হল্যান্ড থেকে

হেলসিংকি থেকে ঘুরে এসে : প্রেসিডেন্টের রাজকীয় কারবার, তার আছে তিনটি প্রাসাদ

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

বল্টিক সাগর! অতলান্তিক মহাসাগরের একটি বাহু যা ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, লাটভিয়া, লিথুয়েনিয়া, পোল্যান্ড, রাশিয়া, সুইডেন এবং উত্তর ও মধ্য ইউরোপীয় সমভূমি দ্বারা ঘেরা। নর্ডিক দেশ সুইডেন থেকে এবার আমাদের যাত্রার লক্ষ্য পার্শ্ববর্তী আর একটি নর্ডিক দেশ, বল্টিক সাগর পাড়ের ফিনল্যান্ড। আকাশ ও নৌপথে যাতায়াত করা যায় সহজে। আকাশ পথে মাত্র ৪৫ মিনিট। নৌপথে সন্ধ্যায় জাহাজে চড়ে পরদিন ভোর সকাল পৌঁছানো যায়। আমরা আকাশ পথকেই বেছে নেই। মেঘের উপর যেন ভেসে বেড়াচ্ছে আমাদের উড়োজাহাজটি। আর তারি সাথে ভেসে বেড়াচ্ছি আমরাও। প্লেনটিকে ঘিরে ধবল মেঘ, যেন অযুত সাদা রাজহাঁস। কিন্তু অবাক করা, মেঘ চিরে আরো আরো উপরে উঠতেই রোদ, মেঘের গায়ে সোনালী রোদ লুটোপুটি খাচ্ছে। প্লেনের কবুতরের খুপরীর মতো ছোট্ট জানালা দিয়ে এই দৃশ্য দেখে মন ভরে যায়। অপূর্ব সে দৃশ্য। যেন মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি খেলা। মনে পড়ে– ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুঁটি, আজ আমাদের ছুটিরে ভাই, আজ আমাদের ছুটি।’ আজ আমাদেরও ছুটি। ছুটিতে চলেছি চুটিয়ে ছুটি উপভোগ করতে। দলবেঁধে। ভেতর থেকে বাইরে দৃষ্টি মেলে ধরলে মনে হয় প্লেনটি যেন স্থির দাঁড়িয়ে। মেঘেরও নড়চড় নেই যেন। প্লেনের নিচেও একই দৃশ্য। পেজা তুলোর মত সাদা সাদা মেঘ। এক সময় আমরা নামচ্ছি নিচের দিকে। ইতিমধ্যে ককপিট থেকে নিচে নামার ঘোষণা দিয়েছে। জানালার পাশের সিট খালি। আমার বরাবরের পছন্দের আইলসিট। ল্যান্ড করার আগ মুহূর্তে গিয়ে বসলাম জানালার পাশের সিটে। সুমনা গেছে কণিকার পাশে, সামনের সারিতে। প্লেন বেশ ফাঁকা। প্লেন নামছে। সূর্যকে স্পষ্ট দেখতে পারছি। পুরোকাচের জানালা ভেদ করে চোখে মুখে এসে লাগছে তার ছটা। কড়া কিন্তু মিষ্টি সে রোদ। আরো এক স্তর নিচে নামতেই সূর্য উধাও। যেন গোটা পৃথিবী কুয়াশায় ঢাকা। উপর থেকে রাজধানী হেলসিংকির বিমান বন্দরের রানওয়েতে চব্বিশ ঘন্টা জ্বলে থাকা বাতিগুলি দেখতে পাচ্ছি। প্রচন্ড শব্দে আমাদের উড়োজাহাজ রানওয়ে টাচকরলো। এই আমার প্রথম আসা এই দেশটিতে। প্লেন ট্যাঙি করার জন্য ধীরগতিতে এগিয়ে চলে। চোখে পড়ে আর এক রানওয়ে ধরে ফিনএয়ারের একটি উড়োজাহাজ টেকঅফ করার জন্যে ধীরগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। শুরুতেই উল্লেখ করেছি স্টকহোমহেলসিংকি আকাশভ্রমণ খুব বেশিক্ষণের নয়। ককপিট থেকে চালকের আবারো ঘোষণা, ফিনল্যান্ডে এখন পাঁচ ডিগ্রি। সকালের ফ্লাইট ছিল আমাদের। সাধারণত এত ভোরে ফ্লাই করিনা। ভোরে তড়িঘড়ি করে ফ্লাইট বা ট্রেন ধরা আমার ধাতে সয়না। কিন্তু ভাগ্নি জামাই, জুয়েল আগেভাগে টিকেট কেঁটে রেখেছিল আমাদের সবার। সবার বলতে ওদের দুকন্যা সহ আমরা দুজন। আমরা মোট ছয় যাত্রী। হেলসিংকিতে হোটেলও সে বুক করে রেখেছিল। স্টকহোম এয়ারপোর্টে গাড়ি পার্ক করে দিন কয়েকের জন্যে আমাদের উড়াল দেয়া হেলসিংকির উদ্দেশ্যে। গাটাকে একটু সতেজ করার জন্যে কফি না খেলেই নয়। প্লেনে উঠার আগে এয়ারপোর্ট কফি শপ থেকে কফি এনে কয়েক চুমুকে শেষ করলাম। প্লেন উড়াল দেবার খানিক বাদে আমাদের স্যান্ডুইচ সার্ভ করা হলো। সার্ভ করা হলো চা, কফি, সফট ড্রিংকস। যাত্রীরা যে যার পছন্দমাফিক নিলো।

খুব বড় এয়ারপোর্ট নয়। পুরো নাম হেলসিংকি ওয়ানতা (Helsinkig-Vantaa) এয়ারপোর্ট। এই এয়ারপোর্ট থেকে ইউরোপের ৮০টি গন্তব্যস্থল সহ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আমেরিকায় উড়াল দেয় ফিনল্যান্ডের জাতীয় এয়ারলাইন্স সহ বিভিন্ন দেশের কানেকটিং ফ্লাইটগুলি। ১৯৫২ সালের সামার অলিম্পিককে ঘিরে তৈরি হয়েছিল এই বিমানবন্দর। কোন চেক নেই কোথায়ও। এয়ারপোর্টের বাইরে এসে অপেক্ষা করতে থাকি ‘উবারের’ জন্যে। ফোনে বলে দেয়া হয়েছিল বড় ট্যাক্সি লাগবে কেননা আমরা যাত্রী ছয়জন। তখন সকাল প্রায় নটা। আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম হোটেলে। বিশাল যাকে বলা যেতে পারে দৈত্যাকার এই হোটেল, নাম ‘স্ক্যান্ডিক হোটেল গ্র্যান্ড মেরিনা’। এই মনোরম হোটেলটি নদীর ধারে সুন্দর, শান্ত কাটাজানোক্কা জেলায় অবস্থিত; মার্কেট স্কোয়ার এবং হেলসিঙ্কি শহরের কেন্দ্রের ঠিক পাশেই। মিনিট দশেক হাঁটলেই শহরের মূল শপিং সেন্টার। কদ্দুর গেলেই বড়সর ক্যাথেড্রাল, নাম উসপেন্সকি ক্যাথেড্রাল, আছে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ। ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্টের কাজকারবার রাজকীয়। তার আছে তিনটি প্রাসাদ। এই প্রথম শুনলাম যে কোন দেশের প্রেসিডেন্টের তিনটি প্যালেস রয়েছে। রাজার থাকে কয়েকটি, কিন্তু প্রেসিডেন্টের? হোটেল থেকে শহরের প্রধান শপিং সেন্টারের দিকে হেঁটে যেতে একটি প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেসকে পাশ কেঁটে যেতে হয়। রেল স্টেশন লাগোয়া এই শপিং সেন্টারে রয়েছে নানা ধরনের দোকান, রেস্টুরেন্ট, গিফট শপ। রাতে ডিনার সেরে হোটেল ফেরার পথে দেখতাম গোটা শহর ততক্ষনে নীরব দাঁড়িয়ে। প্রচন্ড ঠান্ডা। আর এই ঠান্ডার মধ্যে প্যালেসের পাশে গার্ড পোস্টে কেবল এক সশস্ত্র পাহাড়াদার দাঁড়িয়ে। দিনের বেলায়ও একই দৃশ্য। কোন নড়চড় নেই। যেন স্থির পুতুল। দেখে কষ্ট হতো। বিশেষ করে রাতে। বেঁচারা! এই প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেসে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক শীর্ষ বৈঠক। ইতিমধ্যে তাতে অংশ নিয়েছেন এমনজনদের মধ্যে রয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্‌লাদিমির পুতিন, ভূতপূর্ব মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড, রোনাল্ড রিগ্যান, জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ, পোপ জন পল, ডোনাল্ড ট্রাম্প, সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ, প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন এবং আরো অনেকে।

আমাদের হোটেল লাগোয়া ‘হেলসিংকি ভাইকিং লাইন ফেরি টার্মিনাল’। সেখানে ভিড় করে ইউরোপের নানা দেশ থেকে আসা জাহাজ, বিশেষ করে বহুতল বিশিষ্ট প্রমোদতরীগুলি। জুয়েল জানালে, স্টকহোম থেকে সে একবার এই বিশাল জাহাজে চড়ে এই ঘাটে নেমেছিল। স্টকহোম থেকে রাতে ছেড়েছিল তাদের জাহাজ। সারা রাত নদীবক্ষে কাটিয়ে ভোরের দিকে হেলসিংকির এই ঘাটে ভিড়ে জাহাজ। পর্যটকরা সারাদিন শহর ঘুরে আবার সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে জাহাজে। ফিরে যায় গন্তব্যস্থলে। আমরা যখন হোটেলে পৌঁছি সে সময় দেখি এমনতর একটি বিশাল প্রমোদতরী ভিড় করেছে এই ঘাটে। দেখতে পাই যাত্রীরা সারিবদ্ধ নেমে আসছে জাহাজ থেকে। এদের কেউ কেউ আমরা যে হোটেলে উঠেছি সেই হোটেলে চেকইন করছেন। জানতে পারি, প্রায় সময় এই হোটেলে মিটিং, সেমিনারসিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়। আশপাশের দেশগুলি থেকে লোকজন আসেন ওই মিটিং, সেমিনারে অংশ নিতে। কাজও হলো, বেড়ানোও। অনেকটা ‘রথ দেখা কলা বেচার মত’। টেক্সি বিদায় করে হোটেল লবিতে প্রবেশ করতেই আমাদের অবাক হবার পালা। বিশাল লবি। যে কটি ফাইভ স্টার হোটেলে থাকা হয়েছে তার কোথায়ও এতো বড় সাইজের লবি চোখে পড়েনি। সাইজ দেখে মনে হলো একটু অস্বাভাবিক, এমন কী এর ভেতরের কারুকাজ, পিলার, ফার্নিচার সব। সব কিছুতে কাঠের কাজ। টয়লেট যা ভদ্রলোকেরা ‘ওয়াশরুম’ বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, ভিন্ন, কিছুটা পুরানো ধাঁচের। হোটেলের মূল প্রবেশ মুখে দুটো রিভলভিং গ্লাসের গেইট। উল্টোদিকেও বের হওয়া যায়। রিসেপশনের ডাইনে দুদিকে বেশ বড় সাইজের রেস্টুরেন্ট। মূলতঃ কেবল হোটেলে যারা থাকেন তাদের ব্রেকফাস্টের জন্যে। বাইরে থেকে প্রথম দেখায় মনে হয়না এটি একটি অতি আধুনিক হোটেল। যখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে পণ্য চলাচলের একমাত্র উপায় ছিল নৌপথ তখন নদীর পাশে ১৯২০ সালে তৈরি করা হয়েছিল এই বিশাল ভবন। এটিকে ব্যবহার করা হতো গোডাউন হিসাবে। পরে নৌবন্দরের ব্যবহার কমে গেলে এটিকে ‘কাস্টমাইজড’ করে আধুনিক হোটেলে পরিণত করা হয়।

হোটেলে চেকইন সময় দুপুর দুটো। আমার কাছে মনে হয় এটি গ্রেফ ব্যবসা। প্রায় ক্ষেত্রে হোটেলে চেকইন সময় দুপুর বারোটা। চেকইন করতে গেলে আমাদের সেকথা মনে করিয়ে দেয় রিসেপশনে বসা ফিনিশ মহিলা। বললাম, ‘ঠিক আছে, আমরা এখন কেবল চেকইন করে লাগেজগুলি রেখে বাইরে ঘুরে আসবো।’ জানতে চাই সেটি সম্ভব হবে কিনা। তাতে তাদের কোন আপত্তি নেই। শরীরটাকে চাঙ্গা করার জন্যে একটু কফি না খেলেই নয়। রিসেপশনের তরুণীটিকে বললে সে বিনয়ের সাথে বলে, কোন সমস্যা নয়। সেই ব্যবস্থা করে দিল। ঠিক করি হোটেল লবিতে বসে না থেকে এই ফাঁকে কাছাকাছি কোথায়ও দর্শনীয় কিছু দেখে আসি। ছোট্ট দেশ, জনসংখ্যা কম। রাস্তাঘাটে তেমন লোকজন নেই। বছরের এই সময়টায় (নভেম্বর) খুব বেশি পর্যটক বেড়াতে আসার কথা নয়। মিনিট কয়েক হেঁটে ট্রাম স্টপেজে গিয়ে দাড়াই। সেখানে টিকেট কাটার মেশিন। ভাষাগত সমস্যার কারণে অনেক কসরৎ করে টিকেট করা গেল। ট্রামে চড়ে এই লাইনের (জোন) শেষ মাথা পর্যন্ত গিয়ে শহরটাকে দেখে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ ভেবে ট্রামে উঠে বসি। ভিন্ন ট্রাম ধরে ঘন্টা খানেকের মধ্যে ফিরে আসি সেই পয়েন্টে যেখান থেকে আমরা উঠেছিলাম। পর্যটকদের সুবিধার জন্যে বিভিন্ন স্থানে পাবলিক টয়লেট রয়েছে। ব্যবহারের জন্যে টাকা গুনতে হয়না। হল্যান্ডে এটি চিন্তাও করা যায়না। হল্যান্ডে হচ্ছে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল।’ বেনিয়ার জাত ওলন্দাজরা। ইতিমধ্যে লাঞ্চের সময় প্রায় পেরিয়ে গেছে। কিছুটা ক্ষুধার্ত, তার চাইতেও বড় কথা ক্লান্ত। ফেরার পথে আমাদের হোটেলের কাছাকাছি ওপেন মার্কেট প্লেসে লাঞ্চ সারলাম সবাই মিলে।

হোটেল ফিরে এসে আমরা নিজ নিজ কামরায় চলে এলাম। বড়সর কামরা। চমৎকার বেডরুম, টয়লেট, ওয়ারড্রোব। টয়লেটে বেশ কয়েকটি বড় ও ছোট সাইজের তোয়ালে। পাশে একটি কাগজে ইংরেজি ও ফিনিশ ভাষায় লেখা একটি বার্তা। তাতে লেখা– ‘আপনি কি জানেন যে আমাদের এক সদস্য ‘ধোঁয়া’ (ওয়াশ) কমানোর জন্যে তোয়ালে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখার ধারণা নিয়ে এসেছিলেন? এইধারণা বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সমস্ত হোটেলে অনুসরণ করা হচ্ছে। এর ফলে প্রতি বছর হাজার হাজার লিটার পানি ও চার টন ডিটারজেন্টএর (কাপড় ধোঁয়ার পাউডার) সাশ্রয় হচ্ছে এবং তাতে পরিবেশ রক্ষা হচ্ছে।’ আপনাদের অনেকেই হয়তো জানেন বা দেখেছেন যে আবাসিক হোটেলে বোর্ডারদের অনুরোধ করা হয় যে, যে সমস্ত তোয়ালে তারা আর ব্যবহার করবেন না তা যেন তারা ফ্লোরে রেখে দেন। আবাসিক হোটেলে প্রতিদিন আগের দিনের ব্যবহৃত তোয়ালে বা বেড কভার সাধারণত ধোঁয়ার জন্যে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নতুন তোয়ালে ও বেডশিট দেয়া হয়। অনেকেই একবার তোয়ালে ব্যবহার করে ফ্লোরে রেখে দেন এবং পরদিন নতুন তোয়ালে ব্যবহার করেন। আমি তা এবরাবর এড়িয়ে চলি, পরিবেশকে মাথায় রেখে। নিদেনপক্ষে দু’দিন ব্যবহার করে রেখে দেই। কেননা বাসায় তো প্রতিদিন নতুন নতুন তোয়ালে বা বেডশিট ব্যবহার করিনা। বিষয়টি কারো কারো কাছে খুব একটা বড় কিছু মনে নাও হতে পারে। মনে হতে এতো সামান্য বিষয়। কিন্তু কোন উদ্যোগই সামান্য নয়। কথায় আছে ‘চ্যারিটি বিগিন্স এট হোম’।

(১৫২০২৫)

লেখক

সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের দেশ
পরবর্তী নিবন্ধএকজন ঋদ্ধ প্রমিত মানুষ ড. মাহবুবুল হক