হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১২ এপ্রিল, ২০২৫ at ৭:৩৪ পূর্বাহ্ণ

ফুল! কে না ভালোবাসে! ভালোবাসার মানুষকে ফুল দিয়ে ভালোবাসা জানায় অনেকে। আবার কারো কারো মতে ভালোবাসা জানান দিতে ফুল বা অন্য কোন বস্তুর প্রয়োজন পড়ে না। সত্যিকার ভালোবাসাসে যাকে ভালোবাসা হয়, তার চোখের দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়। চোখ যে মনের কথা বলে। তবে এ সত্যি ফুল আমরা সবাই ভালোবাসি। পথ চলতে গিয়ে ফুল দেখলে মন কেড়ে নেয়। ধরতে ইচ্ছে করে। ছিড়ে হাতে নিতে ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে ফুলের নাম। আবার ফুল যে কেবল সুখের মুহূর্তের জন্যে কিংবা ভালোবাসারজনের চুলে গুঁজে দেবার জন্যে তা নয়। দুঃখের সময়ও আমরা দেখি ফুলের ব্যবহার। কাউকে চিরদিনের তরে বিদায় দিতে গিয়ে আমরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানাই। আবার ফুল দিয়ে বরণ করে নেই। ফুল দিয়ে মালা সাজাই। ফুল দিয়ে অর্ঘ্য সাজাই। ঊনিশ শতকের জাপানি কবি ও আর্ট সমালোচক কাকুজো ওকাকুরা বলেছেন, ‘আনন্দে হোক কিংবা দুঃখে, ফুল আমাদের নিত্য বন্ধু’। বাস্তবিক তাই। ফুল নিয়ে এতো কথা বলার পেছনে যে কারণ, তা হলো এখন হল্যান্ডে চলছে বিশ্বখ্যাত ফুলের উৎসব ‘কৈকেনহোফ’। সামারে হল্যান্ড কাজে কিংবা বেড়াতে এসেছেন কিন্তু অবাককরা এই ফুলের উৎসব ঘুরে আসেননি তেমন কাউকে বোধকরি খুঁজে পাওয়া যাবে না।

হিন্দী ছায়াছবি যারা দেখেন তাদের মধ্যে খুব কম দর্শক পাওয়া যাবে যারা আশির দশকের শুরুতে তৈরি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছায়াছবি সিলসিলাদেখেননি। হিন্দি শব্দ ‘সিলসিলা’র বাংলা অর্থ ‘ধারাবাহিকতা’। বক্সঅফিস হিট করা সংগীতধর্মী এই ত্রিভুজ প্রেমের ছায়াছবিটি তৈরি করেছিলেন সফল চলচ্চিত্র নির্মাতা ইয়াস চোপড়া। মূল চরিত্রে ছিলেন অমিতাভ বচ্চন, জয়া ভাদুড়ী ও রেখা। ছিলেন শশী কাপুর ও সঞ্জীব কুমার। সেটি ১৯৮১ সালের কথা। কিন্তু এর আবেদন ও জনপ্রিয়তা এখনো অটুট রয়ে গেছে। ছবিটি বার কয়েক দেখেছি, গান শুনেছি অযুতবার। শুনে এখনো নস্টালজিক হয়ে পড়ি। সাড়ে চার দশক পার করেও ছবিটি, এর প্রতিটি গান এখনো হৃদয় ছুঁয়ে যায় দর্শকশ্রোতার। গানগুলি চিত্রায়িত হয়েছিল ভূস্বর্গ হিসাবে পরিচিত কাশ্মীর ছাড়াও হল্যান্ডের বিশ্বখ্যাত ফুলের উৎসব ‘কৈকেনহোফে’। দৈনিক আজাদীর এই পাতায় আমার লেখা ‘হল্যান্ড থেকে’ শুরু করি ‘কৈকেনহোফ’ ফুলের উৎসবকে নিয়ে। সে আজ থেকে ৩৪ বছর আগের কথা। ফিবছর হল্যান্ডে এই ফুলের উৎসবের আয়োজন করা হয়। বছরের ২০ মার্চ থেকে ১১ মে পর্যন্ত চলে ফুলের এই মহোৎসব। রাজধানী আমস্টারডাম থেকে ৩৯ কিলোমিটার দূরে এবং যে শহরে আমার স্থায়ীআবাস (দি হেগ) সেখান থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে ‘লিসে’ নামক ছোট্ট এক শহরে চলে এই উৎসব। ষোল বর্গ কিলোমিটার নিয়ে গড়ে উঠা এই ছোট্ট শহরের জনসংখ্যা মাত্র ২৩ হাজার (২০২১ সালের পরিসংখ্যান)। কিন্তু এই ফুলের উৎসবকে ঘিরে এই ছোট্ট শহরটি পর্যটকমুখর শহরে পরিণত হয় প্রতি বছর। গেল ২০২৪ সালে দুমাসব্যাপী এই ফুলের উৎসব দেখতে ও উপভোগ করতে দেশবিদেশ থেকে এসেছিলেন ১০ লাখের বেশি পর্যটক। মোট পর্যটকদের ২০ শতাংশ ছিল ডাচ নাগরিক। ‘কৈকেনহোফ’ ফ্লাওয়ার শো বা ফুলের উৎসবের সৌন্দর্যের বর্ণনা দেয়া বা এই লেখার মধ্যে দিয়ে তুলে ধরা অনেকটা অসম্ভবের সাথে লড়াইকরার মত। একরের পর একর ক্ষেত। দৃষ্টি যতটুকু যায় কেবল ফুল আর ফুল। চোখে অনেকটা সর্ষে ফুল দেখার মত। তাতে চোখধাঁধানো নানা বর্ণের, নানা আকৃতির, জানাঅজানা লাখো ফুল ফুটে আছে। তার মধ্যে যে ফুলের নাম সবার আগে আসে তা হলো, টিউলিপ। যারা কৈকেনহোফ ফুলের উৎসব দেখেননি, তারা ‘সিলসিলা’ ছবিতে দেখেছেন অমিতাভ বচ্চন ও রেখা, দৃষ্টি যতদূর যায় তত বিশাল এলাকা জুড়ে ফুটে থাকা লাখো টিউলিপ ফুলের মাঝখান দিয়ে হাত ধরে, কখনো বা জড়িয়ে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চলেছেন। এই ফুলের উৎসবে যারা বেড়াতে আসেন বিশেষ করে প্রেমিকপ্রেমিকা, বন্ধুবন্ধুনি, কিংবা স্বামীস্ত্রীসব বয়েসী, তারা ঠিক একই কায়দায় অমিতাভ আর রেখার মত হাত ধরে এগিয়ে আসতে থাকে, ভিডিও করে, আপলোড করে সোশ্যাল মিডিয়ায়, শেয়ার করে আপনজনবন্ধুদের সাথে। দেশ থেকে কেউ বেড়াতে বা কাজে হল্যান্ড এলে, যদি সেটি ‘সামারে’ হয়, তাহলে তাদের দর্শনীয় স্থান দেখার যে তালিকা থাকে তাতে কৈকেনহোফ একেবারে প্রথম দিকে। প্যারিস গিয়ে ল্যুভ মিউজিয়াম কিংবা আইফেল টাওয়ার না দেখলে যেমন প্যারিস দেখা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, কিংবা মিশর বেড়াতে এসে পিরামিড না দেখে ফিরে যাওয়া মানে দেশটিকে আধেক দেখা বা চেনা, ঠিক তেমনি হল্যান্ড এসে ‘কৈকেনহোফ’ বেড়িয়ে না গেলে যেন ওলন্দাজদের দেশটা অদেখা থেকে যায়। এখন সামার। ইউরোপ তো বটেই চীন, জাপান, কোরিয়া, আমেরিকা, জার্মানি থেকে শুরু করে বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশ থেকে নানা বয়েসী পর্যটকরা এসে ভিড় করেছে উত্তর সাগর পাড়ের ছোট্ট কিন্তু অতি উন্নত দেশ হল্যান্ডে। সবার লক্ষ্যলিসে শহরের ফুলের মেলা ‘কৈকেনহোফ’। অবস্থাদৃষ্টে মধ্যযুগীয় প্রবাদ ‘অল রোডস লিড টু রোম’এর মত বলতে হয় ‘অল রোডস লিড টু লিসে’। যেন – ‘সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমারি দুখানি নয়নে’। নয়ন জুড়ে যায় যতদূর যায় নয়ন। আর বিশাল এলাকা জুড়ে ফুলের মাঠ যখন থাকে নয়নের বাইরে তখন বলতে ইচ্ছে করে, ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে/রয়েছ নয়নে নয়নে’।

এই উৎসবের পেছনে রয়েছে হল্যান্ডের একশত ফুলচাষী যারা সত্তর লক্ষ ফুলের ‘বাল্ব’ সরবরাহ করেছেন ফুলের উৎসবকে প্রাণ দিতে। ‘কৈকেনহোফ’ ডাচ শব্দ, যার বাংলা অর্থ হলো, ‘রান্নাঘরের বাগান’। এটিকে ‘গার্ডেন অব ইউরোপ’ও বলা হয়। মোট ৭৯ একর এলাকা জুড়ে এই বাগানে ফিবছর ৭ লক্ষ ফুলের বাল্ব বা কলি লাগানো হয়। একটা সময় এগুলি ফোঁটে। কৈকেনহোফে টিউলিপ ফুলই মূলত দেখা গেলেও, দেখা মেলে আরো নানা জাতের ফুল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ডেফোডিল, লিলি, হায়াসিনত ও আরো আমার নাজানা অনেক রকমের ফুল। কৈকেনহোফের শুরু পনের শতকে। রাজ পরিবারের সদস্য, কাউন্টেস জ্যাকোবা ফান বেইয়েরেন (১৪০১১৪৩৬) রান্নার কাজে ব্যবহারের জন্যে এই বাগান শুরু করেন। তারপর তো ইতিহাস। ১৯৪৯ সালে ২০ জন শীর্ষস্থানীয় ফুলের বাল্ব চাষী এবং রপ্তানীকারকদের একটি দল বসন্তফুলের বাল্ব প্রদর্শনের জন্যে একটি প্ল্যান তৈরি করেন। সেখান থেকে সৃষ্টি কৈকেনহোফ ফ্লাওয়ার ফেস্টিভ্যালের। পরবর্তী সালে অর্থাৎ ১৯৫০ সালে জনসাধারণের জন্যে পার্কটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। প্রথম বছরেই এটি সফলতা অর্জন করে এবং দুই লক্ষ ৩৬ হাজার দর্শনার্থী আসেন। এবছর (২০২৫) কৈকেনহোফের ৭৬তম বার্ষিকী। এই ফুলের উৎসবে গেছি বহুবার। দেশ থেকে সামারে কেউ বেড়াতে এলে ওদের দেখানোর জন্যে যাওয়া হয়। এর রয়েছে প্রবেশ মূল্যও। গাড়ির রাখার জন্যে আছে বিশাল মাঠ জুড়ে মেইক শিফট পার্কিংয়ের বিশেষ ব্যবস্থা। একদল কর্মী প্রাইভেট কার, বাস, ক্যারাভানগুলিকে সাহায্য করে সঠিকভাবে পার্কিং করার জন্যে।

কেবল যে ঘুরে ঘুরে ফুল দেখবেন তা ভাবার কোন কারণ নেই। এতো বিশাল এলাকা জুড়ে এই ফুলের মেলা যে একদিনে, এমন কী কয়েকদিন ঘুরেও দেখা শেষ হবে না। এই বাগানে রয়েছে অনেক বিশাল দৈত্যাকার গাছ। ফুলের বর্ণ, জাত, আকার ভেদে বাগান সাজানো হয়েছে। সংক্ষেপে রয়েছে গাছ ও ফুলের নাম ও উৎপত্তির বর্ণনা। কিছুদূর পর পর রয়েছে বেঞ্চ, হাঁটতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে সেখানে খানিক জিরিয়ে নিতে পারবেন। রয়েছে বেশ কয়েকটি ছোটমাঝারি সাইজের খাবারড্রিংকসের দোকান। সেখানে চা, কফি স্ন্যাকস সহ লাঞ্চ সারতে পারবেন, তবে পকেট ভারী থাকতে হবে। অবশ্য আজকাল আর কেউ পকেট বা মানিব্যাগ ভারী করেননা। মানিব্যাগ বা পকেটে পাতলা একটি কার্ড থাকলেই হলো। বাড়তি দাম জেনে অনেকেই বাড়ি থেকে সাথে নিয়ে আসেন স্যান্ডউইচ, ড্রিংকস, চিপস ইত্যাদি। গাছের ছায়ায় বেঞ্চে দল বেঁধে কিংবা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তারা উদর পূর্তি করেন। তাদের কেউ কেউ যদি হন এশীয় তাহলে বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন হাতে বানানো রুটি কিংবা পাউরুটি, সাথে ভাজি, ডিম ইত্যাদি। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে এই গাছের ছায়ায় রাখা বেঞ্চগুলিতে বসে ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে পারবেন, কিছুটা এনার্জি সঞ্চয় করতে পারবেন বাকি সময়টা ঘুরে দেখার জন্যে। কেননা সন্ধ্যা নামার আগেই বন্ধ হবে গেইট।

সবাই আসে ফুল দেখার জন্যে। আমি দেখি ফুল ও মানুষ। কত রকমের, কত জাত, কত বর্ণ, কত ভাষাভাষী লোকজন যে এই ফুলের মেলায় আসেন তার কোন শেষ নেই। তাদের পোশাকআশাক, চলনবলন দেখতে আমার ভালো লাগে। লক্ষ্য করি চৈনিক কিংবা ফিলিপাইনি পর্যটকরা কথা বলেন উচ্চ স্বরে। ডাচরা শারীরিকভাবে উঁচু (লম্বা) কিন্তু তারা কথা বলেন অতি নিচু স্বরে। এত নিচু যে ধারে কাছে কেউ থাকলেও তারা শুনতে পান না। সবশেষে বলি, যারা হল্যান্ড বেড়াতে আসার চিন্তাভাবনা করছেন, সামারে আসবেন। বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুলের উৎসব ‘কৈকেনহোফ’ অবশ্যই ঘুরে যাবেন। ভালো লাগতেই হবে।

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রদ্ধায় স্মরণে রম্যসাহিত্যিক সত্যব্রত বড়ুয়া
পরবর্তী নিবন্ধইসরাফিল খসরুর সার্বিক মঙ্গল প্রার্থনা