হল্যান্ড থেকে

বেলজিয়াম থেকে ফিরে এসে : এলোমেলো ভাবনা

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৯ জুন, ২০২৪ at ৪:৩২ পূর্বাহ্ণ

সপ্তাহ দুয়েকের মাথায় আবারো যেতে হলো ব্রাসেলস। হেগ শহর থেকে গাড়িপথের দূরত্ব প্রায় দুশো কিলোমিটার। তবে সড়কের গুণে, সাথে বাহন এবং চালকেরও এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে খুব একটা গায়ে লাগেনা। আরো সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয়, কোন খবর হয়না। অথচ দেশে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে ধারেকাছে গুলশান বনানী বা মিরপুর যেতে মনে হয় যেন যুদ্ধ করে ফিরেছি। ইচ্ছেমত গাড়ি চালানো, ট্রাফিকনিয়মের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কে কার আগে যাবে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা, রাস্তার দুর্বল দশাসবকিছু মিলে রাজধানী ঢাকা ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামে গাড়িপথে চলাচলের আর এক নাম যেন মাথাব্যথা। যাই হোক, যে শহরে আমার স্থায়ী আবাস (দি হেগ) সেখান থেকে ’শ কিলোমিটার গাড়িপথ পাড়ি দিলে হল্যান্ডবেলজিয়াম বর্ডার। গোটা ইউরোপ ঘুরে বেড়ানোর মজা এইখানে। বর্ডারে কোন চেক নেই, তল্লাশি নেই। ভিসার দরকার নেই। যেন যেখানে মন চায় সেখানে ছুটে চলা, এক দেশ থেকে আর এক দেশে। প্রতিবারের মত এবারও বর্ডারে খানিক দাঁড়িয়ে টয়লেট সেরে, ফিলিং স্টেশন থেকে কফি, স্ন্যাকস নিয়ে ফিরে আসি বাহনে। গাড়ি চলতে শুরু করে এবং ঠিক অংকের হিসেবে মোট দুই ঘন্টায় পৌঁছে যাই ইউরোপিয়ান প্রেস ক্লাব। পরদিন অর্থাৎ ২৩ জুন অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনের ব্যাপারে ক্লাবের পরিচালক লোরেনের সাথে ‘লাস্ট মিনিট চেক’পর্ব সেরে অপেক্ষা করতে থাকি ব্রাসেলসসে স্থায়ীভাবে বসবাসরত স্নেহভাজন মোর্শেদের (মাহমুদ) জন্যে। তখন দুপুর প্রায় দুটো। তার দেখা নেই। অথচ সে এই অনুষ্ঠানের অন্যতম আয়োজক। তার ওপর ভর করে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন বললে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবেনা। এদিকে আমাদের অর্থাৎ আমাকে আর সুমনাকে হোটেল চেকইন করতে হবে। ইউরোপীয় কমিশনের ধারে কাছেই হোটেল এন এইচ। চমৎকার এই হোটেল। প্রেস ক্লাবের কফি মেশিন থেকে কফি খেয়ে ঠিক করি অনিশ্চয়তায় না থেকে ইতিমধ্যে হোটেল চেকইন করে নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ। ইতিমধ্যে, খুদে বার্তা পাঠিয়ে মোর্শেদ জানালে, সে এই মুর্হুতে ব্রাসেলসের বাইরে ভিন্ন এক শহরে রয়েছে ফিরতে পাঁচটা হয়ে যাবে। কিছুটা অবাকই হলাম, কেননা সে সাধারণত সব সময় সময়মত তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে থাকে। তার ওপর ভর করা যায়। অপেক্ষা না করে রওনা দেই হোটেলের উদ্দেশ্যে। ভরসা জিপিএস। মিনিট সাতেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম হোটেলে। অনলাইনে উল্লেখ ছিল হোটেলের গাড়িপার্কিংয়ের নিজস্ব স্থান রয়েছে। সেই ভরসায় এই হোটেলটি বেছে নেই, কেননা ব্রাসেলসসের মত ব্যস্ত শহরে পার্কিংয়ের স্থান পাওয়া বড় সমস্যা। সেদিন ছিল শনিবার, উইকেন্ড, যানবাহন চলাচল কিছুটা কম। চেকইন করার সময় পার্কিংরেইট জানতে চাইলে রিসেপশনে বসা তরুণ জানালে, হোটেলের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ে দুপুর দুটো থেকে রাত নটা পর্যন্ত ২৯ ইউরো অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় সোয়া তিন হাজার টাকা। রাত নটার পর ফ্রি। ‘ইনটুইশন’ বলে একটি কথা আছে। কেন জানি আমার মনে হলো, বাইরে অর্থাৎ হোটেলের সামনে পার্কিংপ্লেসে গাড়ি রাখলে আরো কম বিল আসবে। মোবাইলের পার্কিং এপ্‌ অন করে সেখানেই পার্ক করলাম। রাত এগারটা নাগাদ হোটেলে ফিরে এসে দেখি রাত নটা পর্যন্ত এসেছে মাত্র সাড়ে সাত ইউরো অর্থাৎ প্রায় আট শত টাকা। ডাকাতি আর কাকে বলে!

আগামীকাল সম্মেলন। সম্মেলনের বিষয় ‘মৌলবাদের উত্থান : দক্ষিণ এশিয়া ও বাইরে এর প্রভাব, চ্যালেঞ্জ এবং হুমকি’। বেলজিয়াম ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন, গ্লোবাল সলিডারিটি ফর পিস্‌ এবং সুইজারল্যান্ডভিক্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশএর সহযোগিতায় এই সম্মেলনের আয়োজক ইউরোপভিক্তিক সংগঠন, ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম (ই বি এফ)। সম্মেলনের বর্ণনায় যাবো না। সে সব ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সংবাদাকারে বেরিয়েছে। হোটেল চেকইন করে কামরায় ঢুকে বেশ ভালো লাগলো। বড়সড় ডাবলবেডের রুম। অ্যাটাচড বাথরুম, বাথটাব, বড় গ্লাস, বাথরুমের তাকে বেশ কয়েকটি ধবধবে ছোট বড় সাইজের কয়েকটি তোয়ালে। কামরায় বেড ছাড়াও একটি ছোট সোফা, পাশে কাজ করার জন্যে একটি চেয়ার ও টেবিল, টেবিলের সাথে টেবিল ল্যাম্প, দেয়ালে বড় স্ক্রিনের টিভি, বেডের দুপাশে দুটি ছোট বেডটেবিল, বিছানায় শুয়ে পড়ার উপযোগী ছোট্ট বাতি। এছাড়া বড় একটি টেবিলের ওপর চাকফির সমস্ত উপকরণ। তাতে রয়েছে একটি ওয়াটারকুকার, ছোট আকারের একটি কফি মেশিন, কফি, টিব্যাগ, দুধ, চিনি, মোট কথা সব রয়েছে একটি ছোট্ট পরিবারের দিন দুয়েকের জন্যে। হোটেল কামরায় চা বানানোর জন্যে ওয়াটার কুকার থাকে, কিন্তু কোথায়ও কফি বানানোর মেশিন এর আগে পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। নিচে মাঝারি সাইজের লবি, একপাশে নতুন অভ্যাগতদের জন্যে রয়েছে ‘ওয়েলকাম ড্রিঙ্কস’ লেবুমেশানো পানি। গ্লাসে ঢেলে আপনি চাইলে খেতে পারেন। একপাশে দেয়ালে ছোট্ট একটি কাচের বাক্স। তাতে সাজানো কিছু স্ন্যাকস, ড্রিঙ্কস, ড্রাই ফুড, আপনি চাইলে নিজে খুলে খেতে পারেন। তবে তার জন্যে রিসেপশনে বিল চুকাতে হবে। ভেতরে চমৎকার রেস্টুরেন্ট। সেখানে পরদিন ব্রেকফাস্টসে কথা চেকইন করার সময় কামরায় ঢোকার কার্ড হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো। যখন বললো আগামীকাল রোববার দুপুর বারোটা পর্যন্ত ব্রেকফাস্ট করতে পারবেন, তখন মনে মনে বেশ খুশি হয়েছিলাম। কেন না সকালে উঠার তেমন তাড়া থাকবে না। প্রায় ক্ষেত্রে হোটেলে ব্রেকফাস্ট সকাল দশ কী সাড়ে দশ। এরপর নোব্রেকফাস্ট।

যাই হোক, আমাদের কামরা হোটেলের সাত তলায়। বাইরে কোথায়ও গেলে রুমে ঢুকে প্রথমে যে কাজটি করি তাহলে জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি ছুঁড়ে দেয়া। ভিন শহর অনেক উঁচু থেকে দেখতে ভালো লাগে। শনিবারের ব্রাসেলস অনেকটা নীরব। সাপ্তাহিক ছুটির দিন, তার ওপর হোটেলটির অবস্থান ইউরোপীয় কমিশনের কাছাকাছি বলে এই এলাকাটা হৈ চৈ থেকে কিছুটা দূরে। ইতিমধ্যে মোর্শেদ আর একটি বার্তা পাঠিয়ে জানালে, সে হোটেল পৌঁছুবে ছটা নাগাদ। ভাবলাম, একদিকে ভালোই হলো, ওর দেরিতে আসাতে বাকি কাজগুলি সারা যাবে। ল্যাপটপ অন করে কাজ শুরু করি। সুমনা বিছানায় গা এলিয়ে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। ঘন্টা দুয়েক কাজ করে বিছানায় কেবল গা এলিয়ে দিয়েছি, অমন সময় এলো মোর্শেদের খুদে বার্তা। তাতে লেখা, ‘নিচে লবিতে অপেক্ষা করছি।’ কাপড় চেঞ্জ করে নিচে নেমে এলাম। হাত জোড় করে মোর্শেদ ক্ষমা চাইবার ভঙ্গি করে বলে, ‘শাস্তি যা দেবার দেন। আমার খুব অন্যায় হয়ে গেছে। ‘তোমার কোন ঠ্যাংটা ভাঙবো তাই আগে বলো,’ তাকে বলি। উত্তরে বলে, ‘ঠ্যাং আমার বৌ ভেঙেছে , বাকিটা আপনি ভাঙেন।’ একসাথে বেরিয়ে আসি হোটেল থেকে। আমাদের গন্তব্যস্থল বাংলাদেশী মালিকানায় এক রেস্তোরাঁ। মুর্শেদের চেনাশোনা। এর আগে সপ্তাহ দুয়েক আগে সেখানে লাঞ্চ সেরেছিলাম। ঠিক হলো ওখানেই আজকের ডিনার সারা হবে এবং সেখানে বসে আগামীকালের করণীয় বিষয়গুলি নিয়ে আলাপ হবে। কিছুদূর হেঁটে আমরা বাস নিলাম। গাইড মোর্শেদ। হাসিতামাশায় মাতিয়ে রাখে সবাইকে। তার যে দিকটি ভালো লাগে তা হলো তার বিনয়। আমাদের সবার না হলেও অনেকের মাঝে প্রয়োজনেঅপ্রয়োজনে নিজেকে জাহির করা কিংবা দশজনের সামনে নিজেকে দর্শনীয় করার একটা প্রবণতা আছে। মোর্শেদ যদ্দুর ওকে অল্প দেখায় জেনেছি, চিনেছি মনে হয় কিছুটা ব্যতিক্রম। যে পরিচয়টা তাকে কখনো প্রকাশ্যে সদ্য পরিচিত কারো কাছে দিতে দেখিনি তাহলো, সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদের সহোদর। অথচ দেশে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ছেলে বা ভাইয়ের কথা তো দূরের কথা, দূর সম্পর্কের আত্মীয় হলেও তাদের কী দাপট। মন্ত্রীর ভাগ্নে কেবল এই পরিচয় দিয়ে চেনাশোনা কয়েকজনকে দেখি আখের গোছাতে। মোর্শেদকে প্রশ্ন করে খোলামেলা জানতে চাই। সে বলে, ‘চাইলে আমি অনেক কিছু করতে পারতাম, পারি। আমার কাছে প্রস্তাব এসেছিল টিভি চ্যানেল খোলার ব্যাপারে তদবির করার জন্যে, বোর্ডের চেয়ারম্যান বানাবে এমন কত কী। ওপথ মাড়াইনি। তারপর তার বর্তমান আয়ের হিসাব তুলে ধরে বলে, এই আমার ইনকাম। এতো বছর বেলজিয়াম থেকে আমি এখনো একটা গাড়ি জোগাড় করতে পারিনি। যা আয় করি তার একটা অংশ ব্যয় হয় ব্যাংকের লোন পরিশোধ করতে গিয়ে, আর সামাজিক ও সংগঠনের কাজে।’ অনেকের ধারণা ক্ষমতাবান মন্ত্রীর ভাই, এমন সাধাসিধে জীবন যাপন হতেই পারে না, লোক দেখানো। কিন্তু যতটুকু জেনেছি তাতে মনে হয় মোর্শেদ আদতে নীতিবান। ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ নয়। অনেকের দৃষ্টিতে তার এই বেশিবেশি নীতি মেনে চলা বাড়াবাড়ি, আমাদের সমাজে অচল। সে বলে, আমার জন্যে সমস্যা হয়ে গেছে আমার পরিচয়ের বিড়ম্বনা।

যাই হোক, অনুষ্ঠানের পরদিন মোর্শেদের বাসায় আমরা কয়েকজন দল বেঁধে গিয়েছিলাম তার ও তার স্ত্রী মিলির অনুরোধে। তার যে সাধারণ জীবনযাপন সে সেখানে গিয়ে কতটুকু সত্যি টের পেলাম। ভালো লাগলো এই দেখে মিলির কোন অভিযোগ নেই। অন্তত আমার স্বল্প দেখা ও জানা মতে। কথা প্রসঙ্গে মিলি বলে, বাসা বদল করার জন্যে ভাইয়াও (মন্ত্রী) তাকে বার কয়েক বলেছেন। করবো করবো করছে কিন্তু ঠিকমত পাচ্ছে না, যা পাচ্ছে তা ক্ষমতার বাইরে। মিলি তাগিদ দিলে মোর্শেদ তাকে বলে, তুমি কি চাও আমি দুর্নীতি করি। এ মিলির মুখ থেকে শোনা। আমার বিচার্যে মোর্শেদ কিছুটা খামখেয়ালি, কিছুটা একরোখা, যা ভালো বুঝে তাই, তবে মনটা ভালো। আর ভালো বলে প্রায় সময় ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর’ মত সামাজিক কর্মকান্ড করে বেড়ায়। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে অন্যের উপকার করে বেড়ায়। সম্মেলনের জন্যে মিলি কিছু কেনাকাটা করেছিল। কথা ছিল সে খরচ বহন করবে সম্মেলনের আয়োজকরা। যখন সেই টাকা দিতে গেল মোর্শেদ কিছুতেই নেবে না। জোর করে তার অজান্তে টাকাটা তার পকেটে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। পরে টের পেয়ে সে একবার নয়, বার কয়েক বলে, আমার কাছে কিছু টাকা রয়ে গেছে। উত্তরে বলি, সে যেখানে আছে সেখানেই থাক। অথচ সম্মেলনে আসা আয়োজকদের কেউ কেউ প্রতিটি খরচ গুনে গুনে হিসাব করে নিতে কার্পণ্য করেনি, করে না। সম্মেলনে তার ছেলে, বয়স মাত্র ১৪ রেজিস্ট্রেশনডেস্কে দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি কাজ করেছে। একাই সামাল দিয়েছে সে। এক সময় জিজ্ঞেস করি, তুমি কি ইংরেজি বলতে পারো? উত্তরে নিচুস্বরে বলে, ‘হ্যাঁ, আমি ফরাসি এবং ফ্লেমিশও বলতে পারি।’ শুনে খুব ভালো লাগলো।

(চলবে)

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমার্কিন সরকারের পরিবর্তীত ভূ-রাজনীতি
পরবর্তী নিবন্ধস্মরণে শ্রদ্ধায় স্বাধীনতা সংগ্রামী মানিক চৌধুরী