হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৩১ আগস্ট, ২০২৪ at ৪:৪৯ পূর্বাহ্ণ

পাল্টে গেছে বাংলাদেশ। পাল্টে দিয়েছে দেশের তরুণ শিক্ষার্থীরা। পাল্টে যাবে সে বিশ্বাস ও ধারণা আন্দোলনরত শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ সবার ছিল। ছিলনা কেবল রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা ছিলেন তাদের। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশসৃষ্টি পূর্ব ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তর ও সত্তর থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি গণজাগরণে, সংগ্রামে বরাবর সামনের কাতারে ছিল এ দেশের নির্ভীক ছাত্র সমাজ। দেশের ‘কনভেনশানল’ রাজনীতিবিদরা যখন তাদের হীন ও দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থ উপেক্ষা করেছে, তখন ছাত্রদের দেখা গেছে জনগণের দাবি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে। এবারের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আগেকার আন্দোলনের চাইতে যে অনেক তীব্র, বেগবান ও সাহসী ছিল সে বলা বাহুল্য। এবারের আন্দোলন আগের আন্দোলনগুলির চাইতে কিছুটা ভিন্ন। ভিন্ন এই কারণে এবার আমরা দেখেছি সকল বয়সী শিক্ষার্থী প্রাণের মায়া উপেক্ষা করে, বিপদ হবে এই আশংকায় মাবাবার নিষেধ সত্ত্বেও রাস্তায় নেমে এসেছিল। কোটা বৈষম্য বাতিল করার দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাজপথ, সড়ক মুখরিত করে তুলেছিল। এক পর্যায়ে তাদের সাথে যোগ দিয়েছিল জনতা। তারা সড়ক দখল করেছিল সমস্ত ভয়, নিপীড়ন উপেক্ষা করে। প্রাণ যাবে নিশ্চিত জেনেও অকাতরে বুক পেতে দিয়েছিল তাদের অনেকে। ঘাতক বুলেট প্রাণ কেড়ে নেয় কয়েকশ প্রাণ। কেড়ে নেয় পথচারী, শিশু, দোকানকর্মচারী, সবজি বিক্রেতা, রিক্সাওয়ালা, আরো অনেকের প্রাণ। কিন্তু থামেনি ছাত্র সমাজ, জনতা। প্রশ্ন করিএর কি কোন প্রয়োজন ছিল? এই মৃত্যু কি এড়ানো যেত না? দেশজুড়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ কি এড়ানো যেত না?

দুঃখের সাথে বলতে হয়, কোন কোন সমাজে, রাষ্ট্রে ছাত্রযুব শ্রেণীকে, তাদের দাবিদাওয়াকে খাঁটো করে দেখা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের যে ‘স্টুডেন্টসপাওয়ার’ তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়, তাদের শক্তিহীন, এমন কী দেশের সমস্যার ক্ষেত্রে উদাসীন হিসাবে দেখা হয়। ধরে নেয়া হয় তারা কোন চ্যালেঞ্জ বা প্রশ্ন ছাড়াই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা সরকারের সমস্ত অবিচার অন্যায় মেনে নেবে, কোন প্রতিবাদ না করে। কিন্তু ইতিহাস বলে ভিন্ন। বিশ্বের বড় বড় বিক্ষোভ, আন্দোলন, প্রতিবাদের নেতৃত্ব দিয়ে ইতিহাস গড়েছে শিক্ষার্থীরা। তাদের দেখা যায় নিপীড়িত ও শোষিতের পক্ষে দাঁড়াতে এবং নিজের জীবন বাজি রেখে শোষক গোষ্ঠীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। ছাত্রদের এই যে প্রতিবাদ তা আমরা দেখি বাংলাদেশে, দেখি ইউরোপআমেরিকায়। যে ছাত্রআন্দোলনটি বিশ্বইতিহাসে সব চাইতে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তা হলো ভিয়েতনাম যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের দেশব্যাপী আন্দোলন। যে আন্দোলন এক সময় গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের পেছনের ঘটনা হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধ বন্ধ করবেন। কিন্তু দেখা গেলো, যুদ্ধ বন্ধের পরিবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কম্বোডিয়া আক্রমণ করে। এর প্রতিবাদে আমেরিকার কেন্ট স্টেট বিশ্ববিদ্যলয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শুরু হয়। পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় উত্তেজনা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৪ মে নির্ধারিত এক প্রতিবাদসমাবেশ নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রায় তিন হাজার লোকের সমাবেশ ঘটে। কর্তৃপক্ষ অস্ত্রশস্ত্রেসজ্জিত ওহাইও ন্যাশনাল গার্ডকে তলব করে। প্রতিবাদী ছাত্রজনতা প্রতিবাদ করতে থাকলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়, ফলে চার শিক্ষার্থী মারা যায় এবং নয়জন আহত হয়। কিন্তু আন্দোলন থেমে থাকেনি।

কেবল বাংলাদেশে নয়, ইউরোপ আমেরিকায়ও দেখেছি সরকার যখন উল্টোপথে চলে তখন শিক্ষার্থীরা কীভাবে সমস্ত ভয়, নির্যাতননিপীড়ন উপেক্ষা করে আন্দোলনে নামে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। দূর অতীতে যাবার প্রয়োজন নেই। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমরা শিক্ষার্থীদের দেখেছি প্যালেস্টাইনে ইসরায়েলি গণহত্যার প্রতিবাদে অভূতপূর্ব আন্দোলন গড়ে তুলতে। তারা দাবি জানিয়েছিল, ইসরাইলের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত বিনিয়োগ, আর্থিক ও অন্যান্য লেনদেন বাতিল করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের দাবি না মেনে পুলিশ ও ন্যাশনাল গার্ডকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার অনুমতি দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে থামাতে চেয়েছিল। এতে অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়েছিল, আহত হয়েছিল শিক্ষার্থীদের সমর্থনে এগিয়ে আসা অনেক শিক্ষক। গণহারে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল শিক্ষার্থীদের, বেশ কিছু শিক্ষকও। একই দৃশ্য দেখেছি কানেকটিকাট স্টেটের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেও একই দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন এবং এক পর্যায়ে অনশনে গেলে পুলিশকে তলব করা হয় এবং গ্রেপ্তার হয় ৬০ শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে গোটা আমেরিকার বিভিন্ন শহরের বিশ্ববিদ্যালয়। এক সময় সেই আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে হল্যান্ড সহ ইউরোপের বিভিন্ন শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আন্দোলন শুরু হয় কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায়। প্যালেস্টাইনে ইসরাইলী বাহিনীর গণহত্যা বন্ধ, দোষীদের শাস্তি এবং ইসরায়েলি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিশ্ববিদ্যালগুলির বিনিয়োগ বাতিলের দাবি জানায়। এক পর্যায়ে আমেরিকাইউরোপের অনেক প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলে তাদের বিনিয়োগ বন্ধ করার ঘোষণা দেয়। কোন কোন সরকার ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানায়।

বাংলাদেশে যা ঘটে গেল তার সাথে এর বেশ মিল খুঁজে পাই। রাষ্ট্র, সরকার ছাত্রদের শক্তি অনুধাবন ও মূল্যায়ন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল। তারা আলোচনা, সমঝোতাকে এড়িয়ে শক্তি দিয়ে দমাতে চেয়েছিল। তার পরিণতি কী তা আমরা সবাই প্রত্যক্ষ করেছি। আগেও লিখেছি আলোচনার কোন বিকল্প নেই। যাই হোক, আন্দোলনপরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের যে কাজটি অনেকের প্রশংসা কুড়িয়েছে তা হলো দেশকে ঘুরে দাঁড়ানোর কাজটি। দেশের বিভিন্ন শহরে সড়কে তারা বিশৃঙ্খল যানবাহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট থেকেছে। স্বীকার করতেই হয়, তারা যদি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই কাজটি না করতো তাহলে যানবাহনচলাচলে বিরাজমান অরাজকতা আরো দীর্ঘায়িত হতো। কয়েক সপ্তাহ ধরে তারা নিজেরা মিলেমিশে কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই এই প্রশংসনীয় কর্মটি করেছে। শহরে নিজের কাজে এদিকওদিক যখন গেছি তখন তাদের দেখেছি রোদ মাথায় নিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে এই কাজটি করতে। কোথায়ও কোথায়ও, কখনোসখনো হয়তো একটু উনিশবিশ হয়েছে। তারপরও বলতে হয়, যানবাহন চলাচলে তারা যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিল তেমনটি করে ট্রাফিক পুলিশরাও অনেক সময় পারেনি। প্রশ্ন জাগে, স্কুলকলেজের শিক্ষার্থীরা যদি এই কাজটি এমনভাবে সম্পন্ন করতে পারে, ট্রাফিক পুলিশ কেন পারেনা। যেবাহনে গেল সপ্তাহে চড়েছিলাম তার চালক বলে, ‘পুলিশ ধরলেই টাকা, না দিয়ে ছাড় পাওয়া যেত না।’ ‘ফিটনেস সার্টিফিকেট সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া সিএনজি থেকে শুরু করে বাসট্রাক চলে রাস্তায়। ট্রাফিক পুলিশ, সার্জেন্টদের টাকা দিয়ে চালকরা ম্যানেজ করে। ছাত্রদের ম্যানেজ করা সম্ভব নয়,’ মন্তব্য এক সিএনজি চালকের। এর পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার ধারে দেয়ালের চেহারা বদলে দিয়েছে। অবাক হয়ে দেখি বিভিন্ন সড়কের পাশে দেয়ালে শিক্ষণীয় স্লোগান ও ছবি। বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ছাত্রছাত্রীরা একসাথে এই কাজটি করেছে। দেশটাকে তারা যেন নতুন করে সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছে। একটা সময়ে ওই সমস্ত দেয়ালে ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আর নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন। এখন সেখানে শোভা পাচ্ছে বাংলাদেশের পতাকা সহ দেশাত্মবোধক স্লোগান আর বাণী। সবশেষে, তাদের দেখছি কীভাবে তারা এগিয়ে এসেছে বন্যার্তদের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। দেখে মনে হয় এ যেন আর এক বাংলাদেশ। প্রত্যাশা দেশ তাদের মাঝে যে উদ্দীপনা প্রত্যক্ষ করেছে, করছে তার কোন ব্যতয় তারা ঘটতে দেবেনা আগামী দিনগুলিতে। কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অল্প বয়সী শিক্ষার্থীদের দেখা গেছে তাদের শিক্ষকদের অপমান করে, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে পদত্যাগে বাধ্য করতে। এটি নিতান্তই দুঃখজনক। এই ধরনের অসুন্দর ঘটনা যেন না ঘটে সেদিকে যারা এই ছাত্রআন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। তাদের যে সফলআন্দোলন তাতে যেন কোন কালিমা না লাগে সেদিকে তাদের খেয়াল রাখতে হবে। একটি সুন্দরবাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্যে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কোন হীন স্বার্থ, কোন গোষ্ঠী যেন তাদের এই পরিশ্রম ও ত্যাগকে অমর্যাদা করতে না পারে সে ব্যাপারে তাদের সজাগ থাকতে হবে। তারাই দেশের আগামী দিনের ভবিষৎ। গোটা দেশ তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।

(২৬০৮২০২৪)

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষকদের অপমান করা প্রকৃত ছাত্রের পক্ষে সম্ভব না
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হবু উপাচার্যের করণীয় ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা