গাজা উপত্যকা সহ প্যালেস্টাইনে ইসরায়েলের চলমান নজিরবিহীন আগ্রাসন ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের বড় মদদদাতা যে যুক্তরাষ্ট্র এ কথা নতুন করে বলার প্রযোজন পড়েনা। বিশ্বজুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের মুখেও ডেমোক্র্যাট দলীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তার সরকার ইসরায়েলি প্রধান মন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু ও ইসরাইলের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করার পাশাপাশি সামরিক অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছেন। তার কথা হলো ‘তোরা যে যা বলিস ভাই’ ইসরায়েলের প্রতি আমার অকুন্ঠ সমর্থন থাকবে। যা তিনি ইংরেজিতে বলেছেন ‘আয়রন ক্লেড সাপোর্ট’ অর্থাৎ লৌহ–বর্মের মত এই সমর্থন। কেউ একে ভাঙতে পারবেনা। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এই ‘ব্ল্যাংক চেক’ পাবার কারণে ইসরায়েল বিশ্ব–বিবেক, জাতিসংঘকে এর জন্মলগ্ন থেকে ‘বুড়ো–আঙুল’ দেখিয়ে আসছে। অতি সমপ্রতি দেশ জুড়ে এমন কী নিজ দলের ভেতর তার অনুসৃত নীতির কারণে সমালোচিত বাইডেন সরকার ইসরায়েলে একটি বা দুটি অস্ত্র সরবরাহ চুক্তি স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছেন। এদিকে গাজায় ইসরায়েলের হত্যাকান্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদে মার্কিন সরকার যখন এক প্রকার নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে চলেছে, তখন তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দায় উত্তাল হয়ে উঠেছে কলম্বিয়া, ইয়েল, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় সহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা শিক্ষাঙ্গনে তাবু খাটিয়ে, ক্যাম্পাস দখল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ইসরাইলের সাথে সকল সম্পর্ক বন্ধ করা সহ আর্থিক লেনদেন রয়েছে এমন ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে সরে আসার দাবি জানিয়ে আসছে। শিক্ষার্থীদের দাবি মানার পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে ডেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে শক্তি দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বের করে দেয়া হলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইটে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। গাজার পক্ষে প্রতিবাদ–আন্দোলনে অংশ নেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক শিক্ষক সহ ইতিমধ্যে ২৫০০ বেশি শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। গোটা দেশ জুড়ে এই আন্দোলন ও বিক্ষোভ দমানোর জন্যে বাইডেন প্রশাসন সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে তীব্র বিক্ষোভের মুখে আগামী ১৫ মে অনুষ্ঠিতব্য স্নাতক সমাপনী অনুষ্ঠান বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রতিবাদকারী ছাত্র–ছাত্রীরা ফ্যাশন জগতের ‘মেট গালা’ অনুষ্ঠান–স্থলের বাইরে অবস্থান নিয়ে গাজায় যুদ্ধ বন্ধের দাবি নিয়ে স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে। তাদের স্লোগান ছিল, ‘গাজায় যখন বোমা পড়ছে, তখন মেট গালা হতে পারে না’, ‘স্বাধীনতা ছাড়া কোন উদযাপন নয়’। অনেক বিক্ষোভকারীদের হাতে এই সময় ছিল প্যালেস্টাইনি পতাকা। আপাতদৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের বের করে দেয়া হলেও, আন্দোলন এখন আর কেবল মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সীমিত নেই। এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। আন্দোলন শুরু হয়েছে হল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়েও। এদিকে শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষোভকে খাটো করে দেখানোর জন্যে বাইডেন ও নেতানিয়াহু সরকার এবং আমেরিকায় অতিশয় শক্তিশালী ইহুদি লবি সমানে এই বলে বেড়াচ্ছে যে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন ইহুদি–বিদ্বেষী। অথচ বাস্তবে এই আন্দোলন ও প্রতিবাদের সাথে ইহুদি–বিদ্বেষের কোন সম্পর্ক নেই। শিক্ষার্থীদের এই প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ স্রেফ গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধের আহবান।
২. যুগে যুগে, দেশে দেশে ছাত্র সমাজকে বরাবর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেখা গেছে। যখন রাজনীতি, রাজনৈতিক–নেতৃত্ব দেশে কিংবা দেশের বাইরে ঘটে যাওয়া অন্যায়–অবিচার থামাতে, এমন কী নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়, তখন তীব্র প্রতিবাদের সোচ্চার হয়ে উঠতে দেখা যায় নির্ভিক ছাত্র সমাজকে। সে আমরা দেখেছি বাংলাদেশেও, দেখেছি প্রাক–সত্তর দশকে কীভাবে ছাত্র–আন্দোলন বাংলাদেশকে পরবর্তীতে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করে। দেশের রাজনীতিবিদরা যখন দ্বিধাগ্রস্ত কিংবা ক্ষমতার কারণে আপোষকামিতায় ব্যস্ত, যেমন বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, তখন এই ছাত্র–সমাজই জেগে উঠে, প্রতিবাদের সোচ্চার হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তারা কথা বলে মানবতার পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে, সে নিজ দেশে হোক আর দেশের বাইরে। আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা গাজায় ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদে সোচ্চার। এমনি সোচ্চার ও তীব্র প্রতিবাদে গোটা যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় নেমে এসেছিল মার্কিন ছাত্র সমাজ, ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়। বলা চলে সেই আন্দোলন ছিল রক্তাত ভিয়েতনাম–যুদ্ধের সমাপ্তির শুরু, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘বিগিনিং অফ দ্য এন্ড’। যখন প্রেসিডেন্ট জনসন ১৯৬৫ পরবর্তী সময়ে কম্যুনিজম ঠেকানোর নাম করে ভিয়েতনামে মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতি বৃদ্ধি করেন এবং পাশাপাশি বোমা বর্ষণ শুরু করেন, সে সময় ইতিমধ্যে গড়ে উঠা ছাত্র–আন্দোলনের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, ‘স্টপ ভিয়েতনাম ওয়ার’। ক্ষমতায় এসে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ছাত্র–জনতার যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনকে ঠেকাবার জন্যে এফবিআই ও সিআইএ কে বিশেষ ক্ষমতা দেন। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে ১৯৭০ সালের ৪ মে ভিয়েতনাম যুদ্ধ–বিরোধী বিক্ষোভরত ছাত্র–জনতার ওপর মার্কিন ন্যাশনাল গার্ড গুলি চালালে ওহিওর কেন্ট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ ছাত্র নিহত হন এবং আরো ৯ জন ছাত্র আহত হন। সে সময় যেমন ছাত্র–জনতার বাক–স্বাধীনতা বন্ধ করে দেয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা হয়েছিল, আজ তার ৫০ বছর পর বাইডেন সরকার একই কায়দায় ছাত্রদের বাক–স্বাধীনতা কেড়ে নেবার অপচেষ্টায় লিপ্ত। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে আমরা দেখেছি কীভাবে পুলিশ ৫৮–বছরের এমোরি ইউনিভার্সিটির শিক্ষিকা ক্যারোলিন ফহলিনকে শক্তি প্রয়োগ করে মাটিতে ফেলে গ্রেপ্তার করে। ক্যারোলিন নিজেকে শিক্ষিকা পরিচয় দিলেও পুলিশ তাকে হেনস্তা করতে ছাড়েনি। তারপরও প্রেসিডেন্ট বাইডেন দাবি করেন তার সরকার বাক–স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। অথচ বাস্তবে আমরা দেখছি ভিন্ন চিত্র। ষাট ও সত্তর দশকে ছাত্র–যুবাদের নেতৃত্বে ভিয়েতনাম–বিরোধী আন্দোলন মার্কিনী রাজনীতিতে দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছিল এবং সরকার পতন ঘটিয়েছিল, পাশাপাশি একটি জাতি–রাষ্ট্র হিসাবে ভিয়েতনামের উত্থান ঘটে। ঠিক তেমনি গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা বিরোধী আন্দোলন যা ইতিমধ্যে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, সামনের দিনগুলিতে একটি স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের উত্থান ঘটাবে না তাই বা কে জানে। একই সাথে ইসরায়েলকে তার সমস্ত অন্যায় কর্মকান্ড সত্ত্বেও ‘পার’ পেয়ে যাবার যে অঘোষিত ‘ইম্যুনিটি’ তাও হয়তো তাকে খোঁয়াতে হবে। পাশাপাশি মার্কিন রাজনীতিতে কোন পরিবর্তন আনবে না তাও কিন্তু হলফ করে বলা যাচ্ছেনা। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অনুসৃত নীতির কারণে ইতিমধ্যে ডেমোক্র্যাট দলীয় অনেক সমর্থক ও ভোটার তার দল থেকে তাদের সমর্থন সরিয়ে নেবার ঘোষণা দিয়েছেন। সমর্থন সরিয়ে নেবেন ছাত্র সমাজের বিশাল একটি অংশ, যাদের বাইডেন–সমর্থক হিসাবে ধরে নেয়া হয়। অন্যদিকে রয়েছে বিশাল মুসলিম ভোট ব্যাংক। তারাও তার ওপর থেকে সমর্থন সরিয়ে নেবেন বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। তাতে মার্কিন কিংবা বিশ্ব গণতন্ত্রের লাভ কিছু হবে না বটে, লাভ হবে বাইডেনের প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। এই সমস্ত শংকা যে হোয়াইট হাউসকে একেবারেই তাড়া করছে না তা ভাবার কারণ নেই। আর সে কারণে বাইডেন সরকার গেল সপ্তাহে ইসরায়েলে দুটি অস্ত্র সরবরাহ চুক্তি বাতিল করেছে, ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে যাতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু হামাস–কর্তৃক মেনে নেয়া যুদ্ধ–বিরতি চুক্তি মেনে নেন।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট