‘যত গর্জে তত বর্ষে না’– কথাটি মনে এলো বহুল আলোচিত ও ঢাকঢোল পিটিয়ে অনুষ্ঠিত প্রথমে, আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের বৈঠক এবং পরবর্তীতে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কি ও সাত ইউরোপীয় শীর্ষ নেতাদের বৈঠকের ফলাফল দেখে। বলা বাহুল্য, বৈঠকের লক্ষ্য প্রায় তিন বছর ধরে চলা ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ বন্ধ করার উপায় খুঁজে বের করা। গোটা বিশ্ব তাকিয়ে ছিল আলাস্কা ও হোয়াইট হাউসের দিকে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও হোয়াইট হাউস আগ বাড়িয়ে বলেছিল এই শীর্ষ বৈঠক থেকে এমন কিছু বেরিয়ে আসবে যাতে রাশিয়া–ইউক্রেন চলমান যুদ্ধ থেমে যায়। কিন্তু বেলাশেষে দেখা গেল তেমনটি ঘটেনি। তবে অগ্রগতি যে একেবারে হয়নি সে কথাও বলা যাবেনা। আলোচনার পরিবেশ ছিল বন্ধুসুলভ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সাথে বেশ সৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কির প্রথম বৈঠক খুব একটা সুখকর ছিলনা। সেবার তার পোশাকের জন্যেও জেলেনেস্কি কিছুটা তিরস্কৃত হয়েছিলেন ট্রাম্প কর্তৃক। এবার তাকে বেশ উষ্ণ অভ্যর্থনা দেয়া হয়। গাড়ি থেকে নেমে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে হ্যান্ডসেক করার সময় দুজনকে বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল। আর গেলবার জেলেনেস্কি ছিলেন একা। এবার তার সাথে সঙ্গী হয়েছেন সাত ইউরোপীয় রাষ্ট্র প্রধান ও শীর্ষ নেতারা। এদের মধ্যে ছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মেক্রো, জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রেডরিক মেরজ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্টারমার, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জিওর্জিয়া মেলোনি, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার স্টুব, ন্যাটো সেক্রেটারি জেনারেল হল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুতে ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন দের লিয়েন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পুতিন ও জেলেনেস্কির সাথে অনুষ্ঠিত মিটিংয়ের আগে কেউ কেউ ফলাফল নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করলেও রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে ইউরোপীয় নেতারা কিছুটা শংকায় ছিলেন। কেউ কেউ আশংকা করেছিলেন যুদ্ধ বন্ধের জন্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেলেনেস্কির উপর ইউক্রেনের জন্যে কিছু অগ্রহণযোগ্য শর্ত চাপিয়ে দেবেন। কেননা ট্রাম্পকে বরাবর রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের পক্ষেই সাফাই গাইতে দেখা গেছে। দেখা গেল ইউরোপীয় নেতাদের সাথে বৈঠকের আগে ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ইউক্রেনকে রুশ দখলকৃত এলাকা ছেড়ে দিতে হবে এবং ইউক্রেন কখনো ন্যাটোর সদস্য হতে পারবেনা। এতে স্বাভাবিকভাবে খুশি হতে পারেননি জেলেনেস্কি ও ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ। প্রশ্ন– তাহলে এতো ঘটা করে বৈঠকের আয়োজন কি বিফলে গেল? এই বৈঠক থেকে যুদ্ধ বন্ধের কোন আশার আলো কি দেখা মেলেনি?
উত্তরে এক কথায় বলতে হয়, খুব একটা না। অন্তত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে দাবি করেছিলেন তিনি দুই পক্ষকেই শান্তি চুক্তিতে নিয়ে যাবেন তেমনটি কিছুই হয়নি। জেলেনেস্কি কিছুটা ছাড় দিতে রাজি হলেও পুতিন তার অবস্থানে অনড় থেকেছেন। অথচ ট্রাম্প এর আগে বার কয়েক নিজেকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সেরা বলে দাবি করে বলেছিলেন, চুক্তি হবেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেকদিন ধরে ‘যুদ্ধ বিরতির‘ জন্যে চাপ দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু দেখা গেল আলাস্কায় পুতিনের সাথে একান্ত বৈঠকের পর ট্রাম্প তার সে অবস্থান থেকে সরে আসেন। ধরে নেয়া হয় পুতিন তাতে রাজি নন। আর সে কারণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেটিকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি শান্তি–চুক্তির দিকে এগিয়ে যাবার প্রস্তাব দেন। এটি ইউক্রেনের জন্যে একটি রাজনৈতিক পরাজয় বলে মনে করা হয়। রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, আলাস্কা–বৈঠকে জয় হলো পুতিনের। দিন শেষে দেখা গেলো তিনি তার জায়গায় অনড় থেকে গেছেন। ট্রাম্প চেয়েছিলেন যুদ্ধ–বিরতি। চেয়েছিলেন রাশিয়া ও ইউক্রেন– উভয়ই একে অন্যকে আক্রমন করা বন্ধ করবে এবং স্থায়ী শান্তি সমাধানের লক্ষে আলোচনা চালিয়ে যাবে। পুতিন সব শুনলেন এবং জানালেন তিনি যুদ্ধ বিরতিতে আগ্রহী নন এবং সে জন্যে তিনি যুদ্ধের ‘মূল কারণের‘ কথা উল্লেখ করলেন। ট্রাম্প এও চেয়েছিলেন জেলেনিস্কিকে সাথে নিয়ে তাদের তিন জনের মধ্যে পরবর্তী বৈঠক হবে। পুতিন রাজি হলেন না। পুতিন যুদ্ধ বন্ধে যে আন্তরিক নন তা আবারো প্রমাণিত হলো যখন তিনি শান্তির লক্ষ্যে আলাস্কা সফর করছেন তখন ইউক্রেনের শহর রুশ–বোমায় পুড়ছে, মরছে ইউক্রেনীয় নাগরিক। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে আলাস্কায় লাল–গালিচা সংবর্ধনা দেয়া নিয়ে অনেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন। এই সংবর্ধনা ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রুশ প্রেসিডেন্টকে আলাস্কার এক সামরিক ঘাঁটিতে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। আকাশে উড়লো অত্যাধুনিক মার্কিন যুদ্ধ জাহাজ। পুতিন মাথা ঘুরিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। তাকে (ট্রাম্প) বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল। যেন যুদ্ধ জয় করেছেন। তার বডি–ল্যাঙ্গুয়েজ তাই বলে। তবে এই লাল গালিচা সম্বর্ধনার সমালোচকদের মতে, এটি প্রেসিডেন্ট পুতিনের কোন রাষ্ট্রীয় সফর ছিলনা। মার্কিন প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে তিনি সেখানে এসেছিলেন যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে আলোচনা করার জন্যে। ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের দায়ে তিনি একজন অপরাধী। হল্যান্ডের হেগ শহরের আন্তর্জাতিক আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। পুতিন কেবল নিজের দিকটাই দেখলেন। ট্রাম্পের কোন কথাই রাখলেন না। ট্রাম্প যখন বললেন, আমরা আবার বসবো, তখন প্রেসিডেন্ট পুতিন তার সীমিত ইংরেজি–জ্ঞানে বললেন, ‘নেক্সট টাইম ইন রাশিয়া‘। তার হাবভাবে মনে হচ্ছিল তিনি যেন মনে মনে আওড়াচ্ছিলেন – ‘ভেনি, ভেদি, ভিসি‘ অর্থাৎ ‘আমি এসেছি, দেখেছি, জয় করেছি।‘
২. খুব সতর্ক ছিলেন ইউরোপীয় রাষ্ট্রপ্রধান ও শীর্ষ নেতারা। ইউরোপীয় নেতারা খুব ভালো ভাবেই জানেন, রাশিয়াকে ঠেকাতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় সমর্থন অত্যাবশ্যক। আর সে কারণে দেখা গেছে হোয়াইট হাউসে যাওয়া ইউরোপীয় নেতারা সতর্কভাবে তার (ট্রাম্প) সঙ্গে তাদের মধ্যে যে বিরাজমান নীতিবিরোধ তা যতটা সম্ভব আড়াল রাখার চেষ্টা করেছেন। ন্যাটো সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুতে সহ ইউরোপীয় নেতারা, জেলেনেস্কি তো বটেই, দৃষ্টিকটুভাবে ঘুরে–ফিরে ট্রাম্পকে প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়েছেন। ট্রাম্পও বেজায় খুশি। জেলেনেস্কি তো ট্রাম্পকে খুশি রাখতে তার নিজের ড্রেস–কোড পরিবর্তন করে, স্যুট জাতীয় একটি পোশাক পরেছেন। ট্রাম্প পত্নী ফার্স্ট লেডির প্রশংসায় উচ্ছসিত হয়েছেন। তারপরও মতের যে অমিল সেটি স্পষ্ট হয়েছে জার্মান চ্যান্সেলরের মন্তব্যে। চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ ইউরোপীয় নেতা ও সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমরা সবাই যুদ্ধবিরতি চাই। যুদ্ধবিরতি ছাড়া পরবর্তী বৈঠকের আয়োজন এমনটি আমি কল্পনাও করতে পারছিনা। তাই আসুন এটি নিয়ে কাজ করি।‘ ট্রাম্প পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলেন, ‘শুরুতে যুদ্ধ–বিরতি ছাড়াও তিনি অনেক সংঘাতের সমাধানে পৌঁছেছেন।‘ ট্রাম্প বলেন, তিনি পুতিনকে ফোন করবেন এবং ইউক্রেনের সাথে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজন করবেন। সময় ও স্থান পরে ঠিক করা হবে বলে ঘোষণা দিলেও জানা যায়, পুতিন এই ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নন। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র কী ধরনের সহযোগিতা দেবে সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। একবার শোনা গিয়েছিল প্রয়োজনে ইউক্রেনে মার্কিন সেনা সদস্য উপস্থিত থাকবে। তবে দেখা গেল বৈঠকে ট্রাম্প ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সে–দেশে মার্কিন সেনা মোতায়েনের কোন প্রস্তাব দেননি। পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের কাছে অস্ত্র বিক্রি করার প্রস্তাব দেন এবং ইউরোপ ইউক্রেনকে অস্ত্র কেনায় যোগান দেবে এমনটাই ঠিক হলো। এদিকে ইউরোপীয় দেশগুলি নিজস্ব বাহিনীর মাধ্যমে ইউক্রেনে শান্তিরক্ষা মিশন পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পরিশেষে যুক্তরাষ্ট্রের যে রাজ্যে (আলাস্কা) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পুতিনকে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানান, সেটি এক সময় ছিল রাশিয়ার দখলে। আলাস্কা যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্যের একটি। এর পুবদিকে কানাডা এবং রাজ্যটি প্রশান্ত মহাসাগর, বেরিং সাগর ও আর্কটিক মহাসাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত। জনসংখ্যা মাত্র আট লক্ষ হলেও এই রাজ্যটি আয়তনে আমেরিকার সব চাইতে বড়। জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড, বেলজিয়াম ও লুক্সেমবুর্গ – এই ছয়টি দেশের সমান এর আয়তন। আজ থেকে ১৫৮ বছর আগে ১৮৬৭ সালের ৩০ মার্চ রাশিয়া বিশাল এই রাজ্যটি মাত্র ৭,২ মিলিয়ন আমেরিকান ডলারের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। সে সময়কার মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী উইলিয়াম শেয়ার্ড–এর উদ্যোগে এই কাজটি হয়েছিল। বরফে–ঢাকা এই অঞ্চলটি কোন কাজে আসবেনা ভেবে রাশিয়া তা বিক্রি করে দেয়। অন্যদিকে, অনেকটা পরিত্যক্ত আলাস্কা ক্রয় করাটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খুব একটা প্রশংসিত হলোনা। সবাই এই উদ্যোগকে ‘শেয়ার্ড–এর বোকামি‘ বলে অভিহিত করলেন। ভাবি এখন নিশ্চয় রাশিয়ানদের অনুশোচনা হয় বিশাল এই রাজ্যটি আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে বলে। আর যে সমস্ত মার্কিন নাগরিক সে সময় এই রাজ্যটি কেনাকে ‘বোকামি‘ বলে তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রীর নিন্দা করেছিলেন, তারাই বা পরবর্তীতে কী ভাবলেন? কথাটা এই কারণে বলা– দেখা গেলো আলাস্কা একটি ‘সোনার খনি‘। এর মাটি ও পানির নিচে লুকিয়ে ছিল বিশাল প্রাকৃতিক ভান্ডার– তেল ও মাছ। আলাস্কার সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস তেল উৎপাদন। যদি আলাস্কা একটি দেশ হতো, তাহলে এর অর্থনৈতিক অবস্থান সৌদি আরব ও কুয়েতের কাছাকাছি তুলনা করা যেত বলে এক তথ্যে জানা যায়। এছাড়া এই রাজ্যের রয়েছে খনি, পর্যটন শিল্প ও মৎস্যক্ষেত্র। এই রাজ্য আরো গুরুত্বপূর্ণ কেননা এখানে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। এক তথ্য অনুযায়ী ২০০১ সালে এই রাজ্যের মোট জাতীয় উৎপাদন ছিল ২৯ বিলিয়ন ডলার। ভাবা যায়! (২১–৮–২৫)।
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট।