ফিরে দেখা
স্মৃতি সততই সুখের, আসলে কি তাই –২
স্মৃতি সততই সুখের বলে একটি কথা চালু রয়েছে। কিন্তু স্মৃতি কি সততই সুখের? স্মৃতি কি কেবল সুখকে ঘিরে গড়ে উঠে? সুখের পাশাপাশি তো দুঃখের স্মৃতিও থাকে মানুষের, যেমনটি আছে ভালোবাসার উল্টো–পিঠে ঘৃণা। মানুষ স্মৃতি–তাড়িত হয়, হয় আবেগতাড়িত। সেটি যেমন হয় সুখকে ঘিরে, ঠিক তেমনি দুঃখকে ঘিরেও। জীবন–প্রবাহের যে কয়েকটি ধাপ রয়েছে তার বাড়ন্ত পর্যায়ে পৌঁছালে বুঝি এমনটি একটু–আধটু বেশি হয়। মানুষ ফিরে তাকায় তার ফেলে–আসার দিনে, হাতড়িয়ে বেড়ায় আনন্দ–বেদনা, হাসি–কান্না, হই–হুল্লোড়ে কাটানো অযুত মুহূর্তুগুলির দিকে। বুঝি একই বলে স্মৃতিচারণ, ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি ‘নস্টালজিয়া’। এটি প্রতিটি মানুষের জীবনে ঘটে। জীবনের অনেক কিছু সময়ের কারণে হারিয়ে যায়। এই যেমন বয়স, রূপ. সৌন্দর্য, খ্যাতি, যশ, অর্থ ইত্যাদি। কিন্তু যা হারিয়ে গেছে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক নিয়মে, তাকে ফিরে পেতে কিংবা হারিয়ে গেছে বলে অনেককে হা–হুতাশ করতে দেখা যায়। এই নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একটি সুন্দর কথা আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার জীবন থেকে সূর্য চলে গেছে বলে যদি তুমি কাঁদো, তাহলে তোমার অশ্রু তোমাকে আকাশের–তারা দেখতে বাধা দেবে।’
একথা সত্য জেনে চেষ্টা করেছি যা কিছু ফেলে এসেছি, ফেলে এসেছি তো জীবনের অনেকটা সময়, নিকটজন, তার জন্য আর কেন এই অশ্রুজল ফেলা। সব ফেলে এসেছি বটে কিন্তু সাথে করে তো নিয়ে এসেছি সমস্ত স্মৃতি। সেই সুখ–দুঃখ স্মৃতিতে ভর করেই আগামী দিনগুলিকে আরো সুন্দর, সুখময় করে যে তুলতে হবে। বোধকরি এই ভাবনা থেকে খুব একটা অশ্রু ঝরেনি। কখনো–সখনো মনটা যে কাতর হয়নি সে–কথা শক্তভাবে বলতে পারবো না, তবে ভেঙে যে পড়িনি সে–কথা সত্য। আজ জীবনের এই পর্যায়ে এসে যখন ফিরে তাকাই, তখন নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। জীবনটা এগিয়ে গেছে সামনের দিকে এবং ভালোভাবে। আজ জীবনের ৩৪টি বছর হল্যান্ড অবস্থান করে এখন মনে হয় শ্রদ্ধাভাজন প্রয়াত লেখক সাংবাদিক অরুণ দাশ গুপ্তের সেই সাবধানবাণী -‘খবরদার দেশে ফিরে আসবেন না, ও–ভুল করবেন না’ সঠিক ছিল। ফিরে–আসার ভুলটি করিনি বলে এই জীবনটিকে এমন করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছি। চৌত্রিশটি বছর, দিনের হিসাবে ১২ হাজার ৪১০ দিন। অথচ আজও মনে হয় এই তো সেদিন ঢাকা ছেড়ে হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামে শিফল এয়ারপোর্টে নেমেছি। সে–সময় ঢাকা থেকে সরাসরি বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালু ছিল। গেলবারের লেখায় লিখেছিলাম হল্যান্ড আসার আগে দেশের বাইরে যাওয়া বলতে ঘরের কাছে পড়শী নগর কলকাতা তক। শিফল এয়ারপোর্ট নেমে যা দেখি তাতেই অবাক ওই। এমন তকতকে ঝকঝকে এয়ারপোর্ট, হাইওয়ে, সড়ক, ঘরবাড়ি– যেন পটে আঁকা ছবি, একেবারে আক্ষরিক অর্থে। দেশে সব রেখে আসার মাঝে যে কষ্ট ছিল, তা অনেকটা মিইয়ে গেলো যখন ইমিগ্রেশেন পেরিয়ে দেখি এপাড়ে নিকটজন সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করছে মাস ছয়েক আগে যার সাথে জীবনের বন্ধন গড়ে উঠেছিল সামাজিক রীতিতে সে, সুমনা। তার মা, বড় তিন ভাই ও ছোট্ট এক বোন।
সুমনাকে আগেই বলে রেখেছিলাম আলাদা বাসা ঠিক করে রাখতে। সে বাসা নিয়েছিল হেগ শহরে ক্লিংইনডাল নামক এক অভিজাত এলাকায়। দোতালার ছোট্ট বাসা, দুজনের জন্যে যথেষ্ট। ভাড়া বেশি বিধায় মাস কয়েক পর ভিন্ন এলাকায় শিফট করে তিনতলার একটি মাঝারি সাইজের ফ্ল্যাটে চলে যাই। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি শ্বশুরবাড়ি। দূতাবাস এলাকায় বাসা, ওই বাসা থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটার দূরত্বে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিজ। স্কুল বয়সে এর নাম প্রথম শুনেছি। হল্যান্ড বেড়াতে এসে এটি দেখে না গেলে অনেকে বলেন, হল্যান্ড দেখা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। এরপর অনেকবার যাওয়া হয়েছে বিশাল এই ভবনে যা আন্তর্জাতিক বিচারালয় হিসাবে খ্যাত। কখনো স্রেফ দেখার জন্যে, দেশ থেকে কেউ বেড়াতে এসেছেন তাদের নিয়ে, কখনো বা পেশাগত কাজে। শেষ গেছি মিয়ানমার সামরিক জান্তা কর্তৃক রোহিঙ্গা গণহত্যা ইস্যুকে ঘিরে যখন এই কোর্টে উপস্থিত হয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী সে দেশের নেত্রী অং সু চি। সেটি ছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস। যাই হোক, রাতে খাওয়া শেষে টেঙি নিয়ে চলে যাই সুমনার ভাড়া করা বাসায়।
শুরু হলো নতুন জীবন। নতুন চ্যালেঞ্জ। অচেনা দেশ, অচেনা শহর, অচেনা এদেশের মানুষ। কথাটা সম্পূর্ণ ঠিকানা। তখন কেবল এক ডাচ নাগরিককে চিনতাম। তার সাথে ঢাকায় বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে (পিআইবি) সাংবাদিকদের এক প্রশিক্ষণ শেষে দেখা ও পরিচয় হয়েছিল। নাম স্নাইডার। তিনি ছিলেন হল্যান্ডের ইউত্রেক শহর থেকে ডাচ ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা, ইউত্রেক নিউজব্লাদের সম্পাদক। পাশাপাশি মিডিয়া সংক্রান্ত এক সংস্থার পরিচালক। পিআইবিতে যে প্রশিক্ষণ হয়েছিল তার জন্যে আর্থিক সহায়তা দেয় ওই সংস্থা। আমি যোগ দিয়েছিলাম বাংলাদেশ টাইমস–এর রিপোর্টার হিসাবে। সপ্তাহব্যাপী এই প্রশিক্ষণের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে এই প্রবীণ ডাচ সাংবাদিক প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। সমাপনী অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে একজনকে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্যে বলা হয়। আমার নাম উঠে আসে। সেখানেই এই ডাচ সাংবাদিকের সাথে পরিচয় ও আলাপ। কথা প্রসঙ্গে তার বিজনেস কার্ড বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘কখনো হল্যান্ড গেলে দেখা করো’। তখনও হল্যান্ড যাবার ভাবনা বা চিন্তা মাথায় ঘুণাক্ষরেও আসেনি। স্নাইডারের ভিজিটিং কার্ডটা রেখে দিলাম, এই ভেবে এটি খুব একটা কাজে আসবে না। কী অবাক করা, সেই ছোট্ট কার্ডটি হল্যান্ডে আসার কয়েক সপ্তাহের মাথায় আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো। আজ হল্যান্ডে আমার যে অবস্থান, সেখানে পৌঁছার পেছনেও ছিল একটি ‘ওয়েস্ট পেপার বিনের’ অবদান। কথায় আছে – ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন’। আমি পেয়েছিলাম সেই অমূল্য রতন। সে প্রসঙ্গে আসবো পরবর্তী লেখায়। এখন আসি প্রবীণ ডাচ সাংবাদিক স্নাইডারের সেই ভিজিটিং কার্ড কীভাবে হল্যান্ড আসার সপ্তাহ কয়েকের মাথায় আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো সে প্রসঙ্গে।
সাত সমুদ্দুর পাড়ি দিয়ে হল্যান্ড এসেছি। দেশে ছিল মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত জীবন, সুন্দর আগামীর হাতছানি। ঢাকার বুকে ইংরেজি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করছি। পেটে কিছু ইংরেজি বিদ্যা, তার জোড়ে পত্রিকার বাইরেও লোভনীয় চাকরি, স্বায়ত্তশাসিত/সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি ছেড়ে সুদূর হল্যান্ড। প্রথম দিন কয়েক কয়েকটি শহর ঘুরে বেড়ালাম। সুমনা চাকরি করছে ন’টা–সাড়ে পাঁচ। ঢাকা ছাড়ার আগে কার্ডটি সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম। ব্যাগ থেকে সেটি বের করে স্নাইডারকে ফোন দেই। ভেবেছিলাম হয়তো ভুলেই গেছেন। তিনি সম্পাদক, তার পত্রিকার দিনে সাতটি এডিশন বের হয়। আমি একজন রিপোর্টার মাত্র। অবাক করা, পরিচয় দিতেই লক্ষ্য করি তিনি আমার মত এক্সসাইটেড। বলেন, ‘চলে এসো একদিন’। ঠিকানা দিলেন। হেগ শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে। তখন আমার কোন গাড়ি ছিলনা। ট্রেন চড়ে এক শীতের সকালে রওনা দিলাম। সাথে সুমনা। দুজনের গায়ে ভারী শীতের কোট। ট্রেন থেকে নেমে বাস, খানিক বাদে নামলাম নির্দিষ্ট এক স্টপেজে। হেঁটে কিছুদূর এগুতেই চোখে পড়লো বিশাল এক ভবন। উপরে লেখা ইউত্রেক নিউজব্লাদ (ব্লাদ অর্থ কাগজ)। ভেতরে ঢুকে রিসেপশনে নাম বলতেই ডেস্কের উল্টো দিকে বসা ডাচ তরুণী টের পেলেন আমরা কারা। আগ থেকেই এপয়েন্টমেন্ট ছিল।
পত্রিকা ভবনে ঢুকে আমার আর এক দফা হোঁচট খাবার দৃশা। ঢাকায় যখন স্নাইডারের সাথে পরিচয় হয়, তখন তিনি বলেছিলেন তিনি এক রিজিওনাল অর্থাৎ আঞ্চলিক পত্রিকার সম্পাদক। আঞ্চলিক পত্রিকা বলতে আমার চোখে ভাসছিল রাঙামাটি কিংবা কোন মফস্বল শহর থেকে বের হওয়া কোন পত্রিকা। আমার ধারণা জন্মেছিল স্নাইডার হয়তো এই জাতীয় কোন এক আঞ্চলিক পত্রিকার সম্পাদক হবেন। আলাপকালে জানলাম প্রতিদিন এখান থেকে সাতটি এডিশন বের হয়। রিসেপশনসের তরুণীটি আমাদের নিয়ে তার কামরায় পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিলেন। বয়োজ্যেষ্ঠ এই সম্পাদক তার চেয়ার থেকে উঠে এসে আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। তারপর এগিয়ে এসে সুমনার ওভার কোটটি নিজে পেছন থেকে খুলে কামরার এক কোনে দাঁড়িয়ে থাকা হ্যাঙ্গারে রেখে দিলেন। পশ্চিমী ভদ্রতার আর এক নমুনা এবং আমার আবারও অবাক হবার পালা। শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে বাবার বয়েসী এই সাংবাদিকের এমন আচরণ দেখে। কফির সাথে আমাদের আলাপ এগিয়ে চলে। এলো সেই টার্নিং পয়েন্ট। বললেন, ‘তুমি এসেছো রাইট টাইমে। আমস্টারডাম–বেইসড নিউজ চ্যানেল, ইন্টার প্রেস সার্ভিস (আই পি এস) ওদের ইংরেজি বিভাগে তৃতীয় বিশ্ব থেকে আসা একজন রিপোর্টার খুঁজছে। তুমি চেষ্টা করতে পারো’। নিউজ চ্যানেলের এডিটরের নাম ঠিকানা দিলেন। তখন ই–মেইল আসেনি। সন্ধ্যায় বাসায় টাইপ মেশিন নিয়ে বসে পড়লাম। চাটগাঁ ও ঢাকার ইংরেজি পত্রিকায় বাই–লাইনে প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদ ফটোকপি করে ‘সি ভি’ সহ ডাকযোগে পাঠিয়ে দিলাম। কয়েকদিনের মাথায় এলো উত্তর। এক সকালে বাসার সামনে ট্রাম স্টেশন থেকে রেল স্টেশন গেলাম। সেখান থেকে ট্রেনে আমস্টারডাম। অফিস খুঁজে পেতে খুব বেশি দেরি হলো না। দেখা হলো এডিটরের সাথে। বয়সে তরুণ। অনুমান করি আমার কাছাকাছি হবেন কিংবা বছর কয়েক বড়। কথা প্রসঙ্গে ইংরেজিতে যা বললেন তার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় -‘তোমার সি ভি দেখে আমি অনেকটা ‘লাফ’ দিয়ে তার উপর পড়লাম’। অনুমান করি আমার চাকরি হয়ে গেছে। তারপর বেতনের যে অংক বললেন তাতে আমারও লাফ দিয়ে উঠার মতো। হল্যান্ড আসার কয়েক সপ্তাহের মাথায় বনে গেলাম সাংবাদিক। আমার নতুন জীবন শুরু হলো ইউরোপের ছোট্ট এই অতি উন্নত দেশটিতে। তবে চ্যালেঞ্জও কম ছিল না। সে সব লিখবো পরের সংখ্যায়।
চলবে
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট