হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুর বড়ুয়া | শনিবার , ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৪০ পূর্বাহ্ণ

সবার হৃদয়ে ভূপেন হাজারিকা -১
কিছু কিছু অনন্য ব্যক্তিত্ব আছেন যাদের সান্নিধ্য পেলে, যাদের কাছে যাবার সুযোগ হলে, হোক না সে স্বল্প সময়ের জন্যে, নিজেকে ধন্য মনে হয়। মনে হয় অতি সৌভাগ্যবান। তেমনি এক ব্যক্তিত্ব, অমর সংগীত শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, চলচিত্র-নির্মাতা ড. ভূপেন হাজারিকা। খেঁটে-খাওয়া মানুষের জীবন-সংগ্রাম, অত্যাচারের বিরুদ্ধে লেখা ও গাওয়া এই শিল্পীর সাথে যখন আমার সাক্ষাৎ, একান্তে কথা বলা, ‘আড্ডা’ দেয়া এবং গভীর রাতে যখন গোটা শহর প্রায় ঘুমিয়ে তখন খোলা আকাশের নীচে আমার কাঁধে হাত রেখে অনর্গল কথা বলে যাওয়া, মাঝে মধ্যে গানের কটি কলি গাওয়া শোনার সুযোগ হয় তখন তার বয়স ৭৩। কিন্তু দেখে কে বলবে তিনি সত্তরোর্ধ্ব, মনে হয় ষাটের কোঠায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক কিংবদন্তী। ৮ সেপ্টেম্বর তার জন্মদিন। তিনি জন্মেছিলেন ১৯২৬ সালে। বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হতো ৯৫। মারা গেছেন ৮৫ বছর বয়সে, আজ থেকে ১০ বছর আগে। হল্যান্ড এসেছিলেন মোহনীয় কণ্ঠের অধিকারী এই শিল্পী ২০০০ সালের ১৪ মে, আজ থেকে প্রায় ২১ বছর আগে। সময় কী দ্রুত এগিয়ে যায়। অথচ মনে হয় এই তো সেদিন তিনি হেগ শহরে হল-ভর্তি প্রবাসী বাঙালি দর্শক- শ্রোতাদের তার সুরেলা কণ্ঠ ও মন-ছোঁয়ানো উপস্থাপনায়, গানের ফাঁকে ফাঁকে গানের পেছনের কাহিনী বলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে মুগ্ধ করে গিয়েছিলেন। ফিরে গিয়েছিলেন এই বলে, ‘আবার আসবো’। আসা তার আর হয়নি। সে অনুষ্ঠানে যে কেবল হল্যান্ডে বসবাসরত দু’বাংলার বাঙালিরা উপস্থিত ছিলেন তা না, উপস্থিত ছিলেন সুরিনামী সমপ্রদায়ের কিছু দর্শক-শ্রোতাও, যারা হিন্দী জানেন ও বলেন। বাংলাদেশিরা এই মহান শিল্পীর কাছে চিরদিনের ঋণী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি দেশে ও বিদেশে স্বাধীনতার পক্ষে গান গেয়ে বেড়িয়েছিলেন।
সবার হৃদয়ে থাকা ভূপেন হাজারিকা ১০ বছর বয়সে তার মা, শান্তিপ্রিয়া হাজারিকা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অসমীয়া (আসামী ভাষা) সংগীতের সাথে পরিচিত হন। এই বয়সেই ১৯৩৬ সালে তার প্রথম গান রেকর্ড হয় কলকাতার অরোরা ষ্টুডিওতে। ভূপেন হাজারিকা কেবল সংগীত নিয়ে পড়ে থাকেননি। পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন সমানে এবং ভালোভাবে। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে বি এ অনার্স ও এম এ করার পর ১৯৪৯ সালে স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান, লাভ করেন পি এইচ ডি ডিগ্রি। ভূপেন হাজারিকা হল্যান্ড আসছেন শুনে ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠি অনেকের মত। তিনি হাতে গোনা কয়েক শিল্পীর অন্যতম যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের শরণার্থী শিবির সহ কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্যে গান গেয়েছিলেন। ২০১০ সালের মে মাসে তিনি এসেছিলেন লন্ডন। সেখানে অনুষ্ঠান শেষ করে বিশ্বখ্যাত ‘টিউলিপের’ সৌন্দর্য দেখবেন বলে এলেন উত্তর সাগর পাড়ের ছোট্ট দেশ হল্যান্ডে। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নয় প্রবাসী বাঙালিরা। তারা এবং আমস্টারডাম ভারতীয় ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টারের উদ্যোগে তড়িঘড়ি করে হেগ শহরের এক হলে আয়োজন করা হলো ভূপেন হাজারিকার একক সঙ্গীতানুষ্ঠান। তার প্রচণ্ড ব্যস্ততা ও সময়-স্বল্পতার সত্বেও তার একান্ত সাক্ষাৎকার নেবার অনুমতি পাওয়া গেল। ভূপেন হাজারিকা হল্যান্ড আসছেন এটা যে প্রবাসী বাঙালীদের জন্যে কী সুখকর সংবাদ তা টের পাচ্ছিলাম অনুষ্ঠানের দিন কয়েক আগ থেকে। ফোন পাচ্ছিলাম নানা জনের কাছ থেকে- কখন উনি আসছেন, হলে প্রবেশ-টিকেট পাওয়া যাবে তো ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই সামনের দিকে বসতে চায়, চায় তাকে কাছ থেকে দেখতে, তার গান শুনতে। আর তাই অনুষ্ঠান বিকেল চারটায় শুরু হবার কথা থাকলেও দুপুর তিনটার আগ থেকেই রাজধানী আমস্টারডাম সহ দূরের শহর থেকে দর্শক-শ্রোতা হলের সামনে ভিড় জমাতে শুরু করে। অনুষ্ঠান শুরুর আগে ভূপেন হাজারিকা হল্যান্ডে বাংলাদেশী শিশুদের বাংলা-শিক্ষা স্কুল আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করলেন। তার কাগজপত্র নিয়ে বাংলাদেশ কল্যাণ সমিতির সভাপতি এম এম মনোয়ার ও ব্যবসায়ী আলমগীর কবির সহ মঞ্চ-লাগোয়া কামরায় গেলাম, যেখানে ভূপেন হাজারিকা তার দলবল সহ অপেক্ষা করছেন অনুষ্ঠানের জন্যে। নিজের পরিচয় দিয়ে আগমনের হেতু জানাতেই উনি অতি আগ্রহে স্কুল-সংক্রান্ত কাগজে সই করতে উদ্যত হলেন। এমন সময় তার পাশে বসা এক সুন্দরী, ভারতীয় মহিলা মাথা বাড়িয়ে দিয়ে তার কাছে ইংরেজীতে জানতে চাইলেন, কিসে সই করছেন। হেসে বলি, ‘কোন সম্পত্তির দলিলে নয়, স্কুল-সংক্রান্ত কাগজে’। পরিচয় জানতে চাইলে মহিলা বললেন তার নাম, কল্পনা লছমি। পরে সন্ধ্যেয় রেস্তোরাঁয় ডিনার-টেবিলে দীর্ঘ আলাপচারিতায় জেনেছি তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক। তার পরিচালিত শাবানা আজমিকে নিয়ে বানানো হিন্দী ছায়াছবি ‘এক পল’ দেখেছিলাম। তিনি আরো দুটো ছবি বানিয়েছেন। নাম ‘রুদালি’ ও ‘ধর্মিয়ম’। সেদিন জানালেন আর একটি ছবি পরিচালনা করছেন, দমন। ভূপেন হাজারিকা সেই ছবির সংগীত পরিচালক। অনুষ্ঠান যখন শুরু হলে ভদ্রমহিলা ভূপেন হাজারিকাকে দর্শক-শ্রোতাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, তিনি দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে ভূপেন হাজারিকার ‘ওয়ার্কিং পার্টনার’ হিসাবে কাজ করছেন। ১৯৫৭ সালে নির্মিত অতি জনপ্রিয় বাংলা ছায়াছবি ‘হারানো সুর’-এ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার/কানে কানে শুধু একবার বলো তুমি যে আমার’ গানটি গেয়েছিলেন গীতা দত্ত। কল্পনা লছমি গীতা দত্ত ও গুরু দত্তের আপন ভাগ্নী।
অপেক্ষার পালা শেষ। হল-ভর্তি লোক। ভূপেন হাজারিকা হারমোনিয়াম ধরলেন। সংগীত পরিবেশনের ফাঁকে ফাঁকে স্মৃতিচারণ করতে থাকেন। গোটা হলে পিনপতন নীরবতা। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ বলতেই আমি ডাবল এনার্জি পেয়ে যাই।’ বাংলাদেশ-ভারত সরাসরি বাস চালু হবার সময়কার স্মৃতি তুলে ধরে বলেন, ‘হঠাৎ রাতে অটল বিহারী বাজপেয়ী (ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী) ফোন করে বললো, ‘ভূপেন, তোমাকে বাংলাদেশ জ্যেতে হবে।’ বললাম, ‘আমি যাবো?’ বললো, ‘না, আরো একজনকে সাথে নিচ্ছি, সে জগজিৎ সিং।’’তা প্রাইম মিনিস্টারের সাথে যেতে হবে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা কীসে, বাসে যেতে হবে?’ বললো, ‘হ্যাঁ, অই শান্তির বাসে।’ ‘আমি বললাম, অই শান্তির বাসে যাবার শান্তি আমার নেই। বললো: ‘হ্যাঁ, যেতেই হবে। ভূপেনকো লানাই হ্যায়, উহি জানতে হ্যায় বাংলাদেশ। ক্যায়া বলনা হ্যায়, উহি জানতে হ্যায় বাংলাদেশ।’ তারপর বলে চলেন, ‘সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং লেগেছে যখন সব মন্ত্রী-টন্ত্রীর মধ্যে আমি একজন সামান্য গায়ক দাঁড়িয়েছি, দেখি বাংলাদেশ মিডিয়ার সমস্ত ফটোগ্রাফাররা আমার দিকে আসছে।
নানাদিক থেকে সমানে শুধু আমার ছবি তুলছে। আমি লজ্জা পাই, কেননা আমার পাশে সব মহা মহা মন্ত্রীরা দাঁড়িয়ে। ওদের দেখিয়ে বলি, এদের ছবি নাও, আমার না। ওরা বলে, ওনাদের ছবি তো সব সময় তুলি।’
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমাজের নষ্ট মানুষেরা
পরবর্তী নিবন্ধস্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা সমূহের বার্তা