হল্যান্ড থেকে

দেশ থেকে ফিরে এসে অসম্বদ্ধ সংলাপ

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

ফি সপ্তাহে লেখার বিষয় নির্বাচন করা মাঝেমধ্যে দুরূহ ঠেকে। কী লিখি, কী নিয়ে লিখি এই ভাবতে ভাবতে অনেকটা সময় কেটে যায় কখনোসখনো। যারা আমার মত নিয়মিত ‘কলম’ ধরেন পত্রিকার পাতায় ‘কলাম’ লেখার জন্যে তাদের হয় কিনা জানিনে। তবে আমার মাঝে মধ্যে হয়, বিশেষ করে যখন চারপাশে, কিংবা কাছেদূরে লেখার মত তেমন কোন ঘটনা ঘটে না বা ঘটলেও চোখে পড়ে না। আবার এমনও হয়, ঘটনা ঘটেছে এবং সে সমস্ত ঘটনা লেখার মতও বটে, কিন্তু নানা কারণে তা নিয়ে লেখা হয়ে উঠেনা। লেখককে তখন বিষয় খুঁজতে হয়। আর তাই তখন যা লেখা হয় তা হয় অনেকটা হযবরলের মত। আজকের লেখাটাও বোধকরি অনেকটা সেই গোত্রের। দেশ থেকে ফিরেছি সপ্তাহ কয়েক আগে। যেদিন ফিরেছি তার দিন কয়েক আগ থেকে চাটগাঁ শহরে অহল্যা বৃষ্টি। শহরের অনেক স্থানে বৃষ্টির পানি জমে গেছে। অনেক রাস্তায় গাড়ি চলাচলের অবস্থা নেই। বুদ্ধি বয়স থেকে বন্দর নগরীর এই হতচ্ছাড়া দশা দেখে আসছি। বুদ্ধি বয়স থেকে এও শুনে আসছি খাল খনন হচ্ছে, ড্রেজিং মেশিন নামানো হয়েছে, নাব্যতা বাড়ানো হবে খালনর্দমায়। কোথায়ও কোথায়ও ঘটা করে যন্ত্রপাতি নামানো হয়েছে। কিন্তু বর্ষা এলে সেই একই চিত্র। ‘যথা পূর্বং তথা পরং’ অর্থাৎ অবস্থা পূর্বের মতোই, কোন পরিবর্তনই হয়নি।’ অনেকে চাক্তাই খালকে চীনের দুঃখ ‘হোয়াং হো’ নদীর সাথে তুলনা করেন। যদিও বা হোয়াং হো নদীর ভয়াবহতা ছিল কল্পনাতীত। চীনের এই ৫৪৬৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট হোয়াং হো নদী যা ‘হলুদ নদী’ হিসাবে পরিচিত প্রাচীনকালে প্রায়শ তার দুকূল ছাপিয়ে আশপাশের সবকিছু বন্যায় ভাসিয়ে দিতো। নদীটির পানি কর্দমাক্ত ও হলুদ রংয়ের কারণে এই নদীর নাম চৈনিক ভাষায় ‘হায়াং হো’ বা হলুদ নদী। ‘হোয়াং’ এর বাংলা অর্থ হলুদ বা পীত এবং ‘হো’ এর অর্থ নদী। চীনের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী এটি, বিশ্বের ষষ্ঠ দীর্ঘতম, চ্যাং জিয়াং নদীর পরই এর স্থান। হোয়াং হো নদীকে ঘিরে চীনে বেশ কিছু মজার লোককাহিনী রয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস, হোয়াং হো নদীর দেবতা নদীতেই থাকেন। প্রতি বছর এই দেবতা নতুন স্ত্রী চায়। স্থানীয় অধিবাসীরা যদি দেবতার জন্য প্রতি বছর স্ত্রী জোগাড় করে না দিতে পারেন তাহলে তিনি ক্ষুদ্ধ হয়ে গোটা অঞ্চলের অধিবাসীদের বন্যার পানিতে ডুবিয়ে দেবেন। আর তাই দীর্ঘকাল ধরে স্থানীয় সরকার ও কিছু প্রভাবশালী লোকজন দেবতার জন্য তথাকথিত স্ত্রী বেছে নেয়ার কাজ করতেন এবং এই সুযোগে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ বা কর আদায় করতেন। হোয়াং হো নদীর এই ভয়ংকর রূপের কারণে স্থানীয় অধিবাসীরা যে কতটা ভীত সন্ত্রস্ত ছিলেন তা এই ধরনের লোককাহিনী শুনলেই বুঝা যায়। তবে এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। হোয়াং হো নদীর অববাহিকার পশুচারণ ভূমি বেশ উর্বর ও খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ। এই নদীর অববাহিকাতে চীনের প্রাচীনতম সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এই অববাহিকা চীনের সভ্যতা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির ভূমি। তাই চীনের মানুষ এখন আর হোয়াং হো নদীকে চীনের দুঃখ না বলে, চীন সভ্যতার সূত্রকার হিসাবে ভাবতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। বলার অপেক্ষা রাখেনা আমাদের বন্দর নগরীর সমস্যা এর ধারেকাছেও না। তবে অচিরে আমাদের অনেকটা চিরস্থায়ীসমস্যার সমাধান হবে তেমনটাই নগরবাসী আশা করেন।

হোয়াং হো থেকে ফিরে আসি দেশে। চট্টগ্রাম থেকে আকাশপথে ঢাকা হয়ে হল্যান্ড ফিরবো। যেদিন ফিরবো তার আগের দিন থেকে বৃষ্টি। মাঝেমধ্যে ঝড়ো আবহাওয়া। শহরের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ডুবে গেছে হাঁটুসমান পানিতে। ভয়ে ছিলাম এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গাড়ি যাবে কিনা। সকালে কিছু কাজ ছিল বলে এগারোটা থেকে গাড়ি দুয়ারে দাঁড়ায়ে। স্নেহভাজন ইয়ার চৌধুরীকে বলেছিলাম বাসায় চলে আসতে। সকল কাজের কাজী মেধাবী এই তরুণের জানা নেই এমন কোন বিষয় বোধকরি নেই। সে ইতিহাস থেকে শুরু করে কোথায়, কোন মার্কেটে ফটো ল্যামিনেট করা যায়, অনলাইনে কীভাবে ভূমি কর দেয়া যায় সব তার নখদপর্ণে। সপ্তাহ পাঁচেক দেশে অবস্থানকালে ইয়ার ছিল অনেকটা সর্বক্ষণ, নানা কাজে, অবসর সময়ে সংগ দিতো। তাকে নাম দিয়েছি ‘চাটগাঁর গুগল’। দুপুরে বাসায় অনেকটা কুইক লাঞ্চ সেরে গাড়িতে রওনা দেই বিমানবন্দরের দিকে। ইয়ার ছাড়াও এয়ারপোর্ট অবধি সঙ্গী হয়েছিলেন বন্ধু সিনিয়র সাংবাদিক নাসির ভাই (নাসিরুল হক)। ভাগ্য ভালো কোন সমস্যা হয়নি। নির্দিষ্ট সময়ে প্লেন ছাড়লো, তবে উড়াল দেয়ার মিনিট দশেক পর শূন্যের মাঝে ইউ এস বাংলার ছোট বাহনটি যে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করে দিলো তাতে এক পর্যায়ে মনে হলো বুঝি এই আখেরী যাত্রা। অনেক্ষণ ধরে চলে এই টার্বুলেন্স। আকাশপথে অনেক ভ্রমণ হয়েছে, টার্বুলেন্সের অভিজ্ঞতা দিয়ে অনেকবার গেছি। সে ছিল বড় আকারের উড়োজাহাজ এবং শূন্য থেকে চল্লিশ হাজার ফুট ওপরে। এবার ২০২৫ হাজার ফুট ওপরে এবং ছোট বাহনে। কিন্তু এমন ভীতিকর অভিজ্ঞতা, দীর্ঘ সময় ধরে এই প্রথম। যাই হোক, ডোমেস্টিক টার্মিনাল থেকে সরাসরি ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালে চলে যাই। এই আমার প্রথম এইভাবে সরাসরি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে, বিমানবন্দর থেকে বের না হয়ে ভেতর রাস্তা ধরে হল্যান্ডগামী কানেকটিং ফ্লাইট ধরা। এর পরের কাহিনী সে আর এক সময় লেখা যাবে।

দেশে ছিলাম সপ্তাহ পাঁচেক। কিছু পারিবারিক, ব্যক্তিগত কাজের জন্যে এবার দেশে যাওয়া। তখন দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে, উত্তপ্ত। প্রকৃতিও বৈরী। দিনভর যে টানা বৃষ্টি তাও নয়। তারপরও রাস্তা গেছে বৃষ্টি, নালারপানির দখলে। ফলে বেশ কয়েকবার কয়েকটি বিজনেস মিটিং বাতিল করতে হয়েছে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে – ‘মিসফরচুন নেভার কামস এলোন’, অর্থাৎ ‘দুর্ভাগ্য কখনো একলা আসে না’। আমার ক্ষেত্রেও তাই। বৃষ্টি এবং পরিস্থিতির কারণে বাসা থেকে তেমন কোথায়ও বের হওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে খাবার সমস্যা। রান্নাবান্নার জন্যে এক মহিলা প্রতিদিন ঘন্টা কয়েকের জন্যে আসে। তাকে মোবাইল ফোনে ক্যামেরা অন করে কীভাবে রান্না করতে হবে তার পরামর্শ নিতে হয় হল্যান্ডে উদ্বেগে থাকা লেখকের গিন্নির কাছ থেকে। তাতে রান্না কিছুটা খাবার উপযোগী হয় বটে, কিন্তু যিনি পরামর্শ দেন ইউরোপ থেকে তার রান্নার ধারেকাছেও না। এরপর আছে অনিয়ম করে খাওয়াদাওয়া, শোয়া, ঘুম থেকে দেরিতে ওঠা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার ফ্ল্যাটের ওপর তলায় থাকে জেঠাতো ভাই দীপক। মাঝেমধ্যে তার ওখানে যেতাম, কখনো সে আসতো, সময় কেটে যেত। এছাড়া ধারেকাছে থাকেন বন্ধু শফিকুল আলম খান। সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক দুটোই ছিলেন এক সময়। তিনি যখন বাংলাদেশ রেলওয়ের জনসংযোগ বিভাগেরর প্রধান ছিলেন তখন আমাদের সময়ের প্রবীণনবীন এমন কোনো সাংবাদিক, বিশেষ করে রিপোর্টার ছিলেন না যারা সিআরবি অফিসে তার চেম্বারটাকে অনেকটা নিজের চেম্বার বানিয়ে দেদারসে তার অফিসটেলিফোন ব্যবহার করেননি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, সে সময়কার দৈনিক আজাদীর রিপোর্টার নাসিরুল হক, দৈনিক বাংলার বন্ধু জাহিদুল করিম কচি, দৈনিক ইত্তেফাকের বন্ধু ওসমান গনি মনসুর, দৈনিক বাংলার সাইফুল আলম, বাংলাদেশ অবজারভারের মুর্তজা আলী, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার নুরুল ইসলাম ও আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া, দৈনিক আজাদীর চিফ রিপোর্টার ওবায়দুল হক এবং নয়া বাংলার স্বপন মহাজন। সে সময় মোবাইলের আগমন ঘটেনি। আমরা যে কজন শফিকুল আমল খানের ‘কাছের’ বলে অন্তত আমার ধারণা তারা কেবল যে তার অফিসিয়াল ফোনের ব্যবহার করতাম তা নয়, ঘন্টার পর ঘন্টা বসে, আড্ডা দিয়ে চাসিঙ্গারা সাবাড় করতাম। এই আপ্যায়নে শফিকুল আলমের জুড়ি নেই। তিনি যখন এক সময় দিনের চাকরির পাশাপাশি সন্ধ্যার দিকে ডেইলি লাইফে সাংবাদিকতা শুরু করেন তখন তাকে সহকর্মী হিসাবে পেয়েছি বেশ কিছুদিন, ১৯৮১ সালে আমার ঢাকা চলে আসার আগ তক। শফিক সাহেব মাঝে মধ্যে বাসায় আসতেন, আড্ডা দিতেন। সময়টা কেটে যেত ভালোই। এরই মধ্যে ছমাস আমেরিকাসফর শেষে দেশে ফিরে এলেন নাসির ভাই। উনিও আসতেন প্রায় প্রতিদিন। এক বিকেলে নাসির ভাই সহ আড্ডা দিচ্ছি। এমন সময় শফিকুল আলম খান ফোন করে বলেন, আসছি, সাথে এক গেস্ট। কে জানতে চাইলে বলেন, সারপ্রাইজ। বেল বেজে উঠলে দরোজা খুলে দেখি মনসুর। আমাদের সময় মনসুর দৈনিক স্বাধীনতায় কাজ করার পর দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দিয়ে খ্যাতি পেল তুখোড় রিপোর্টার হিসাবে। পরে তো বনে গেলো পত্রিকার সম্পাদক, ইংরেজি বাংলার দুটোই। মনসুরের সাথে আমার সম্পর্ক ‘তুইতোকারি’ পর্যায়ে। দু’বার এসেছিল হল্যান্ড, ছিল আমাদের সাথে। ঘুরে বেড়িয়েছি অনেক দর্শনীয় স্থান, এমন কী যে সমস্ত জায়গায় আমার কখনো যাওয়া হয়নি সেখানেও সে নিয়ে গেছে আমাকে। কতদিন একসাথে আমরা লালদীঘি পাড়ের মাঠে রাজনৈতিক দলগুলির মিটিং কভার করেছি। গিয়েছি দেশের বিভিন্ন স্থানে অফিসিয়াল এসাইনমেন্টে। চলে আড্ডা, পুরানো দিনের কাসুন্দি ঘাঁটাঘাঁটি। আমরা চার কলমযোদ্ধানাসিরুল হক, ওসমান গনি মনসুর, শফিকুল আলম খান এবং আমি। সবার ঝুলিতে কত অভিজ্ঞতা। নানা দেশঘোরা মনসুর বলে চলে সে সমস্ত দেশে তার দেখা, জানা নতুন নতুন অভিজ্ঞতার কথা, সাক্ষাৎ ও পরিচয় হওয়া মানুষের কথা। তার অনেক শখের একটি হলো চাবির রিং সংগ্রহ করা। মোবাইলে তুলে রাখা সেই সমস্ত রিংয়ের কিছু ছবি দেখালো আমাদের। মানুষের শখেরও কত রকমফের হয়।

(২৫..২০২৪) লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণের আবরণে এক সাংস্কৃতিক যোদ্ধা
পরবর্তী নিবন্ধজনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় নির্বাচনী সংস্কার জরুরি