(২য় পর্ব)
জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের ৫৪তম অধিবেশন চলাকালীন বাংলাদেশে একাত্তরের জেনোসাইড বিষয়কে ঘিরে আয়োজিত সম্মেলনে যা ‘সাইড ইভেন্ট’ হিসাবে পরিচিত নামিদামি বক্তার কমতি ছিল না। কিন্তু সবাইকে ছাড়িয়ে নজর কেড়ে নিলেন হল্যান্ড থেকে আসা পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত পাকিস্তানি তরুণী আলিনা খান। পাকিস্তানি নাগরিকের দৃষ্টিতে ‘বাংলাদেশ গণহত্যা’ কেমন তা জানতে বা শুনতে সবার ছিল বাড়তি আগ্রহ। আমার দশাও ভিন্ন নয়। এখন তার মুখ থেকেই শুনি তিনি কী বললেন। চমৎকার ইংরেজি উচ্চারণে আলিনা খান তার বক্তব্য শুরু করেন এই বলে, ‘একজন তরুণ শিক্ষাবিদ হিসেবে, আমি আপনাদের সবার সাথে কথা বলতে পেরে সম্মানিত। এই বিষয়ের সাথে আমার সংযোগের কিছুটা পিছনের গল্প বলতে গেলে বলতে হয়, আমি একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত আমেরিকান। আমার বাবা–মা উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানি অভিবাসী ছিলেন এবং সেখানেই আমার জন্ম। আমার মা পাকিস্তানে পুরোপুরি পাকিস্তানি–শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়েছিলেন, বিশেষ করে ‘সংঘাতের’ সময়। অতএব বলা যায় তিনি শুধুমাত্র সেই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানি দৃষ্টিকোণ থেকে সংঘাতের গল্প শুনেছিলেন। আলিনা বারবার ‘সংঘাত’ বলতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে উদ্ভুত পরিস্থিতির কথাই বুঝাতে চাইছিলেন। যখন আমি মাস্টার্সের থিসিসের জন্য গবেষণা শুরু করি, তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে তিনি সে সময়কার ঘটনা সম্পর্কে কী জানেন, তিনি কেমন অনুভব করেছেন এবং গোটা বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন। উত্তরে আমার মা বলেছিলেন, গণহত্যাসহ সংঘাতের সময় ঘটে যাওয়া প্রকৃত ঘটনাগুলি সম্পর্কে যখন তিনি যখন প্রথম জানতে পেরেছিলেন তখন তিনি একজন পাকিস্তানি হিসাবে লজ্জিত হয়েছিলেন।
পাকিস্তানি এই তরুণীটি বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে উচ্চতর পড়াশুনা করতে কেন আগ্রহী হলো এই প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন, ‘তাহলে তো একটু পিছিয়ে যেতে হয় আমাকে। হল্যান্ডের আমস্টারডাম ইউনিভার্সিটির ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ, সংঘাত এবং অপরাধবিদ্যার’ মাস্টার্সের ছাত্র হিসাবে এই বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল। এই নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত সংঘাত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার পর সত্যি বলতে কী কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ি এই কারণে, দেখলাম দক্ষিণ এশিয়ার সংঘাত বলতে কেবল শ্রীলংকা ও এলটিটি (তামিল) উপর তথ্য আছে। আমি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত সম্পর্কে কিছুটা জানতাম। আমি চেয়েছিলাম দক্ষিণ এশীয় সমাজের সাথে প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় নিয়ে লিখতে, গবেষণা করতে। তাই ঠিক করি একাত্তর সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর কাজ করাই উত্তম হবে। সে ভাবেই একাত্তরকে আমার জানা। এই প্রসঙ্গে আলিনা খান জানান, তিনি তার গবেষণার অংশ হিসেবে, সহিংসতা ও রক্তপাতের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশিদের সঙ্গে সংঘাত ও গণহত্যা নিয়ে আলোচনা করার জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় করেন। ‘আমি প্রাপ্তবয়স্কদের গল্প শুনেছি যারা শিশু হিসেবে তাদের বাবা–মাকে খুন হতে দেখেছেন। আমি এমন লোকদের গল্প শুনেছি যারা খুন হওয়া এড়াতে তাদের গ্রাম থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। আমি এমন গল্পও শুনেছি যা আমি কখনও শুনতাম না, যদি আমি এই বিষয়ে গবেষণার উদ্যোগ না নিতাম। অবাক হয়ে দেখলাম আমার দেশে নিজ সমপ্রদায়ের মধ্যে বৃহৎ অংশ এই ব্যাপারে কিছু জানেন না। একাত্তরে বাংলাদেশে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে তাদের কখনো জানানো হয়নি।’ একাত্তরের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রসঙ্গে এই তরুণ শিক্ষিকা বলেন, ‘একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্যক্তি হিসেবে শান্তি ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন এবং তা আমি আংশিকভাবে আমার কর্তব্য বলে মনে করি।’
জাতিসংঘের সদর দফতরে সে দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ সুফিউর রহমান, প্রাক্তন ডাচ পার্লামেন্ট সদস্য হ্যারি ফান বোমেল, বৃটিশ সাংবাদিক ও ই ইউ টুডে–র প্রকাশক গেরি কার্টরাইট, প্যারিস থেকে আসা বেলুচ ভয়েস এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মুনির মেঙ্গেল, ইউনাইটেড কাশ্মীর ন্যাশনালের চেয়ারম্যান সর্দার শওকত আলী কাশ্মীরি ও জার্মানি থেকে আসা গবেষক সাংবাদিক ড. হোসাইন আবদুল হাই। যেমনটা অনুমান করা হয়েছিল তার চাইতে অনেক বেশি লোকের উপস্থিতি ছিল এই সাইড ইভেন্টে। অনুষ্ঠানে দেখা হলো বাংলাদেশী কূটনীতিক সঞ্চিতা হকের সাথে। তিনি সুইজারল্যান্ড বাংলাদেশ দূতাবাসের উপ–প্রধান। তার সাথে আগ থেকেই জানাশোনা ছিল। অনুষ্ঠানের আগের দিন দূতাবাসে তার সাথে অনুষ্ঠান ও আলোচনার বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হয়েছিল। আলাপ হয়েছিল একই দিন রাষ্ট্রদূতের সাথে, তার অফিসে। কথা ছিল ক্ষণস্থায়ী হবে সে আলাপ। তা গড়ালো সোয়া এক ঘন্টায়। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত মূল বিষয়ের উপর জোরালো বক্তব্য রেখেছিলেন। ডাচ রাজনীতিবিদ হ্যারি ফান বোমেল বরাবরের মত আকর্ষণীয় বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি চলতি বছর তার বাংলাদেশ সফরের উপর লদ্ধ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন। চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় ৯০ বছরের এক বৃদ্ধার মুখ থেকে একাত্তর সালে পাক হানাদার বাহিনীর বিভীষিকার কাহিনী শোনার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন হ্যারি ফান বোমেল। উল্লেখ করা যেতে পারে, চলতি বছরের মে মাসে হ্যারির নেতৃত্বে ৫ সদস্যের এক ইউরোপীয় ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং টিম বাংলাদেশে গিয়েছিল একাত্তরের জেনোসাইড সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ও তথ্য, প্রমাণাদি সংগ্রহ করার জন্যে। ডাচ এই সিনিয়র রাজনীতিবিদ এই বলে তার দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, বিশ্বকে একাত্তর সালে বাংলাদেশে ঘটিত জেনোসাইডের স্বীকৃতি দিতেই হবে।
এই ধরনের অনুষ্ঠানে গেলে বাড়তি লাভ যা হয় তা হলো অনেক দিনের অদেখা অনেকের সাথে দেখা হয়, হয় আলাপচারিতা। দীর্ঘস্থায়ী হয়না সে আলাপ, তারপরও ভালো লাগে। অনুষ্ঠান শেষে দুপুরের ‘কুইক লাঞ্চের’ ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কফি, স্যান্ডুইচ খেতে খেতে কথা হয় সেখানে সদ্য পরিচিত কারো কারো সাথে। পরিচয় হলো রাষ্ট্রদূতের সাথে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আসা গোটা টিমের সাথে। এক ভদ্রলোক, গায়ের বর্ণ শ্যামলা, বেঁটে খাটো নিজের বিজনেস কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললেন, তিনি এসেছেন শ্রীলংকা থেকে, পার্লামেন্ট সদস্য। তাকে ধন্যবাদ জানালাম অনুষ্ঠানে আসার জন্যে এবং সহমর্মিতা জানানোর জন্যে। প্রায় জনা দশেক শ্রীলংকান উপস্থিত ছিলেন ওদিনের অনুষ্ঠানে। হ্যারি সহ হল থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে যেখানে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলির পতাকা উড়ছে আমরা কজন সেখানে জড়ো হলাম। বেশ কিছু ছবি তোলা হলো। হ্যারির সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার নিলো জার্মানি থেকে আসা সাংবাদিক রুমা। জাতিসংঘের গেইট গলিয়ে রাস্তা পার হয়ে ‘ব্রোকেন চেয়ারের’ সামনে এসে দেখি একদল বাংলাদেশি নাগরিক প্রতিবাদ সভায় (ডেমোনেস্ট্রেশন) তাদের ভাষায় বাংলাদেশে বিএনপি–জামাতের সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার অভিযোগ এনে তাদের রাজনীতি বন্ধ করার দাবি জানিয়ে চলেছেন।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক