নির্দিষ্ট সময়ে ঘন্টা বেজে উঠার আগেই কি নিজের ‘ছুটির ঘন্টা’ বাজিয়ে দিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক? চাইলে তিনি আরো মাস কয়েক প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি অনেকটা হুট ও অবাক করে আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন। নির্বাচন হবে চলতি বছরের ৪ জুলাই। মে মাসের ২ তারিখ অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তার দল (টোরি) অনেকগুলি আসন হারালে বিরোধী দল, লেবার পার্টি আগাম জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানাতে থাকে। ক্ষমতায় বসার পর থেকেই ঋষি সুনাক খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। তার মাথার ওপর খড়গ ঝুলে ছিল প্রায় গোটা সময় ধরে। ঘরে–বাইরে তিনি সমালোচনার মুখে। তার জনপ্রিয়তাও অনেকটা তলানীতে, দুদিকেই, ঘরে–বাইরে। এক জরিপে দেখা যায়, তার দল বর্তমানে বিরোধী লেবার পার্টির চাইতে ২০% পেছনে রয়েছে। অর্থাৎ যদি নির্বাচন হয় তাহলে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিব বা টোরি দলের ভরাডুবি হবার সমূহ সম্ভাবনা। বোধকরি তাই অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ক্ষমতা থেকে সরে গিয়ে নির্বাচনের ঘোষণা দেবেন এবং দলের মধ্যে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, যে ভরসায় ঋষি সুনাক আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন তা হলো, সামপ্রতিক দিনগুলিতে বৃটেনের অর্থনীতির কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠা, দেশে বেকার–সংখ্যার নিম্নগতি, অনাকাঙ্ক্ষিত অভিবাসীর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে তার শক্ত অবস্থান ও আফ্রিকীয় দেশ রুয়ান্ডার সাথে এই মর্মে চুক্তি সম্পাদন এবং বাস্তবায়ন। উল্লেখ্য, এই চুক্তির আওতায় যে সমস্ত ইমিগ্রেন্টস বা অভিবাসী অবৈধ পথে বৃটেনে প্রবেশ করবেন তারা যে দেশেরই হোক না কেন তাদের রুয়ান্ডায় (ক্যাম্পে) ফেরত পাঠানো হবে। তবে তার এই ‘রুয়ান্ডা বিলের’ সমালোচনা করে ছায়া (শ্যাডো) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ইভেট কুপার একে ‘চাঁদাবাজির ব্যয়বহুল গিমিক বা কৌশল’ বলে অভিহিত করেন। ঋষি তার এই ‘রুয়ান্ডা চুক্তিকে’ সাফল্য হিসাবে দেখিয়ে বৃটিশ ভোটারদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘লেবার পার্টি যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে তারা এই রুয়ান্ডা বিল বাতিল করবে এবং বৃটেনকে ইউরোপের মধ্যে ‘অবৈধ ইমিগ্রেন্টদের জন্যে স্বর্গ রাজ্য বানাবে এবং দেশকে কম–নিরাপদ করে তুলবে।’ ঋষি সুনাক নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান। কেননা তিনি খুব ভালো করেই জানেন, কেবল বৃটেন নয় গোটা ইউরোপ ‘অবৈধ অভিবাসী’ সমস্যাকে একটি বড় মাথা–ব্যথা হিসাবে দেখে। আপাত:দৃষ্টিতে মনে হয় ঋষি সুনাক এই ‘অবৈধ ইমিগ্রেন্টস বড়ি’ খাইয়ে বৃটিশ ভোটারদের মন জয় করতে চাইবেন। দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তিনি যখন এই আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিচ্ছিলেন তখন অনতিদূরে প্রো–ইউরোপী প্রতিবাদকারীরা মাইক নিয়ে তার বক্তৃতায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছিলেন। বাক–স্বাধীনতার কী অপূর্ব উদাহরণ! সুনাকের আগাম–নির্বাচন ঘোষণার পর বিরোধী লেবার পার্টির নেতা স্যার কিয়ার স্টারমার বলেন, ‘এই নির্বাচনের জন্যে দেশ অপেক্ষা করছে এবং নির্বাচন হলো ভালোর জন্যে পরিবর্তনের সুযোগ।’ অন্যদিকে স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার এসএনপি নেতা জন সুনে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘টোরি দলকে তাড়িয়ে স্কটল্যান্ড ফার্স্টকে সামনে আনার এই সুযোগ এবং এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে আমাদের।’
২) টোরি পার্টি ২০১০ সাল থেকে একটানা তিনবার ক্ষমতায় রয়েছে। হলে কী হবে, দলের নেতৃত্ব নিয়ে রয়েছে টানাহেঁচড়া। বিগত ১৫ বছরের ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রী বদল হয়েছে পাঁচ বার, অথচ হবার কথা ছিল তিন বার। লেবার পার্টি নেতা ও প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের পর ২০১০ সালের মে মাসে ক্ষমতায় এলেন টোরি নেতা ডেভিড ক্যামেরুন। সেই থেকে এখনো ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট রয়েছে টোরি পার্টির দখলে। বিগত ১৫ বছরের টোরি শাসনে যারা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে গদিতে আসীন হন, কিন্তু মেয়াদ শেষ হবার আগেই ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে তারা হলেন, থেরেসা মে, বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত বরিস জনসন, লিজ ট্রাস এবং সবশেষে ঋষি সুনাক (২০২২ সালের অক্টোবর)। দলের নেতৃত্বে কোন্দল, দলীয় রাজনীতি, ল্যাং মারার রাজনীতির কারণে এই ঘন ঘন পরিবর্তন। যার ফলে সাধারণ জনগণের মাঝে টোরি দলের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা কমে আসে। অন্যদিকে এই সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনীতি খুব একটা সবল হতে পারেনি, দেশে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে, বেড়েছে জ্বালানি সহ নিত্যদ্রব্য মূল্য এবং তার ধকল গিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়, তাদের ব্যয় হয়েছে আকাশচুম্বী। সব মিলিয়ে গত ২ মে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে টোরি পার্টির ঘটে ভরাডুবি এবং নিরুঙ্কুশ বিজয় লাভ করে লেবার পার্টি।
এবার একটু পিছু ফিরে তাকানো যাক। দেখা যাক কিভাবে ঋষি সুনাকের উত্থান হলো। দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ঋষি সুনাক হলেন বৃটেনের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী, যিনি ছয় বছরের মধ্যে পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী। অথচ এর আগে ২৮ বছরে মাত্র তিন জন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তারা হলেন, মার্গারেট থেচার, জন মেজর এবং টনি ব্লেয়ার। প্রশ্ন জাগে, এই পরিবর্তন কিসের ইঙ্গিত দেয়? তবে কি ব্রিটিশ রাজনীতিতে এই ‘অস্থিরতা’ নূতন স্বাভাবিক কিছু? এই প্রসঙ্গে বেশ আগে প্রকাশিত ‘দুই মাসে তিন প্রধানমন্ত্রী, রাজনৈতিক অস্থিরতা কি যুক্তরাজ্যের নূতন স্বাভাবিক কিছু?’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে লন্ডনের ইনস্টিটিউট ফর গভর্নমেন্ট নামক থিংক ট্যাংকের জিল রুটারকে উদ্ধৃতি করে লেখা হয়, ‘বিগত ছয় বছর ধরে বৃটিশ রাজনীতিতে বিশেষ করে কনজারভেটিভ পার্টিতে যে অস্থিরতা তার অন্যতম ফ্যাক্টর হলো ২০১৬ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বৃটেনের বেরিয়ে আসা (ব্রেক্সিট)।’ টোরি দলে যখন নেতৃত্বের এই ঘন ঘন পরিবর্তন ও অনিশ্চয়তা সে সময় অনেককে অবাক করে ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর ক্ষমতায় এলেন বৃটেনে জন্ম নেয়া ভারতীয় ধনকুব রামারাও রামায়না মুরতির জামাই হিসাবে পরিচিত ৪২ বছরের বৃটিশ রাজনীতিবিদ, ঋষি সুনাক। বৃটিশ রাজনীতিবিদদের মধ্যে ঋষি সুনাক সব চাইতে ধনী, তার স্ত্রী সুধা মুরতির রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা এবং ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন এমন অভিযোগও তার বিরুদ্ধে এক সময় পত্র–পত্রিকায় এসেছিল। যাই হোক, ঋষি সুনাক পাঁচটি প্রতিশ্রুতি দিলেন– ১) দেশের মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনবেন; ২) অর্থনীতি চাঙ্গা করবেন; ৩) ঋণের বোঝা কমাবেন; ৪) স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ‘ওয়েটিং লিস্ট’ কমিয়ে আনবেন; এবং ৫) শরণার্থী আসা বন্ধ করবেন। সুখের বিষয় যে তিনি বিগত দুই বছরে মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হন। দেশের অর্থনীতিও কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠে, ২০২৩ সালে অর্থনীতি বৃদ্ধি ছিল ০.১%। তবে তিনি যে আশ্বাস দিয়েছিলেন ঋণের বোঝা কমাবেন সেটি হয়নি। খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি স্বাস্থ্য খাতেও। অন্যদিকে, ‘বোট পিপল’ বা নৌকা চড়ে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে বৃটেনে আসা অবৈধ শরণার্থীদের ঠেকাতে তিনি প্রণয়ন করেন ‘রুয়ান্ডা বিল’। সামপ্রতিক সময়ে শরণার্থী আসার সংখ্যা বেশ কমেছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। সেটিকে বৃটিশ জনগণ ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন– টোরি নেতা ঋষি সুনাক কি আসন্ন নির্বাচনে জয়ী হতে পারবেন? স্থানীয় নির্বাচনে তার দলের ভরাডুবি হবার পর, ‘ইপসস’ পরিচালিত এক জরিপে জানা যায়, শতকরা ৭৫% বৃটিশ নাগরিক মনে করেন ঋষি সুনাক জয়ী হবেন না। কেবল ১৪% মনে করেন যে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে থাকার সমূহ সম্ভাবনা তার রয়েছে, অর্থাৎ তিনি জয়ী হবেন। জনপ্রিয়তার বিচার্যে ক্ষমতায় বসার পর এটি তার সবচাইতে খারাপ রেইটিং। এমন কী তার নিজ দলীয় ১০ ভোটারদের মধ্যে ৮ জন মনে করেন তিনি বিরোধী লেবার পার্টিকে হারাতে পারবেন না। তবে তার মানে এই নয় যে, সব ভোটাররা লেবার পার্টি নেতা স্যার স্টারমারকে পছন্দ করেন। কেবল ৩২% জনগণ মনে করেন স্যার স্টারমার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভালো করবেন। শতকরা ৩৬% মনে করেন তিনি সরকার প্রধান হিসাবে ভালো করবেন না। কে ভালো করবেন, কে মন্দ করবেন সেটি নির্ণয় করার আগে দেখা যাক ৪ জুলাই বৃটিশ ভোটাররা এই দুজনের কাকে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে পাঠান। সেটা দেখার জন্যে আমাদের আরো মাস খানেক অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট