আমার ভালো–লাগার একটি দেশ সুইজারল্যান্ড। ভালো কার না লাগে ! আর্থিক সামর্থ্য আছে যাদের তারা তো ঘুরে–ফিরে আসেন আল্পস পর্বতমালার হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া, পটে–আঁকা ছবির মতো ইউরোপের এই দেশটিতে। একটা সময় এই দেশটিকে কেবল হিন্দী ছবির মধ্যেই দেখতাম, আর মনে মনে ভাবতাম আদৌ কি এই দেশটি কখনো দেখার সুযোগ হবে? সেই সুযোগ প্রথম এলো ১৯৯১ সালের শেষ দিকে, আজ থেকে ৩২ বছর আগে, বেড়াতে নয় অফিসের কাজোপলক্ষে। তখন কেবল বছর খানেক হয়েছে হল্যান্ড এসেছি। একানব্বই সালে বাংলাদেশে সংঘটিত ভয়াবহ বন্যা–পরবর্তী সময়ে আটটি বাংলাদেশী এনজিওর রিলিফ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম মূল্যায়ন করার জন্যে ডাচ উন্নয়ন সংস্থা নভিব, পরবর্তীতে অক্সফাম নভিবের পক্ষ হয়ে বাংলাদেশ যেতে হয়েছিল। সুইজারল্যান্ডের দাতা সংস্থা, সুইস চার্চ এইড (হেকস) যখন জানতে পারলো যে নভিব পরামর্শক হিসাবে বাংলাদেশে একজন প্রতিনিধি পাঠিয়েছে, তখন তারা ভাবলো বাড়তি লোক পাঠিয়ে লাভ কী। যিনি যাচ্ছেন বন্যা–পরবর্তী রিলিফ ও রিহ্যাবিলিটেশন কার্যক্রম মূল্যায়ন করার জন্যে তার থেকে তো এই রিপোর্ট পাওয়া যেতে পারে। তারা চিঠি লিখে জানতে চাইলেন, আমি তাদের সাথে আমার যে ‘ফাইন্ডিংস‘ তা ভাগাভাগি করতে রাজি আছি কিনা। যদি থাকি তাহলে তারা আমাকে আমন্ত্রণ জানাবেন তাদের হেড অফিস জুরিখে যাবার জন্যে। সেখানে হবে সংস্থার প্রধান সুইস মহিলা, মিস ভেরার সাথে মিটিং। হল্যান্ড এসেছি তখনও বছর পেরোয়নি। সুইজারল্যান্ডও যাওয়া হয়নি। তখন ইউরোপ বলতে বেড়াতে কেবল গেছি জার্মানি, বেলজিয়াম আর ফ্রান্সে। ঠিক হলো, ট্রেনে প্যারিস হয়ে সুইজারল্যান্ড যাবো। প্যারিস হয়ে এই কারণে– এক ঢিলে দুই পাখি মারা। সেখানে তখন স্থায়ীভাবে থাকে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগের (ইংরেজি) সতীর্থ, বন্ধু ও সহকর্মী প্রলয় (দত্ত গুপ্ত) এবং বন্ধু ও সহকর্মী নুরু (নুরুল আলম চৌধুরী)। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শেষ করার আগেই আমরা তিনজনেই অনেকটা একসাথে চট্রগ্রাম থেকে অফসেটে প্রকাশিত প্রথম ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা, দি ডেইলী লাইফে যোগ দেই। অনেক বছর পর আবার তিন বন্ধু, সহকর্মীর একসাথে দেখা হবে, অন্যদিকে আমার এই প্রথম সুইজারল্যান্ড যাওয়া, পাশাপাশি কাজের গুরু দায়িত্ব– সব মিলে এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছিল আমার ভেতর। দেশ থেকে এসেই এই ধরনের একটি গুরু দায়িত্ব পাওয়াতে নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবানও মনে হচ্ছিল। প্যারিস ছিলাম দিন দুয়েক। নুরুর ইউনিভার্সিটি হোস্টেলে। প্যারিসের বুকে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষায় সে তখন উচ্চতর পড়াশুনা করছে। প্রলয় নুরু দুজনেই ফরাসি ভাষায় চোস্ত ছিল। বাংলাদেশ থাকতেই তাদের ফরাসি ভাষায় দখল অর্জন। চকবাজার অলি খাঁ মসজিদের কাছাকাছি ফরাসি ভাষা স্কুল, আলিয়ঁস ফ্রসেজ। প্রলয় পড়াশুনা ও ডেইলি লাইফে চাকরির পাশাপাশি সেখানে সন্ধ্যাকালীন শিক্ষক হিসাবে কাজ করতো। নুরু সেখানকার সিরীয়াস এক ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লেখাপড়ার চাইতে ফরাসি ভাষার প্রতি ছিল তার দুর্দান্ত আকর্ষণ ও মোহ, পরে যা তাদের দুজনকে ভালো ‘ডিভিডেন্ড‘ দেয় ক্যারিয়ার গঠনে। যাই হোক–
ঠিক হলো, সুইস দাতা সংস্থা হেকস এর প্রধান আমাকে রিসিভ করতে জুরিখ রেল স্টেশন আসবেন। দেশ থেকে আমার সদ্য আসা। গা থেকে তখনও দেশের গন্ধ যায়নি। ভেবেছিলাম দাতা সংস্থার প্রধান। নিশ্চয় ঠাঁটবাট থাকবে, গাড়ি নিয়ে আসবেন। কিন্তু তিনি যখন সামনে এলেন তখন কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। দেখলাম, হাতে ছোট্ট ছাতা,পরনে স্কার্ট সুদর্শন এক আধ–বয়সী সুইস মহিলা। হাত বাড়িয়ে সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, ‘আমাদের ট্রাম ধরতে হবে‘। বাংলাদেশে কোন দাতা সংস্থা প্রধান এইভাবে আসবেন সে কল্পনাতীত। পরে অবশ্য দেখি, ইউরোপে এই সব কোন ব্যাপারই না। হল্যান্ডের প্রধান মন্ত্রী তো নিয়মিত সাইকেল চালিয়ে তার সরকারি বাসা থেকে পার্লামেন্ট আসেন। আসেন আরো কয়েক মন্ত্রী। মিস ভেরা সহ ট্রাম স্টেশনে অপেক্ষার মিনিট কয়েকের মধ্যে এলো ট্রাম। কয়েক স্টেশন পর এলো হেকস অফিসের কাছাকাছি ট্রাম স্টপেজ। আমরা নেমে পড়লাম। যেতে যেতে ভেরা বললেন, ‘বাংলাদেশ থেকে এক এনজিও–র চীফ এক্সিকিউটিভ এসেছেন। তারাও আমাদের কাছ থেকে অনুদান পান‘ ইত্যাদি ইত্যাদি। ভদ্রলোকের সাথে তখনও আমার পরিচয় ঘটেনি, দেখা হয়নি, তার সাথে আমার চেনা–জানাও নেই। পরদিন সকালে হোটেলের একেবারেই সামনে স্টপেজ থেকে ট্রামে উঠতে গিয়ে দেখি আমার মত গায়ের বর্ণ এক ভদ্রলোক, দেখে মনে হলো বাংলাদেশী, আমার পাশে দাঁড়িয়ে। তিনি এগিয়ে এসে অতি বিনয়ের সাথে বললেন, ‘আপনি এসেছেন শুনেছি। আমাদের ব্যাপারে একটু সুপারিশ করবেন।‘ সেই ভদ্রলোক এবং তার সে সময়কার ছোট প্রতিষ্ঠানটি এখন বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। তার প্রতিষ্ঠানের নামে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। প্রশিকা বিশ্ববিদ্যালয়। সে এক বিশাল যজ্ঞ। পরবর্তীতে কৌতুক করে এক বন্ধুকে বলেছিলাম, ‘নব্বইয়ের শুরুতে প্রশিকার স্থপতি ফারুক আহমদ চৌধুরী তার সংস্থার জন্যে আমাকে সুপারিশ করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এখন তার অবস্থান এমন পর্যায়ে যে তার সাথে দেখা করতে চাইলেও আমাকে হয়তো অনেক বেগ পেতে হতে পারে।‘ তার এই বিশাল ও অবিশ্বাস্য সাফল্য খুব ভালো লেগেছিল। ইতিমধ্যে, মিস ভেরার সাথে তার অফিসে মিটিং হলো। দেশে গিয়ে কী দেখেছি, ব্র্যাক, প্রশিকা, উদ্দীপন ইত্যাদি সহ মোট আটটি বাংলাদেশী এনজিওর কার্যক্রম সরজমিনে দেখে কী রিপোর্ট করেছি তা নিয়ে আলাপ–আলোচনা হলো। পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয় এই তো সেদিন, অথচ কত কিছু হয়ে গেলো। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে কয়েকটি দশক। সময় কত দ্রুত এগিয়ে যায়, রেখে যায় স্মৃতি, আর নিয়ে যায় মানুষ, চিরতরে, না–ফেরার দেশে। এটিই নিয়ম। কিন্তু এই নিয়মকে ‘মেনে নেয়া আর মনে নেয়া‘ (কবিগুরু থেকে ধার করা শব্দ) দুটোই কঠিন। কোথা থেকে কোথা চলে এলাম। শুরু করেছিলাম আল্পস পর্বত মালাকে নিয়ে। সুইজারল্যান্ড প্রসঙ্গ এলেই আসে ‘আল্পস পর্বতমালা‘। মজার ব্যাপার হলো, অনেকে মনে করেন আল্পস কেবল সুইজারল্যান্ডেই। আসলে তা নয়। হিমালয় পাহাড় যেমন কয়েকটি দেশের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে, যেমনটি সাহারা মরুভুমি কয়েকটি আফ্রিকীয় দেশের ভেতর অবস্থিত, ঠিক তেমনটি আল্পস পর্বতমালা সুইজারল্যান্ড ছাড়াও দাঁড়িয়ে আছে অস্ট্রিয়া, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, স্লোভেনিয়া, লিঙটেনটাইন এবং মোনাকোয়। এই সমস্ত দেশগুলির মধ্যে আল্পস পর্বতমালার সব চাইতে বড় অংশ হলো অস্ট্রিয়ায় (২৮,৭%) ভাগ, ইতালিতে (২৭,২%), ফ্রান্সে (২১,৪%), জার্মানিতে (৫,৮%) ভাগ। অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডে পড়েছে মাত্র ১৩,২% ভাগ। সব চাইতে কম অংশ পড়েছে মোনাকোতে, মাত্র ০,০০১% ভাগ। স্লোভেনিয়ায় ৩,৬% এবং লিক্সটেনটাইনে ০,০৮% ভাগ। যদ্দুর জানি, সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্ন হলো আল্পস পর্বতমালার সব চাইতে কাছের শহর। আল্পস দেখতে চাইলে আপনাকে ট্রেন বা ক্যাবল–কারে যেতে হবে। আমার সে সুযোগ এখনো হয়ে উঠেনি, কেবল সময়ের অভাবে।
আগেই বলেছি সুইজারল্যান্ড আমার ‘থার্ড হোম‘, যদি হল্যান্ডকে ‘সেকেন্ড হোম‘ ধরি। ফার্স্ট হোম তো আমার দেশ, বাংলাদেশ। হল্যান্ড আছি দীর্ঘ ৩৩ বছর। সুইজারল্যান্ড বছরে কম করে হলেও দু–থেকে তিনবার যাওয়া হয়। তাই তাকে থার্ড হোম বলি। তবে ক‘বার গেলাম সেই বিচার্যে নয়। ভালো লাগে তাই। কমফোর্ট ফিল করি, বিশেষ করে জেনেভায়। ছোট্ট শহর। ভালো লাগে একা ট্রাম বা বাসে চড়ে ঘুরতে পারি বলে, গাইড বা স্থানীয় সঙ্গীর প্রয়োজন হয়না বলে। যেখানে যাবেন তার ঠিকানা জানা থাকলে সহজে পৌঁছে যেতে পারবেন কোন সমস্যা ছাড়াই। তার ওপর, হোটেলে অবস্থান করলে যেদিন থেকে চেক–ইন করবেন সেদিন থেকে হোটেল থেকে পাবেন পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়ার বিনে পয়সার টিকেট। যতদিন হোটেলে থাকবেন ততদিন এই সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। এমন সুযোগ পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে কি ? আমার জানা নেই। হোটেল যদি আগেভাগে অনলাইনে বুকিং দিয়ে থাকেন তাহলে আপনি চাইলে সেই টিকেট আগবাড়িয়ে আপনার ইমেইলে ওরা পাঠিয়ে দেবে। ফলে জেনেভা এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে যে কোন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, বাস কিংবা ট্রেন ধরে আপনি সহজেই পৌঁছে যেতে পারবেন জেনেভা সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশন। জেনেভা এয়ারপোর্টের আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ে প্লাটফর্ম থেকে জেনেভা–গামী যে কোন ট্রেনে চড়ে বসলেই হলো। পরবর্তী স্টেশন জেনেভা রেলস্টেশন। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আপনি পৌঁছে যাবেন জেনেভা। এই সব মিলে ভালো লাগে জেনেভা। স্টেশন–লাগোয়া আমার ‘পার্মানেন্ট‘ আটতলা হোটেল, ‘হোটেল ক্রিস্টাল‘। ভাড়া একটু বেশি বটে। কিন্তু একেবারে শহরের মধ্যিখানে। হাত বাড়ালেই সব। হোটেল থেকে বেড়িয়ে মিনিট তিনেক হাঁটলেই, ‘সাজনা‘। বাংলাদেশী মালিকানায় ভারতীয় রেস্টুরেন্ট। এর মালিক বন্ধু খলিলুর রহমান। অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে নিবেদিত এক প্রাণ। দেশের সাথে তার রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ। দেশ থেকে বছরের গোটা সময় ধরে জেনেভায় নানা কাজে, সম্মেলনে আসেন মন্ত্রী, সরকারি উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিবর্গ। তাদের অনেকেই বেছে নেন এই রেস্টুরেন্ট, তাতে বাংলাদেশী খাবার মেলে, মেলে দেশীয় আপ্যায়ন, আন্তরিকতা। দু–কামরার মাঝারি সাইজের এই রেস্টুরেন্টের ভেতরের দিকটায় যে কামরা তার একদিকের দেয়ালে টাঙানো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বড় ছবি। জেনেভা এলে যে ক‘দিন থাকি প্রতিদিন এখানে আসা চাই। বাইরের ডিনার পার্টি (কাজোপলক্ষে) না থাকলে এখানেই সাধারণত হয় রাতের খাওয়া। জোর করে খাবারের বিল দিতে হয়। আসার সংবাদ পেয়ে পরিচিত যে ক‘জন আছেন স্থায়ীভাবে, তাদের কেউ কেউ আসেন। চলে আড্ডা। খাওয়া দাওয়া। এর চাইতে আরো বড় একটি পাওয়া তা হলো জেনেভায় রয়েছে আমার ছোট্ট দুই বন্ধুনি। ভাগ্নী রিমি ও তার স্বামী সসীমের দুই মেয়ে– এলিনা ও রিয়ানা। ফুটফুটে মিষ্টি মেয়ে দুটি তাদের বাসায় না যাওয়া পর্যন্ত অনবরত ফোন করতে থাকে, ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলে, ‘দাদু, তুমি কবে আসবা, আমরা অপেক্ষা করছি‘। জেনেভা গেলে বরাবর হোটেলে থাকি, তাই তাদের কাছে আমি ‘হোটেল দাদু‘। ওদের বাসায় যাবার সময় না থাকলেও সময় করে নিতে হয়। ওরা যেতে বলে কেবল সে জন্যে নয়। আমার ইচ্ছেরও কমতি নেই, সেই কারণে। ওদের না দেখে হল্যান্ড ফিরে আসার কথা ভাবতেও পারিনা। আর ওদের বাসায় গেলে রিমি–সসীমের রান্না করা টেবিল–ভর্তি শুঁটকি, গো–মাংস থেকে শুরু করে হরেক পদের মুখরোচক খাবার। এরপরও সুইজারল্যান্ড ভালো না–লাগার কোন কারণ থাকতে পারে বলে আমার জানা নেই।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক