দেশ থেকে ফিরে এসে : অসম্বদ্ধ সংলাপ – ২
‘যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে/ সে কথা আজি যেন বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়।’ রবি ঠাকুর তার মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা কী কথা বলতে চেয়েছিলেন জানিনে। সকাল থেকে একটানা বর্ষণমুখর দিনে আমারও তার মতো ইচ্ছে করছে মনের কথা কই। ইচ্ছে করছে বেসুরে গলায় গেয়ে উঠি – ‘ওলো সই আমার ইচ্ছে করে তোদের মতো মনের কথা কই।’ কিন্তু কী কথা? সই বা কই? দিনের বেলা হলেও বাইরে অনেকটা অন্ধকার, আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে অনেক আগে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আর তারি শব্দ শুনছি তেরছা–ভাবে থাকা আমার ঘরের পুরু কাচের জানালায়। ইউরোপে বছরের ৩৬৫টি দিনের অর্ধেকের বেশি দিনের আকাশ এমনটি। মানুষের মতো প্রকৃতিও নিয়ত পরিবর্তনশীল। মানুষের চরিত্রের যেমন পরিবর্তন ঘটে, প্রকৃতিরও। আজ থেকে ৩৩ বছর আগে যখন অর্থনৈতিকভাবে অতি উন্নত এই দেশটিতে স্থায়ীভাবে চলে আসি তখন এখানে বন্যা হতে দেখিনি। বরফ পড়তো, কোথায়ও হাঁটু সমান, বৃষ্টি হতো, তবে সে গুড়ি গুড়ি। দীর্ঘস্থায়ী হতো না। সময়ের সাথে সাথে বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে, ফলে বদলেছে ইউরোপের আবহাওয়ার ধরন। এই পরিবর্তনের মন্দ প্রভাব পড়েছে গোটা ইউরোপ জুড়ে। এখন ফি–বছর ইউরোপে বন্যা হয়।
যে–দেশে আছি অর্থাৎ হল্যান্ড তা সমুদ্র–সীমার নিচে। বন্যায় দেশটি সমুদ্রে ভেসে যাবার কথা। কিন্তু না। উল্টো এই ওলন্দাজ বা ডাচ জাতি সমুদ্রকে জয় করে, সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধার করেছে। সেই জন্যে একটা কথা প্রচলিত। সেটি হলো– ‘গড ক্রিয়েটেড দ্য আর্থ, এন্ড দ্য ডাচ ক্রিয়েটেড দ্য নেদারল্যান্ডস‘ অর্থাৎ ‘সৃষ্টিকর্তা ভূমি সৃষ্টি করেছে এবং ডাচরা সৃষ্টি করেছে নেদারল্যান্ডস‘। সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা সেই ভূমিতে ডাচরা গড়ে তুলেছে আধুনিক জনবসতি। তারা বন্যাকে প্রতিরোধ করেছে উন্নত প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বা ফ্লাড কন্ট্রোল হল্যান্ডের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। দেশের দুই–তৃতীয়াংশ এলাকা বন্যার জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ। সুদূরপ্রসারী, দক্ষ ও সুক্ষ পরিকল্পনার মধ্যে দিয়ে বন্যাকে এরা নির্বাসনে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং সমুদ্র–ঝড় কিংবা সমুদ্র থেকে তীরের দিকে ধেঁয়ে আসা পানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ওলন্দাজরা প্রাকৃতিক বালির টিলা, বাঁধ, ফ্লাডগেইট তৈরি করেছে। এই সমস্ত বাঁধ ইউরোপের প্রধান নদী, রাইন ও মিউজ থেকে প্রবাহিত পানি থেকে সৃষ্ট বন্যা প্রতিরোধ রোধ করে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৫৩ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি এক ভয়াবহ উচ্চ জলোচ্ছ্বাস উত্তর সাগর উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করেছিল। তখন এলাকাবাসীরা সবাই ঘুমে। সেই ভয়াবহ বন্যায় হল্যান্ডে ১৮৩৬ নাগরিক প্রাণ হারায়। একই বন্যায় যুক্তরাজ্য ও বেলজিয়ামে মৃতের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩০৭ ও ২২ জন। হল্যান্ডের যে এলাকা সব চাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা ছিল সমুদ্র–সীমার নিচে। ভেঙে পড়ার জাতি নন ডাচরা। সেই থেকে চলে তাদের প্রচেষ্টা কী করে দেশটিকে চিরদিনের জন্যে বন্যা থেকে মুক্ত করা যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বন্যা প্রতিরোধে যে ফ্লাড কন্ট্রোল ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে তা দিনের চব্বিশ ঘন্টা নজরদারির জন্যে রয়েছে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত ওয়াটার কন্ট্রোল বোর্ড। এর জন্যে প্রত্যেক নাগরিককে ইনকাম ট্যাক্স, মিউনিসিপালিটি ট্যাঙ ছাড়াও প্রতিমাসে নির্দিষ্ট কর দিতে হয়। বাংলাদেশেও এই বন্যা–প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা একেবারে অসম্ভব ছিলনা। হল্যান্ড ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ডেল্টা প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু অনিয়ম, দুর্নীতি আর সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে এই প্রকল্প সফল হতে পারেনি বলে অনেকের অভিযোগ। গোটা দেশের কথা বাদই দিলাম। বন্দর নগরী চট্টগ্রাম এখনও চাক্তাই খালকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলোনা। অনেকে তাই চাক্তাই খালকে বলে ‘চট্টগ্রামে দুঃখ’।
২. পানিকে নিয়ন্ত্রণ করতে খাল এবং খাল খননের বিকল্প কিছু নেই বলে নিজে এই বিষয়ে অভিজ্ঞ না হয়েও আমার ধারণা। মনে পড়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তার শাসনামলে দেশব্যাপী খাল–কাটা প্রকল্প শুরু করেছিলেন। এক সময় প্রেসিডেন্ট জিয়া ঠিক করলেন তিনি দেশের সিনিয়র রিপোর্টারদের সাথে নিয়ে কক্সবাজার পাতালি খাল খনন কর্মসূচি উদ্বোধন করবেন। সিনিয়র না হলেও ডেইলী লাইফের একমাত্র রিপোর্টার বিধায় ঠিক হলো আমি যাবো সে অনুষ্ঠান কাভার করার জন্যে। সাথে আমাদের ফটোগ্রাফার, ইলিয়াস। যদিওবা এই অনুষ্ঠান ছিল কেবল রিপোর্টারদের নিয়ে, ডেইলী লাইফ থেকে আমরা দুজন ছাড়াও শেষ মুহূর্তে আমাদের সাথে গেলেন পত্রিকার কার্যনির্বাহী সম্পাদক প্রয়াত নূর সাঈদ চৌধুরী। চট্টগ্রাম থেকে আরো যে তিন সাংবাদিক গিয়েছিলেন তারা হলেন, দৈনিক ইত্তেফাকের তৎকালীন ব্যুরো চীফ প্রয়াত মঈনুল আলম, দৈনিক স্বাধীনতা থেকে বন্ধু ওসমান গনি মনসুর এবং দৈনিক আজাদী থেকে তৎকালীন চিফ রিপোর্টার প্রয়াত ওবায়দুল হক। ঢাকা থেকে যে সমস্ত সিনিয়র রিপোর্টাররা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে একই প্লেনে কক্সবাজার পৌঁছেছিলেন তারা হলেন, দৈনিক বাংলার হেদায়েত হোসেন মোর্শেদ, দৈনিক সংবাদের আশরাফ খান, বাংলাদেশ টাইমসসের এম আর রুশো, দৈনিক শক্তির সম্পাদক, খুলনা থেকে সম্পাদক লিয়াকত সাহেব ও তার সাংবাদিক স্ত্রী। সবার নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। স্মৃতি বিট্রে করছে। আমরা মোট বাইশ সাংবাদিক। বিশেষ নিরাপত্তায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল মটেলে। গোটা কক্সবাজারে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হলো। কেননা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাত কাটাবেন সেখানে। বিকেলের দিকে তিনি এলেন, আমরা সাংবাদিকরা সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে। এক এক করে সবার সাথে তিনি পরিচিত হলেন। এক পর্যায়ে আমরা সবাই মটেলের খোলা–ছাদে বিশেষ ব্যবস্থায় তার সাথে বসে বাংলা ছায়াছবি ‘দি ফাদার’ দেখলাম। মটেলের ছাদ থেকে চোখে পড়ে কাছের সমুদ্র। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। তখন সন্ধ্যা। সেদিন ছিল চমৎকার জ্যোৎস্না রাত। জোৎস্নার ছটা তীরের দিকে ছুটে আসা ঢেউয়ের ওপর আছড়ে পড়ছে, আর গোটা পরিবেশকে এক মায়াবী ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে যেন। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। মজার ব্যাপার হলো, ‘দি ফাদার’ ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড দৃশ্যের অনেকাংশ জুড়ে ছিল কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। প্রায় আড়াই ঘন্টার ছবি শেষে প্রেসিডেন্ট সহ নিচে ডিনার টেবিলে যোগ দেই। খেতে খেতে সেখানে চলে খোলামেলা প্রশ্নপর্ব। প্রেসিডেন্ট জিয়াও খোলা মনে সব প্রশ্নের উত্তর দেন। পরদিন খুব ভোরে আমাদের গাড়ি বহর চলে অনতিদূরে পাতালি খাল পুনঃখনন প্রকল্প উদ্বোধন অনুষ্ঠানে। প্রেসিডেন্ট এলেন। উদ্বোধন করলেন ‘খাল কাটা কর্মসূচি’। সে সময় বলা হয় গোটা দেশে দেড় বছরে ১৫০০ খাল খনন কিংবা পুনঃখনন করা হয়।
৩. এর কিছুদিন পর দুপুরে অফিসে গেছি। বলা হলো, জার্মানি থেকে এক সাংবাদিক এসেছেন। উনি খাল কাটা কর্মসূচি নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করবেন। আমাকে বলা হলো তাকে নিয়ে খাল কাটা হয়েছে এমন স্থানে নিয়ে যাবার জন্যে। তিনি স্থানীয় চেয়ারম্যান ও জনগণের সাথে কথা বলবেন। আমার দায়িত্ব ইন্টারপ্রেটার হিসাবে কাজ করা। হোটেল আগ্রাবাদ পৌঁছে দেখি উনি আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। পেছনের সীটে দু’জন আমরা, সামনে চালক। আধ–বয়েসী এই সাংবাদিককে নিয়ে পটিয়ার দিকে এক গ্রামে গিয়ে খাল দর্শন ও স্থানীয় জনগণের সাথে কথাবার্তা বলে আমরা চলে এলাম। সন্ধ্যায় ছিল হোটেল আগ্রাবাদে ডিনার। সেখানে উপস্থিত চট্টগ্রামের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার জিয়াউদ্দিন আহমদ। তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। এর পর আর ওই জার্মান সাংবাদিকের সাথে যোগাযোগ হয়নি। সপ্তাহ খানেকের মাথায় দেখি জার্মান বার্তা সংস্থার বরাত দিয়ে বিভিন্ন পত্র–পত্রিকায় বড় করে ছাপা হয়েছে তার প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের খাল খনন কর্মসূচি। প্রশংসা জিয়াউর রহমানেরও।
৪. হল্যান্ডে কেবল গ্রামাঞ্চলে নয়, প্রতিটি শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে অসংখ্য খাল, নালা, আছে জলাশয়। নিয়মিত পরিচর্চা করা হয় ওই সমস্ত খাল, নর্দমা, জলাশয়। খাল–সেচ যে কেবল বন্যা প্রতিরোধে সহায়তা করে তা নয়, এর ফলে বৃষ্টিপাত নির্বিশেষে একটি সামঞ্জস্য পানি–সরবরাহ নিশ্চিত করে এবং উচ্চতর ফসল উৎপাদনে অবদান রাখে। কেবল তাই নয়, খাল–সেচ ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে পতন থেকে রোধ করে এবং মৎসচাষ, পানীয় জল এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে অবদান রাখে। তবে এর কিছু নেতিবাচক বিষয়ও রয়েছে। তা হলো পোকামাকড় ও পানি–বাহিত রোগের সংখ্যাবৃদ্ধি। তবে উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের কারণে এই সমস্ত সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। হল্যান্ডে এই কাজটি নিয়মিত করা হয়। আমাদের দেশের সমস্যা হলো, আমরা শুরু করি, কিন্তু যে কাজটি শুরু করি তা ধরে রাখার জন্যে যে উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ ও মনিটরিং জরুরি তা করিনা।
(৩–১০–২০২৪)
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট