দেখা যায়। টিকা নেবার দশ দিনের মধ্যে টিকানেয়া ব্যক্তির মধ্যে হলুদরোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী হয় এবং বিজ্ঞানমতে এটি আজীবন কার্যকর থাকে। এর বাইরে যে শহরে আমার যাওয়া ও থাকা হবে, জানানো হলো, সেখানে মশার উপদ্রব থাকতে পারে যা ডেঙ্গু, চিকেনগুনিয়া অথবা জিকা ভাইরাস বহন করে। তা থেকে রক্ষা পাবার জন্যে আমাদের পরামর্শ দেয়া হলোসন্ধ্যার সময় এবং সবুজাভ এলাকায় হাতওয়ালা জামা পড়ার।বলা হলো যেখানে থাকবো সেখানে জানালা দরজা বন্ধ রাখতে এবং এয়ারকন্ডিশন বা ফ্যান অন রাখতে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার বহন করারও পরামর্শ দেয়া হলো। বলা হলো পাবলিক টয়লেট ব্যবহার এড়িয়ে যাবেন এবং রাস্তাঘাট থেকে খাবার খাবেননা। তবে যে কদিন ছিলাম হোটেলের কোনখানে কোন মশা বা মাছির দর্শন মেলেনি। না রাতে না দিনে।

সাবধানী বার্তার শেষ নেই। যেখানেই যাই প্রসঙ্গক্রমে শুনি -‘ভাই সাবধান। ড্রাগসের দেশ, তাবৎ অপরাধের দেশ। ফলে মনের এক কোণায় এক ধরনের অজানা ভয়, শংকা কাজ করছিল। একবার তো ভেবেইছিলাম যাওয়া বাতিল করে দেই। কাজ নেই এতো রিস্ক নিয়ে। আমার কেবল হ্যান্ড লাগেজ ও ল্যাপটপ ব্যাগ। যখন ভ্রমণ করি, এমন কী বাংলাদেশেও যখন যাই, তখন হ্যান্ডলাগেজে কোন তালা দেই না। কিন্তু এবার কলম্বিয়া যাবার সময় হাতের ব্যাগে কেবল একটি নয়, তিন তিনটি ছোট্ট তালা লাগিয়েছিলাম। ব্যাগের পাশে যে দুটো ছোট পকেট আছে তাতেও। এই ভেবে, যদি কেউ আমার অজান্তে ওই ফাঁক গলিয়ে ড্রাগস রেখে দেয়। সাবধানের মার নেইবলে কথা। তাই হ্যান্ডব্যাগ রাখলেও, বারবার খেয়াল রেখেছি অন্য কোন যাত্রী নিজের ব্যাগ রাখতে বা নিতে গিয়ে আমার ব্যাগে হাত দিচ্ছে কিনা। বুঝতেই পারছেন ভয়ের পরিমাণ কেমন ছিল। আমস্টারডাম থেকে যাবার সময় কোন চেক হয়নি। ইমিগ্রেশনে জিজ্ঞাসা করেনি কোথায় যাচ্ছি। ইমিগ্রেশন পার হয়েছি অটোমেটিক স্ক্যানিং মেশিনে পাসপোর্ট ঢুকিয়ে। ইউরোপীয় পাসপোর্টের এই মজা। কিন্তু ছয় দিনের মাথায় কলম্বিয়া থেকে ফেরার পর হল্যান্ডের শিফল এয়ারপোর্টে প্লেনের দরোজার মুখে দেখি ডাচ নিরাপত্তার বাহিনীর কয়েক সদস্য দাঁড়িয়ে, সাথে কয়েকটি বিশালদেহী কুকুর। বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুরগুলি যাত্রীদের ব্যাগ শুঁকে শুঁকে দেখছে। আমার ব্যাগের ধারেকাছে এলোনা। কদ্দুর পেরিয়ে এসে এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে পা দিতেই দেখি সেখানেও একই কায়দায় নিরাপত্তা বাহিনী ও ডগ স্কোয়াড। কলম্বিয়া থেকে কোকেন পাচার হয় ইউরোপআমেরিকায়। আর তাই এতো কড়াকড়ি? জাতিসংঘের অফিস অব ড্রাগস এন্ড ক্রাইমের তথ্য অনুযায়ী, কলম্বিয়ায় বছরে আনুমানিক ২৬৬৪ মেট্রিক টন কোকেন উৎপাদিত হয়ে থাকে, যা দিয়ে প্রতি বছর ২০টি ৭৪৭ কার্গো বোয়িং প্লেন পূরণ করা যাবে। কলম্বিয়ার সরকার, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলি ড্রাগসের উপর যুদ্ধ ঘোষণা করেছে অনেক আগেই, অনেক মাফিয়াকে জেলে ভরেছে। কিন্তু কোকেন চাষ, কোকেন পাঁচার চলেছে সমানে।

যাই হোক ড্রাগস আর অপরাধের কাহিনী লেখার উদ্দেশ্য আমার না। ফিরে যাই যেখান থেকে শুরু। ৩১ আগস্ট হল্যান্ডের স্থানীয় সময় সকাল নয়টা পঞ্চাশে শিফল এয়ারপোর্ট থেকে কেএলএমর ফ্লাইট ছেড়ে যাবার কথা থাকলেও উড়াল দিল তার পনের মিনিট পর। এয়ারপোর্টে আমাকে ড্রপ দিয়ে আত্মজ অতীশ ফিরে যায় তার মায়ের কাছে। তার মা আছে তার অসুস্থ দিদিমার বাসায়। সেখানে ব্রেকফাস্ট সেরে সে ফিরে যাবে তার ইউনিভার্সিটিতে। আগের দিন সন্ধ্যেয় সে এসেছিল রটরডামে তার বাসা থেকে। গতকাল রাতে অতীশ সহ তার দিদিমাকে দেখে এসেছিলাম। দিন কয়েক আগে ডাক্তার বলে গেছেন তিনি আর বাঁচবেন না। কিন্তু প্লেনে পৌঁছার আগেই তিনি চলে যাবেন চিরদিনের তরে, সে কথা ভাবনায়ও আসেনি। প্লেনে কেবল আসন নিয়েছি। মোবাইল অন করে ফেইস বুক খুলতেই দেখি তার ছবি সহ মৃত্যু সংবাদ। আজ ভোরে মারা গেছেন। চমকে উঠি। অতীশকে ফোন দেই। সে বলে আমি এসে পৌঁছেছি, মা তোমাকে বলতে নিষেধ করেছে তাই জানাইনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল সাড়ে নটা। উনি মারা গেছেন সোয়া পাঁচটায়। অতীশ বললো, তার মা আমাকে জানায়নি মন খারাপ হবে ভেবে এবং যদি কলম্বিয়া যাবার সিদ্ধান্ত পাল্টাই সে আশংকায়। অতীশকেও তার মা বলেনি, কারণ সে ড্রাইভ করছিল, বিপদের আশংকায়। সুমনাকে ফোন করে কী বলবো, কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এক ধরনের অস্থিরতায় ভুগছিলাম। সুমনাকে ফোন করি। মায়ের মৃত্যু। কী বলে সান্ত্বনা দেব? সান্ত্বনা দেবার কোন ভাষা কি আছে? বুঝি অনেকক্ষণ ঝিম ধরে ছিলাম।সীটবেল্ট লাগানোর ঘোষণা আসতেই ফিরে আসি নিজের মাঝে। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে শাশুড়ির সাথে কাটানো শেষের দিনকার মুহূর্তগুলি। গত কয়েকটি মাস প্রতি সপ্তাহে গেছি তার কাছে। বিছানার পাশে গিয়ে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই, কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে উঠতেন, ‘আর পারছিনা এইভাবে সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতে। আমাকে নিয়ে যাচ্ছে না কেন? এইভাবে আর বাঁচতে চাইনা।সান্তনা দিয়ে বলতাম, ‘সময় হলেই যাবেন। আপনার চাওয়াতে তো আর হবেনা।এই সমস্ত স্মৃতি মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।

ইতিমধ্যে আমাদের উড়োজাহাজ প্রচণ্ড শব্দ তুলে রানওয়ে ধরে এগিয়ে চলে। একটা সময় শূন্যে। মনটাকে ডাইভার্ট করার জন্যে সীটের সামনে ট্রে নামিয়ে খাতা খুলে বসি। লিখতে থাকি, তাতে যদি মনটা একটু স্থির হয়। সীটের টিভি স্ক্রিনে দেখি ৩৪,২০০ ফুট উচ্চতায় আমাদের উড়োজাহাজটি উড়ে চলেছে। পৌনে দুঘন্টা চলার পর লাঞ্চ সার্ভ করা শুরু হলো। তখন সকাল সাড়ে এগার। আমার জন্যে টুআর্লি লাঞ্চ। তার উপর এয়ারপোর্টে এসে গেইটের সামনে পৌঁছে কফি ও হালকা স্ন্যাকস খেয়েছিলাম। লাঞ্চে দেয়া হলো চিকেন, ব্রেড, স্যালাড, চীজ, আর নাম না জানা খাবার আইটেম। প্লেনে সার্ভকরা সব খাবারের নাম জানা নেই। জিজ্ঞাসাও করিনে। যা দেয় তাই খাই, সবই ভালো লাগে সাধারণত, ভালো না লাগলে একটু চেকে রেখে দেই। আমার পাশে জানালার ধারের সীটে মাঝবয়েসী এক ইউরোপীয় দম্পতি। প্রথমে ভেবেছিলাম ডাচ। কিন্তু না, দেখলাম দুজনে ইংরেজিতেই কথাবার্তা বলছেন। দুজনেই জাপানি খাবারের অর্ডার দিয়েছেন। সাথে রেড ওয়াইন। ততক্ষণে আমাদের প্লেন আমস্টারডাম ছেড়ে লন্ডন, ডাবলিন (আয়ারল্যান্ড) পিছু রেখে সেল্টিক সাগর অতিক্রম করে অতলান্তিক মহাসাগরের উপর দিয়ে চলতে শুরু করেছে। স্ক্রিনে দেখতে পাচ্ছি বাকি পুরোটা পথ এই মহাসাগরের উপর দিয়ে যেতে হবে। তখনও কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতা পৌঁছানোর আরো আট ঘন্টা বাকি। তার অর্থ আরো ৮ ঘন্টা এই মহাসাগরের উপর দিয়ে ভাসতে হবে। ভাবতেই গা কাঁটা দিয়ে উঠে। ঠিক করি ফিল্ম দেখবো। চিন্তাটা ডাইভার্ট হবে এবং সময়ও কাটবে। ততক্ষণে লাঞ্চ শেষ। পাশের দম্পতি দুজনেই কার্টুন ফিল্ম দেখছেন। মজার ব্যাপার সামনের সীটে যে আফ্রিকীয় মহিলা দেখলাম তিনিও কার্টুন ছবি দেখছেন। কার্টুন ছবি যে কেবল শিশুদের আকর্ষণ করে তা নয় কিন্তু। টয়লেটে যাবার সময় লক্ষ্য করি অনেক বয়স্ক যাত্রীও নিবিষ্ট মনে কার্টুন ফিল্ম দেখছেন। ভেবে পাইনা তাতে কী মজা ওনারা পান। কেউবা স্ক্রিনে তাস খেলছেন। এই অসময়ে ঘুম আসবেনা। গতরাতে ঘুমের টেবলেট খেয়েছিলাম। তাতে কয়েক ঘন্টা ঘুম হয়েছে। কী ছবি দেখবো। স্ক্রল করতে থাকি। হলিউড, বলিউড, ইউরোপীয়, আরবীয়, নানা দেশের ছবি। বেছে নিলাম ঞযব ইঁপশরহমযস গঁৎফবৎং। তাতে অভিনয় করেছেন বলিউড অভিনেত্রী কারিনা কাপুর। সাইফ আলী খানের দ্বিতীয় স্ত্রী হবার পর তিনি তার নামের শেষে খানযোগ করে হয়েছেন কারিনা কাপুর খান। ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় নির্মিত এই ছায়াছবিতে কারিনা কাপুর এক শোকাহত ব্রিটিশভারতীয় গোয়েন্দার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তাকে বাকিংহামশায়ারে একটি খুন হওয়া শিশুর মামলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মেকআপ ছাড়া কারিনাকে এই ছায়াছবিতে বেশ ভালো লেগেছে। পৌনে দুই ঘণ্টার ছবিটি যখন শেষ হলো, পর্দায় দেখি কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতা পৌঁছার আরো সাড়ে তিন ঘন্টা বাকি। তখন আমরা অতলান্তিক মহাসাগরের উপর দিয়ে চলেছি। মনে হলো সময় যেন থেমে আছে। অন্যদিকে মনের ভেতর এক ধরনের অস্থিরতা। (চলবে)- (২৪০৯২০২৫)

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমাজে নিম্ন মধ্যবিত্ত ক্রমে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে অগ্রসর হয়
পরবর্তী নিবন্ধট্রাফিক আইন এবং মোটরসাইকেল চালক