আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘বয়স’ বড় ফ্যাক্টর
আর বেশি দেরি নেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। চলতি সালের ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে ঘিরে ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা তুঙ্গে পৌঁছেছে প্রধান দুই প্রার্থীর মধ্যে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী ইতিহাসে দুই প্রার্থী– জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প– হলেন সব চাইতে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট–পদপ্রার্থী। আর সে কারণে আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থীর বয়স একটি বড় ‘ফ্যাক্টর’ হিসাবে দেখা দিয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণাভিযানে প্রার্থীর বয়স একে অন্যকে আক্রমণের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দুজনের বয়স যদিও বা ৭৭ এর ওপর তারপরও বয়সকে ঘিরে আলোচনা ও আক্রমণের শিকার বেশি হচ্ছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তার বয়স এখন ৮১। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বয়স ৭৭, অর্থাৎ তিনি বাইডেনের চাইতে মাত্র ৪ বছরের ছোট। ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারাভিযানে জো বাইডেনের স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে দাবি করে বলেন, ‘তিনি (বাইডেন) আগামী চার বছর দেশ শাসনের উপযুক্ত নন।’ অন্যদিকে, বাইডেন এর প্রতি উত্তরে ট্রাম্প মানসিকভাবে অসুস্থ দাবি করে, তাকে (ট্রাম্প) দেশের গণতন্ত্রের জন্যে হুমকী হিসাবে আখ্যায়িত করেন। মজার ব্যাপার হলো, দুজনের বয়স কাছাকাছি হলেও সাধারণ মার্কিন জনগণ কিন্তু ট্রাম্পের চাইতে বাইডেনের স্মৃতিশক্তি ও বয়স নিয়ে তাদের শংকা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই উদ্বেগ খোদ নিজ দল ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যেও কম নয়। আর এই কারণে বাইডেনকে অনেক আগেই আসন্ন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি। বাইডেন প্রকাশ্যে বেশ কয়েকবার এমন কিছু মন্তব্য ও আচরণ করেন যা দেখে প্রতীয়মান হয় যে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে খুব একটা সুস্থ নেই। গেল বছর এক অনুষ্ঠানে তিনি ইউক্রেন যুদ্ধকে ইরাক–যুদ্ধ বলে উল্লেখ করেন। গেল মাসে ভিন্ন এক অনুষ্ঠানে তিনি ‘সমপ্রতি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন’ বলে বক্তব্য দেন। অথচ ফ্রাঁসোয়া মিতেরা মারা গেছেন ৩০ বছর আগে। অবশ্য তিনি দ্রুত তার ভুল সংশোধন করেন। এছাড়া আর এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মের্কেল ও হেলমুট কোহল এই দুজনকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। একই ধরনের ভুল করেছিলেন মিশর ও মেক্সিকোর প্রেসিডেন্টকে নিয়ে। হতে পারে, এ বড় ধরনের কোন ভুল নয়, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বিশাল ও ক্ষমতাধর দেশের প্রেসিডেন্টের পক্ষে এই সামান্য ভুলও ‘সামান্য’ হিসাবে বিবেচিত হতে পারেনা। আর সে কারণে বেচারা জো বাইডেন যিনি আজীবন দেশের জন্যে কাজ করে গেছেন, বয়সের কারণে যেটির ওপর তার কোন হাত নেই, নিষ্ঠুর সমালোচনার শিকার হচ্ছেন। রয়টার পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, অর্ধেকের বেশি ডেমোক্র্যাক্ট সহ চার ভাগের তিন ভাগ মার্কিন নাগরিক মনে করেন সরকার পরিচালনায় বাইডেন ‘বেশি বয়স্ক’। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেলায় দেখা যায় কেবল এক তৃতীয়াংশ রিপাবলিকান এবং কেবল অর্ধেক মার্কিন ভোটার মনে করেন প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি (ট্রাম্প) বেশ বয়স্ক। ডেমোক্র্যাক্ট ক্যাম্পইন টিম মনে করে, বয়স নিয়ে মিডিয়ার পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। তাদের অভিযোগ, মিডিয়া বাইডেনের বয়সকে সব সময় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে ধরে। সে যাই হোক না কেন মোদ্দা কথা হলো, মার্কিন জনগণ ট্রাম্পের চাইতেও বেশি উদ্বিগ বাইডেনের বয়স নিয়ে।
মূল দুই দলের চূড়ান্ত প্রার্থিতা এখনো ঘোষণা করা না হলেও এটি অনেকটা নিশ্চিত যে জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে হবে আগামী নির্বাচনী লড়াই। শুরুতে ট্রাম্প নির্বাচনে আদৌ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন কিনা এ নিয়ে সন্দেহ ও শংকা ছিল। তার বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত ৬টি ফৌজদারি মামলা ঝুলে আছে। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিল আক্রমণে উস্কানি ও ইন্ধন দেয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ট্যাক্স ফাঁকি, ভুল তথ্য দিয়ে ব্যাংক থেকে বেশি পরিমাণ ঋণ নেয়া সহ আরো কয়েকটি মামলা বিচারাধীন। কেউ কেউ মনে করেছিলেন শেষ তক ট্রাম্প বুঝি নির্বাচনে আইনি লড়াইয়ের কারণে লড়তে পারবেন না। উল্টো, যে নির্বাচনী হাওয়া বইছে তাতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন ট্রাম্প হয়তো দ্বিতীয়বারের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন। তবে সমপ্রতি রয়টার পরিচালিত এক পৃথক জরিপে আসন্ন নির্বাচনে এই দুজনের মধ্যে ‘হাড্ডাহাড্ডি’ লড়াই হবে এবং বাইডেন ৩৯% ভোট পেয়ে ট্রাম্পের (৩৮%) চাইতে ১% ভোটে এগিয়ে থাকবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও বাইডেনের ‘এপ্রোভাল রেইটিং’ কম এবং তাকে তার ভোটারদের আশ্বস্ত করতে হবে যে তিনি দেশ পরিচালনায় শরীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষম। আরো যে কটি বিষয় বাইডেনের জন্যে বড় চ্যালেঞ্জ তা হলো, তার ইমিগ্রেশন পলিসি। তার অনুসৃত অভিবাসী পলিসির কারণে তিনি রিপাবলিকান দলীয় আইনপ্রণেতা ছাড়াও নিজ দলীয় আইনপ্রণেতাদেরও সমালোচনার মুখোমুখি হন। তার সময় মেক্সিকো বর্ডারে সব চাইতে বেশি সংখ্যক অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে যে কারণে সাধারণ মার্কিন নাগরিকরা তার প্রতি বীতশ্রদ্ধ। প্যালেস্টাইন (গাজা) ইস্যুতে ইসরায়েলের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন ও অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ সহ আর্থিক সহযোগিতার কারণে তিনি সমালোচিত হন। গাজায় ইসরাইলের নির্বিচারে শিশু হত্যা সহ গণহত্যার কোন সুরাহা না করে গাজায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাবার জন্যে ইসরায়েলকে ‘ব্ল্যাংক চেক’ দেয়া, জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির জন্যে আনীত প্রস্তাবে ‘ভিটো’ দেয়া সহ অমানবিক পদক্ষেপের জন্যে মিশিগান ও মিনেসোটা সহ বেশ কটি রাজ্যে জো বাইডেন ‘প্রতিবাদ–ভোটের’ সম্মুখীন হবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
আগেই উল্লেখ করেছি আসন্ন নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ী হবার সম্ভাবনা কোনভাবেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। সব সম্ভবের দেশ আমেরিকা। আমেরিকায় সব কিছু সম্ভব। কৃষ্ণাঙ্গ বারাক ওবামাকে যেমন প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হতে দেখেছি, ঠিক তেমনি নানা কারণে বিতর্কিত ও বহু মামলার আসামি হয়েও ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বারের মত নির্বাচিত হবার সম্ভাবনা দেখি। ট্রাম্পের সম্ভাব্য জয়ে মার্কিন জনগণের একাংশ যতটা না চিন্তিত তার চাইতে বেশি চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন ইউরোপ। ট্রাম্প ইতিমধ্যে এই বলে ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি জয়ী হলে ট্রান্স–আটলান্টিক নিরাপত্তা গোষ্ঠী ‘ন্যাটো’ থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনবেন কিংবা ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে চাপ দেবেন যাতে সংস্থাটি পরিচালনায় তাদের দেয়া–চাঁদার পরিমান বাড়ায়। এমনও শোনা যায় যে, যে সমস্ত ন্যাটো–ভুক্ত দেশ ঠিকমত তাদের চাঁদা পরিশোধ করবে না, তিনি সেই সমস্ত দেশ আক্রমন করার জন্যে রাশিয়াকে উৎসাহিত করবেন। ট্রাম্পের প্রাক্তন নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা জন বোল্টন বলেন, ‘আমি মনে করি তিনি সেই চেষ্টা করবেন’। ট্রাম্প ক্যাম্পেইন মুখপাত্র জেসন মিলার বলেন, ‘ডেমোক্রেটসরা ভুলে গেছেন যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ৪–বছরের শাসনামলে দেশে শান্তি ছিল, উন্নতিও হয়েছে, কিন্তু ওবামা–বাইডেনের শাসনামলে ইউরোপ মৃত্যু ও ধ্বংস প্রত্যক্ষ করেছে এবং বর্তমানে বাইডেনের শাসনামলে আরো অধিক মৃত্যু ও ধ্বংস আমরা দেখতে পারছি।’ কথাটা উড়িয়ে দেবার নয়। ট্রাম্প ইতিমধ্যে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছেন। কেবল বেরিয়ে আসা নয়, নির্বাচিত হলে এমনভাবে আইন তৈরি করবেন যাতে ভবিষ্যতে কোন ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে পুনরায় যোগ দিতে না পারেন। যেমনটি করেছিলেন জো বাইডেন। এছাড়া ট্রাম্প নির্বাচিত হলে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তেমনটি হলে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ইউক্রেন যুদ্ধে সম্পূর্ণ বিজয় অনেকটা নিশ্চিত সে কথা বলা বাহুল্য। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ সম্পর্ক সবার জানা। ট্রাম্পকে তার শাসনামলে দেখা গেছে পুতিনকে তুষ্ট রাখতে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ২০১৬ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছে এমন যখন অভিযোগ আনে তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজ গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে না গিয়ে উল্টো বলেন, এই ব্যাপারে তার সন্দেহ রয়েছে। তিনি নিজ দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সমালোচনা করে ২০১৬ নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ তদন্তের সমালোচনা করেন। ‘আনপ্রেডিক্ট্যাবল’ ব্যক্তি হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প পরিচিত। তার পক্ষে সব সম্ভব। ভয়, শংকা সেখানেই। যদি তিনি পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের চেহারা কেমন হবে তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। যেমনটি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় কেমন হবে ইউরোপের গণতন্ত্রের চেহারা। কেমন রূপ ধারণ করবে বিশ্ব রাজনীতি সেটিও।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট