‘হিংসায় উম্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব / ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভজটিল বন্ধ।’ আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘শক্তি প্রয়োগ করে শান্তি বজায় রাখা যায় না; এটি কেবল বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে অর্জন করা সম্ভব।’ অন্যদিকে নেলসন মেন্ডেলা কথায়, ‘শান্তি ও উন্নয়নের জন্য আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো আলোচনা ও সমঝোতা।’ কিন্তু ‘বোঝাপড়া’ কিংবা ‘আলোচনা ও সমঝোতা’ নামক সোনার হরিণগুলি কই? বিপুলা এই ধরণীর নানা প্রান্তে প্রতিনিয়ত যা–কিছু ঘটে চলেছে দেখে মনে হয় সুবচন আর শান্তির বাণী নির্বাসনে গেছে। ‘অসির’ কাছে ‘মসী’ অসহায়। দুর্বল সবলের হাতে নিপীড়িত, নির্যাতিত। অসুর মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মনুষ্যত্ব, বিবেক। মানুষ হারাচ্ছে জীবন, হারাচ্ছে তার বাঁচার অধিকার। রাষ্ট্র তাকে করছে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত। আবার দুর্বল রাষ্ট্র শক্তিধর রাষ্ট্রের হাতে হচ্ছে করায়ত্ত। আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য চারিদিকে ঘটে চলেছে অন্যায়, অনাচার। অপ্রতিরোধ্য ইসরায়েল প্রতিদিন শিশু–কিশোর, নারী থেকে শুরু করে পাখি শিকার করার মত নিরীহ মানুষ মারছে। এই লেখা লিখতে বসেছি যখন তখন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর চলছে ইসরাইলের হামলা। গাজার পর তেহরানে মরছে মানুষ, ধ্বংস হচ্ছে ঘর–বাড়ি সহ নানা স্থাপনা। শক্তিশালী এই দেশটিকে থামায় সে সাধ্য কার? জাতিসংঘ? সে–তো ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’। এই ফাঁকে নিধিরাম সর্দারের কথা সংক্ষেপে উল্লেখ না করে পারলাম না। নিধিরামের আর এক নাম অরিন্দম। নিধিরাম তার সাহস ও শক্তির কথা সব সময় তার গ্রামে বলে বেড়াতো। সরল গ্রামবাসী তার কথায় বিশ্বাস করে ভাবতো নিধিরাম যখন রয়েছে তখন তাদের গ্রামে ডাকাত পড়লেও কোন ভয় নেই। সে একাই সব ঠেকাবে। একদিন এলো ডাকাত দল, সব লুটে নিয়ে গেলো। কিন্তু নিধিরামের টিকিরও দেখা মিললো না। সবাই গিয়ে ধরলো তাকে। বলে, খুব তো বলেছিলে তুমি একাই একশো। লজ্জিত হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো নিধিরাম রাগ দেখিয়ে বলে, আমার কি কোন ঢাল–তলোয়ার ছিল যে আমি ডাকাতদের ঠেকাবো? যদি থাকতো দেখিয়ে দিতাম। গ্রামবাসী বুঝে নিলো ব্যাটা নিধিরামের আসলে কোন ক্ষমতা নাই। কেবল গলাবাজি। জাতিসংঘের দশা অনেকটা তাই। নিধিরামের মত তার বড় গলা, বড় কথা।
ইসরাইলকে থামায় যে দেশটির সে–সাধ্য ছিল সে–দেশের ক্ষমতাসীন সরকার নীরব। উল্টো উস্কানি দিচ্ছে। অন্যদিকে, এই সরকার বেশ কিছুদিন ধরে নিজেই নিজ ঘরে জনগণের উওপর ‘মশা মারতে কামান দাগার’ মত কর্মকাণ্ড করে চলেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলির অভিযোগ, দেশের প্রচলিত আইনের কোন তোয়াক্কা না করে, মানবিক মূল্যবোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই সমস্ত কর্মকাণ্ড ঘটে চলেছে। সরকার প্রধান ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘অভিবাসী হঠাও’ নীতিতে ‘অভিবাসী রাজ্য’ হিসাবে পরিচিত লস এঞ্জেলেস মাস খানেক ধরে উত্তপ্ত। উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে পার্শ্ববর্তী আরো কয়েকটি রাজ্যে। ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে, স্বদেশে অভাব, দুর্ভিক্ষ এড়াতে জন্মভূমি ছেড়ে আইনি, বে–আইনি পথে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেয়া অভিবাসীদের উপর বল প্রয়োগ করে তাদের নিজ–দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে মার্কিন সরকার। তাদের আঁটকানো হচ্ছে ডিটেনশন সেন্টারে। কেবল যে বৈধ কাগজ (ডকুমেন্ট) ছাড়া সে–দেশে যারা রয়েছে তাদের জোর করে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে তা নয়, ফেরত পাঠানো হচ্ছে বছরের পর বছর বৈধভাবে বসবাস করছে, ট্যাক্স দিয়ে আসছে তেমন অনেককেও। দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশুনা করতে আসা বিদেশী শিক্ষার্থীদেরও। মানবিক মূল্যবোধের চরম অবমাননা ও মানবাধিকার হচ্ছে লুন্ঠিত।
২. ইউরোপের দশা আমেরিকার চাইতে কোন অংশে কম নয়। হল্যান্ড সহ বেলজিয়াম, ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি, হাঙ্গেরী, ডেনমার্ক প্রায় সকল পশ্চিম ইউরোপীয় দেশে ‘অভিবাসী ঠেকাও’ মচ্ছবের শুরু ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার অনেক আগ থেকে। যে সমস্ত দেশের নাম উল্লেখ করলাম সেই সমস্ত দেশে দিনদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে উগ্র, কট্টর ডান এবং অভিবাসী ও ইসলাম–বিরোধী শক্তি। তারা চায় বিদেশিদের জন্যে ইউরোপের সকল দরোজা বন্ধ করে দেয়া হোক। তাদের অভিযোগ বিদেশিরা এদেশে এসে ইউরোপীয় মূল্যবোধ নষ্ট করছে, বিঘ্নিত করছে শান্তি–শৃঙ্খলা। তাদের অভিযোগ ওরা (অভিবাসী) এদেশে থাকবে, অথচ নিজ দেশীয় সংস্কৃতি, ধর্ম, অনুশাসন চাপিয়ে দিতে চাইবে ইউরোপীয়দের উপর। তাদের ভয় আগামীতে এমন দিন আসবে যখন মূল–ইউরোপীয়রা নিজ দেশে হয়ে পড়বে ‘সংখ্যালঘু’। এই সমস্ত অভিযোগ যে একেবারে অমূলক তাও নয়। এ–কথা সত্যি যে প্রচুর সংখ্যক অভিবাসী প্রতিদিন নানা চোরা পথ দিয়ে, দালালের হাত ধরে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ আসছে। পরবর্তীতে এদের কেউ কেউ নানা অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে। ধরাও পড়ছে তাদের কেউ কেউ, প্রকাশ্যে আসছে সে–সব কর্মকান্ড। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পাওয়া এদের কেউ কেউ ধর্ষণ জাতীয় ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কারণে ধরা পড়ছে। সুপারমার্কেট, শপিং মল থেকে চুরি করছে। মোটকথা, নানা ধরনের সামাজিক ‘নুইসেন্স’ সৃষ্টি করছে এদের কেউ কেউ। যার কারণে স্থানীয় নাগরিকরা, এমন কী আমাদের মত অনেক বিদেশীও তাদের ওপর ত্যক্ত–বিরক্ত। আর জনগণের এই বিরূপ–মনোভাব কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পাকাপোক্ত করছে উগ্র ডান রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী। তারই ফলশ্রুতিতে হল্যান্ডে ‘বিদেশি–ঠেকাও’ মনোভাব সাধারণ জনগণের মাঝেও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তাদের বক্তব্য, ‘হল্যান্ড বিদেশি দিয়ে ভরে গেছে। আমরা আর বাইরের লোক চাই না।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত তাদের বক্তব্য, ‘হল্যান্ড ফার্স্ট’। আর হল্যান্ডে এই অগণতান্ত্রিক ও নেতিবাচক রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃত্বে আছেন এন্টি–ইসলাম ও অভিবাসী–বিরোধী কট্টর ডান রাজনীতিবিদ, খিয়ের্ট বিল্ডার্স। ত্রিশ–পঁয়ত্রিশ বছর আগে উত্তর সাগর পাড়ের ছোট্ট কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে অতি সমৃদ্ধশালী এই দেশটিতে যে নানা জাতি, নানা বর্ণের, নানা ধর্মের মিলন ছিল তা আর খুব একটা অবশিষ্ট নেই। খিয়ের্ট বিল্ডার্সের মত রাজনৈতিক নেতৃত্ব এদেশের ভোটারদের এমনভাবে ‘ব্রেইনওয়াশ’ করেছেন যে, তাদের কাছে ‘অভিবাসী’ মানে ভিনগ্রহ থেকে আসা ভীতিকর কোন প্রাণী। যদিওবা শান্তিপ্রিয় ডাচ ও বামঘেঁষা রাজনৈতিক দলগুলি বিল্ডার্সের এই ধরনের চিন্তাধারার সাথে একমত পোষন করেন না। কিন্তু দিন যতই বেড়ে চলেছে তাদের মাঝেও বিদেশি নাগরিক এবং অভিবাসীদের প্রতি সমর্থন সহানুভূতি কমছে। গেল বছর সেপ্টেম্বর মাসে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, গ্রীন পার্টি ও লেবার পার্টির শতকরা ৯১% জন মনে করেন, শরণার্থীদের দেখভাল করা ডাচ সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। বর্তমানে সেটি নেমে এসে দাঁড়িয়েছে ৮৩% তে। অন্যদিকে, ফেই ফেই ডে (পিপলস পার্টি ফর ফ্রিডম এন্ড ডেমোক্রেসি) সমর্থকদের মধ্যে কেবল ৩৮% ভাগ এই ধারণায় বিশ্বাসী। গেল বছর তা ছিল ৪৪% ভাগ। যদিও বা শরণার্থী বা অভিবাসী ডাচদের মূল উদ্বেগের বিষয়, তারপরও আরো কিছু বিষয় রয়েছে যে–কারণে এই অভিবাসী–বিরোধী সেন্টিমেন্ট বা মনোভাব দিনদিন উর্ধ্বগামী। ওই জরিপে অংশ নেয়া প্রায় ৩৪% চান কম–দক্ষ (লো–স্কিলড) কাজের জন্যে হল্যান্ডে আসা বিদেশির সংখ্যা হ্রাস করতে, ২৬% চান উচ্চ দক্ষ (হাই স্কীলড) অভিবাসীদের ভিসার সংখ্যা হ্রাস করতে। অন্যদিকে, প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে মাত্র একজন মনে করেন অভিবাসন বা মাইগ্রেশন ডাচ অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। প্রায় এক তৃতীয়াংশ মনে করেন, অভিবাসনের কারণে হল্যান্ডের বাড়তি অর্থ ব্যয় হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, এতদিন ইউরোপীয় ইউনিয়নে অভিবাসীদের পক্ষের সমর্থন ভারী ছিল। কিন্তু দিনদিন ইউনিয়নে ডান দলগুলির অভিবাসী–বিরোধী তৎপরতা ও ক্ষমতা বেড়ে চলেছে।
৩. তবে শুধু যে হল্যান্ডে এই পরিস্থিতি তা ভাবার কোন কারণ নেই। একই দশা ইউরোপীয় অন্যান্য দেশেও। আর তাইতো উত্থান ঘটতে দেখি ফ্রান্সে চরম ডান নেত্রী মেরিন ল পেনের, হাঙ্গেরিতে প্রধান মন্ত্রী ভিক্টর ওজবার্নের মত কট্টর রাজনৈতিক নেতার। এদের সবার অন্যতম মূলমন্ত্র হচ্ছে ‘বিদেশি ঠেকাও’। সব চাইতে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, হল্যান্ডে আসা এই সমস্ত শরণার্থী/অভিবাসীদের সরকারের তরফ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘আশ্রয় কেন্দ্র’ নির্মাণ করতে চাইলে স্থানীয় অধিবাসীরা মানববন্ধন করে প্রতিবাদ জানান এই সমস্ত কেন্দ্র বন্ধ করতে। তাদের বক্তব্য– ‘প্রতিবেশি হিসাবে আমরা এই সমস্ত অবৈধ অভিবাসীদের দেখতে চাই না। তারা নানা অসামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত হয়।’ তাদের প্রতিবাদের মুখে ওলন্দাজ সরকার বাধ্য হয়েছে কয়েকটি স্থানে আশ্রয় কেন্দ্র হয় বন্ধ করে দিতে এবং নতুন কেন্দ্র নির্মাণ স্থগিত করতে।
মোদ্দাকথা, বছর কয়েক আগেও ইউরোপ–আমেরিকা কিংবা কানাডা বিদেশিদের জন্যে যে স্বর্গরাজ্য ছিল তা কমতে শুরু করেছে নেই। হয়তো এমন একটা সময় আসবে যখন এই কমতে–থাকাটা একেবারে শূন্যের কোঠায় গিয়ে পৌঁছুবে।
মহাত্মা গান্ধীর একটি উক্তি দিয়ে ইতি টানছি আজকের এই লেখার। তিনি বলেছিলেন, ‘যখন আমি হতাশ হই, তখন মনে করি যে, ইতিহাস জুড়ে সত্য ও ভালোবাসার পথ সব সময় জয়ী হয়েছে। অত্যাচারী এবং খুনিরা ছিল এবং একটা সময় মনে হয়েছে তারা ‘অজেয়’। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের পরাজয় হয়েছে। এই কথাটি সব সময় মনে রেখো।’
রচনাকাল : ১৮–৬–২০২৫
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট