কিছু কিছু মানুষের কিছু আকাঙ্ক্ষা, সাধ, ইচ্ছে থাকে যা তা যখন প্রকাশ পায় তখন আমাদের অতি স্বাভাবিক দৃষ্টিতে অবাক লাগে। আমাদের খানিকটা ভাবিয়ে তোলে। এই আকাঙ্ক্ষা, সাধ বা ইচ্ছের সৃষ্টি যেমন ভালোবাসা থেকে, ঠিক তেমনি ভালোবাসার উল্টো–পিঠে যে ঘৃণা আছে তা থেকেও হয়। লেখক গীতিকার হুমাযুন আহমদ তার এক নাটকে গানে গানে তার শেষ ইচ্ছেটা জানান দিয়েছিলেন এই ভাবে, “ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়/ চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়।” জানিনে হুমায়ুন আহমদের এই শেষ ইচ্ছে পূরণ হয়েছিল কিনা, কেননা যেদিন তিনি মারা গেলেন সেদিন চাঁদনি রাত ছিল কিনা আমার জানা নেই। চাঁদনি রাতকে ভালোবেসে তিনি তার শেষ ইচ্ছের কথা লিখেছিলেন। আজ লিখবো এমন এক অনন্য ব্যক্তির শেষ–ইচ্ছের কথা যিনি বাংলাদেশকে ভালোবেসে, বাংলাদেশের জনগণের ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে মৃত্যুর পর তার জন্ম–নেয়া নিজ দেশ পাকিস্তানে নয়, পরদেশ বাংলাদেশের মাটিতে সমাহিত হতে চেয়েছেন। কী তীব্র ঘৃণা জন্মালে একজন নাগরিক তার মাতৃভূমিতে নয়, ভিন্ন দেশে তার যেন কবর সে ইচ্ছে লালন করেন। তার সেই দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবের মুখ দেখতে শুরু করেছে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, ধর্ণা দিতে হয়েছে অনেকের কাছে, বাংলাদেশে এবং প্রবাসে। জন্মভূমি পাকিস্তানের প্রতি তার ভালোবাসা উবে যায় একাত্তর সালে যখন তিনি কলেজের ছাত্র। একাত্তর সালে খোদ পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে বাস করে বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদ ও নিন্দা করা প্রচন্ড সাহসের প্রয়োজন। পাক সামরিক বাহিনীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সেদিনকার তরুণ আসিফ সাকার, আজকের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সেই সময় বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশে হানাদার পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও বিভীষিকাময় কাহিনী পড়ে, শুনে তিনি প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন পাকিস্তানের মাটিতে। সে কারণে তিনি শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন এবং জেল খেটেছিলেন। দীর্ঘ ছয় মাস তাকে পাকিস্তানের ‘কনডেমন্ড সেলে’ রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন ইউরোপীয় দেশ সুইডেনে। এখন তার বয়স ৭৫ পেরিয়েছে।
দিন দুয়েক আগে। তখনও বিছানা ছাড়িনি। ওই সময় আর দশজনের ঘুম ভাঙার সময় পেরিয়ে গেলেও আমার নিত্যদিনকার মত ভাঙেনি। বেজে উঠে টেলিফোন। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ফোনে চোখ বুলাতেই দেখি সুইডেন থেকে ফোন করেছেন জাষ্টিস আসিফ সাকার। ‘হ্যালো’ বলার সাথে সাথেই ওদিকে থেকে তিনি বলে উঠেন, ‘মিঃ বিকাশ প্লিজ ডোন্ট কাট দ্য লাইন’। ওনার আশংকা আলাপ কিছুদূর এগুতেই না জানি আমি বরাবরের মত বলে বসি, সংক্ষিপ্ত করো। কেননা উনি যখন ফোনে কথা বলেন তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। ভদ্রলোক অবসরে আছেন, বিরামহীন তার বিরাম। জেনে খুশি হবে যে বাংলাদেশ সরকার আমার আবেদনে সাড়া দিয়ে মৃত্যুর পর আমাকে বাংলাদেশের মাটিতে কবর দেবার জন্য স্থান বরাদ্দ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুইডেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেহেদী হাসান ফোন করে আমাকে সে বার্তা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ যে তিনি আমার আবেদনে সাড়া দিয়েছেন। আমার আবেদনে তিনি ব্যক্তিগত আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তারপর বলেন, পাশাপাশি আমি কৃতজ্ঞ মাহফুজার প্রতি। মাহফুজা ঢাকায় আমার জন্যে এই নিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছেন। মাহফুজা জেসমিন সিনিয়র সাংবাদিক, ঢাকায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) প্রাইম মিনিস্টার শেখ হাসিনার ১০ বিশেষ উদ্যোগের ফোকাল পয়েন্ট অফিসার। ‘আমি মরেও শান্তি পাব কেননা আমার এতদিনের স্বপ্ন পূরণ হলো’, বললেন এই বৃদ্ধ পাকিস্তানী নাগরিক যিনি বাংলাদেশ সরকার থেকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে ২০১২ সালে ‘ফ্রেন্ড অব বাংলাদেশ’ পদক গ্রহণ করেন। তিনি গিয়েছিলেন বাংলাদেশে সেই পদক নেবার জন্যে। জাস্টিজ আসিফ সাকার আর একজনের কাছে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি হলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা লেঃ কর্নেল সাজ্জাদ আলী জহির।
গেল বছর তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানিরা আমাকে ঘৃণা করে কেননা আমি পাকিস্তানি নাগরিক হয়েও একাত্তরে দেশে এবং এরপর বিদেশ এসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ করে আসছি। আমার প্রতি তাদের ঘৃণা সে বুঝতে পারি। তারপরও সেটি আমার জন্যে কষ্টকর ছিল। কেননা আমি তো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিছু বলিনি। আমি কেবল একাত্তর সালে পাক সরকার ও পাক সেনাবাহিনীর অত্যাচার, হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। কিন্তু তার চাইতেও বড় কষ্টকর ছিল যে বাঙালিরাও আমাকে এই বলে ঘৃণা করতে শুরু করলো যে, ‘তুমি এক নিষ্ঠুর পাঞ্জাবী’। আমি তাদের বুঝাতে পারছিলাম না যে আমি নিষ্ঠুর বা বর্বর পাঞ্জাবী নই। তোমাদের জন্যে আমি কষ্ট, শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেছি। পাকিস্তানে আমি চিহ্নিত হলাম ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসাবে। আমি এক ধরনের গ্লানিতে ভুগছিলাম। অবশেষে এই নরক যন্ত্রনা থেকে আমার মুক্তি এলো ২০১২ সালে, যখন বাংলাদেশ সরকার আমাকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়, স্বীকৃতি দেয় ‘বাংলাদেশের বন্ধু’ হিসাবে। সেই সফরে বাংলাদেশের জনগণের ভালোবাসা ও আন্তরিকতায় তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। ঢাকার বেশ কটি টিভি চ্যানেল ও পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। ‘পাঞ্জাবি হবার কারণে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে যে ঘৃণা আমি পেয়েছিলাম, তা এই অমূল্য পুরস্কারের মধ্যে দিয়ে শেষ হলো। এখন আমি বিদেশের মাটিতে যেখানে যাই, সেখানে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা ভালোবাসা পাই,’ বলতে বলতে পাকিস্তানী এই বৃদ্ধ বিচারপতি কিছুটা আবেগপ্লুত হয়ে পড়েন।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আসিফ সাকারের সাথে আমার পরিচয় বছর দেড়েক আগে। প্রথমে ফোনে যোগাযোগ, এরপর গেল বছর ২০২২ সালে জেনেভায় জাতিসংঘ ভবনে একাত্তরের জেনোসাইড নিয়ে এক সম্মেলনে প্রথম দেখা। সেই অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল অন্যতম বক্তা হিসাবে। পাকিস্তানী নাগরিক হয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার ও পাক–সেনাবাহিনীর অত্যাচার এবং তার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অত্যাচারের কাহিনী তিনি যখন বর্ণনা করছিলেন তখন উপস্থিত সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। অনুষ্ঠানের পর তাকে ঘিরে কথা বলা ও ছবি–তোলার হিড়িক পড়ে যায়। সুইডেনে ১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন সুদর্শন এই বাংলাদেশ–প্রেমিক জাস্টিজ সাকার। সেখানেই সুইডিশ মহিলা আন ক্রিস্টিনাকে বিয়ে করে সে দেশে থিতু হন। স্ত্রীও পেশায় আইনজ্ঞ। দেখতে সুদর্শন, পরনে স্যুট, মাথাভর্তি চুল, দু–হাতের আঙুলে বেশ কটি আংটি। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলেন। দেখে শ্রদ্ধা জাগে। ডায়াবেটিস সহ নানা ব্যাধির কারণে বয়সের তুলনায় একটু বেশি বুড়ো মনে হয়। কদ্দুর হাঁটতে গেলে কাহিল হয়ে পড়েন। গায়ের বল নেই কিন্তু মনের বল এখনো ষোলো আনা অটুটু। লেখালেখি করতেন এক সময় প্রচুর। তার লেখা প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৪টি। পাকিস্তানে যান মাঝে মধ্যে। বাংলাদেশে যাবার খুব ইচ্ছে। বিশেষ করে, তার কবরের জন্যে স্থান বরাদ্দ করার সংবাদ পাবার পর থেকে সে ইচ্ছে ও আগ্রহ আরো বেশি বেড়েছে বলে ফোনে জানালেন জাস্টিজ আসিফ সাকার।
বয়োবৃদ্ধ এই পাকিস্তানি কবিও। তার লেখা পাঞ্জাবি কবিতার জন্য তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। সুইডিশ ভাষায় দক্ষ এই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুইডিশ ভাষায় এক গুচ্ছ কবিতাও প্রকাশ করেন। এই বিষয়গুলি তার লেখা ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত বই, ‘প্যান্ডোরা বক্স’–এর মুখবন্ধে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলোসফি বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ড. নাঈম আহমদ উল্লেখ করেন, সে কথা গেল বছর এই কলামে লিখেছিলাম। তার লেখা আর একটি বই ‘ফরবিডেন ওয়ার্ডস’–এর মুখবন্ধে প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক ও লেখক কুলদীপ নায়ার লিখেছেন, ‘তাকে (প্রাক্তন বিচারপতি সৈয়দ আসিফ সাকার) আমি চিনি তিন দশক ধরে এবং নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, কোন ভয়–ভীতি ছাড়াই যা সঠিক তা বলার জন্যে তার আবেগ ও সাহস রয়েছে। যে অকপটতা এবং সাহসের সাথে তিনি লিখেছেন তা কেবল পাঞ্জাবিদের মধ্যেই নয়, অন্যান্য সমপ্রদায়ের মাঝেও ভালবাসা, প্রশংসা কুড়িয়েছে।’ জেনেভায় অনুষ্ঠান শেষে হুইল চেয়ারে তিনি বসে। এয়ারপোর্ট যাবেন, তাড়া আছে। অনেকেই অপেক্ষমান। তাদের কেউ কেউ তাকে নিয়ে ছবি তুলবেন, কিংবা অটোগ্রাফ নেবেন। সবাইকে দাঁড় করিয়ে ব্যাগ থেকে দুটি বই বের করে তাতে অটোগ্রাফ দিয়ে তিনি আমার হাতে গছিয়ে দেন। পরে ফোনে বলেন, ‘মিঃ বিকাশ, কথা দাও, তুমি বন্ধু হয়ে থাকবে আমার বাকি জীবন অবধি।’ তাকে আস্বস্ত করি এই বলে, ‘তোমার মতো অকৃত্রিম বন্ধু পেয়ে কেবল আমি নই, গোটা বাংলাদেশ ধন্য ও গর্বিত। তোমাকে স্যালুট করি।’ দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, বিদেশী নাগরিক হয়ে আসিফ সাকার যখন এই ভূমিকা নিয়েছিলেন এবং এখনো বাংলাদেশ একাত্তর সালে সংঘটিত জেনোসাইড নিয়ে প্রতিবাদ করে চলেছেন, সেই সময় বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও আমাদের অনেকেই বাংলাদেশকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারিনি, হাত মেলাই সেই অশুভ পরাজিত শক্তির সাথে যারা বাঙালির অগ্রগতিকে পিছু টেনে ধরার লক্ষ্যে এখনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
বাংলাদেশ–প্রেমিকের শেষ ইচ্ছে পূরণে সামান্য ভূমিকা রাখতে পেরেছি বলে মনে মনে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করছি। আজকের লেখা শেষ করবো এই কাহিনীর শুরুর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে। প্রায় এক দশকেরও বেশি আগে জাস্টিজ আসিফ সাকার সুইডেনে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে আবেদন জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে, তাকে যেন বাংলাদেশে সমাহিত করা হয়। কিন্তু সেই আবেদনের ভাগ্যে কী ঘটেছে সেই সম্পর্কে তিনি আর কিছুই জানতে পারেননি। সে সময় যোগাযোগ করলে সুইডেনের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে বলা হয় তার আবেদন ঢাকা পাঠানো হয়েছে। ব্যাস, অতদূর। গেল বছর বিষয়টা আমাকে বললে, তাকে পরামর্শ দেই, নতুন করে আবেদন করার জন্যে এবং কথা দেই আন্তরিকভাবে চেষ্টা করার। যোগাযোগ করি বাসসের সাংবাদিক মাহফুজা জেসমিনের সাথে। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত এবং একাত্তর–চেতনায় নিবেদিত প্রাণ। এই ব্যাপারে তার প্রচেষ্টা ছিল প্রচন্ড। ভালো লাগছে, বাংলাদেশ–প্রেমিক পাকিস্তানি এই নাগরিকের শেষ ইচ্ছে পূরণ হতে চলেছে দেখে। তার আখেরী– ঠিকানা তার ইচ্ছে অনুয়ারি বাংলাদেশ। যে দেশের জন্যে তিনি দূর থেকে লড়েছিলেন, প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং নিগৃহীত হয়েছিলেন দেশে–বিদেশে। প্রার্থনা করি জাস্টিজ আসিফ সাকার জীবন–গাড়ি আখেরী ঠিকানায় যেন দেরিতে পৌঁছায়। তিনি দীর্ঘদিন বাঁচুক মনেপ্রাণে তাই প্রার্থনা করি।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট