হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৬ আগস্ট, ২০২৩ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

২০২৪ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

ডোনাল্ড ট্রাম্প কি ক্ষমতায় ফিরে আসছেন?

ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর ভোটযুদ্ধে পরাজিত হবার পর অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন মার্কিন রাজনীতি থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বুঝি চিরবিদায় হলো। কিন্তু দেখা গেলো ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হলেও বিগত তিন বছর তিনি ছিলেন এবং এখনো রয়েছেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। মার্কিনরাজনীতির ইতিহাসে বোধকরি ডোনাল্ড ট্রাম্পই হলেন একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি পদ হারানোর পর এবং সমালোচিত, নিন্দিত, আইনে দণ্ডিত হয়েও বরাবর থেকেছেন লাইমলাইটে। তার বিরুদ্ধে আনীত নানা অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হবার পরও তিনি তার দলের ভোটারদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয় রয়ে গেছেন। বরঞ্চ বলা চলে তার জনপ্রিয়তা সময়ের সাথে সাথে ঈর্ষণীয়ভাবে বেড়ে গেছে। দেড় বছরেরও কম সময়ের মধ্যে অর্থাৎ আগামী ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ইতিমধ্যে সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রিপাবলিকান দলের মধ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সমস্ত নিন্দা, সমালোচনা ও বিতর্ক সত্ত্বেও দলীয় সমর্থকদের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা এতটুকু কমেনি। উল্টো রিপাবলিকান দলের সম্ভাব্য অন্যান্য প্রার্থীদের ছাড়িয়ে ট্রাম্পের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে অনেক। আজ (২৪ আগস্ট) হবে রিপাবলিকান দলের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আগ্রহী প্রার্থীদের প্রথম বিতর্ক। প্রচলিত প্রথা অনুয়ারি দলের আগ্রহী প্রার্থীরা একই মঞ্চে পাশাপাশি বা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে যোগ্য প্রার্থী হিসাবে প্রমাণিত করার সমস্ত যুক্তি, বক্তব্য তুলে ধরবেন। কিন্তু ট্রাম্প তো প্রচলিত নিয়মের মধ্যে চলেন না, তাকে চলতে দেখিনি তার বিগত চার বছরের শাসনামলে। তিনি বরাবর উল্টো পথে চলেছেন। যা কিছু শোভন নয়, না কিছু দৃষ্টি [কটু তাই তিনি করেছেন, প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে। যাই হোক, তিনি ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, আসন্ন রিপাবলিকান পার্টির প্রথম ‘প্রাথমিক বিতর্কে’ তিনি যোগ দেবেন না। যুক্তি হিসাবে তিনি জনগণের কাছে খুব ভালোভাবে পরিচিত এবং জনপ্রিয় বলে দাবি করেন। তাই তিনি মনে করেন, তাদের (জনগণ) মাঝে নতুন করে নিজেকে তুলে ধরার কিছু নাই। ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ, ট্রুথ সোশ্যালএ বলেছেন, “জনগণ জানে আমি কে এবং আমি কতটা সফল প্রেসিডেন্ট ছিলাম। তাই আমি বিতর্কে যোগ দেব না।” তার দাবি জনগণ তাকে ইতিমধ্যে আগামী ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্যে পছন্দ করে রেখেছেন। তার দাবি একেবারে ফেলে দেবারও নয়। গেল সপ্তাহে সিবিএস পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান ভোটারদের মধ্যে ৬২% পছন্দের প্রার্থী। অন্যদিকে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডিসান্টিস মাত্র ১৬% রিপাবলিকান ভোটারদের পছন্দের। প্রাথমিক লড়াইয়ে বাকি প্রার্থীরা ১০% সমর্থন নিয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। ট্রাম্প ক্যাম্পেইন টিমকে প্রশ্ন করা হয়, তাহলে কি তিনি (ট্রাম্প) আগামী দিনে দলের কোন বিতর্কে অংশ নেবেন না? ট্রাম্প ক্যাম্পেইন থেকে এর কোন উত্তর মেলেনি। চলতি সপ্তাহের বিতর্কে ট্রাম্পের অনুপস্থিতির অর্থ হতে পারে ডিসান্টিস অন্যান্য প্রার্থীদের আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, রিপাবলিকান মনোনয়ন লড়াইয়ের যিনি বিজয়ী হবেন, তিনি ২০২৪ সালের নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক দলীয় প্রার্থী বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে লড়াই করবেন। বয়সের কারণে দলের অনেক নেতা ও ডেমোক্র্যাক্ট ভোটাররা না চাইলেও বাইডেন যে নির্বাচন করবেন তা অনেকটা নিশ্চিত।

বেচারা ট্রাম্প। হাতি যেমন কাঁদায় পড়ে কাঁদে, ঠিক তেমন দশা ট্রাম্পের। প্রেসিডেন্সি হারাবার পর থেকেই তাকে একটির পর একটি মামলায় লড়তে হচ্ছে এবং আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। মুখ গোমড়া করে আদালতে আসামির মত নিশ্চুপ বসে থাকতে দেখা গেছে তাকে। অথচ তিন বছর আগেও ছিলেন বিশ্বের সব চাইতে ক্ষমতাবান ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে চারটি মামলায় কয়েক ডজন অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দুটি ফেডারেল, একটি নিউ ইয়র্ক এবং আর একটি জর্জিয়ার আদালতে। এই মামলা চলাকালীন তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে কোন সমস্যা হবে কিনা, এমন কী তিনি যদি কোন অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন কিনা এই নিয়ে মার্কিন আইনে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। প্রেসিডেন্ট হবার জন্যে খুব বেশি যোগ্যতার প্রয়োজন পড়ে না বলে জানা যায়। মার্কিন আইন বলে, কেউ যদি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে চান তাকে অবশ্যই কমপক্ষে ৩৫ বছর বয়েসী হতে হবে, তাকে ‘ন্যাচারাল বর্ন’ নাগরিক হতে হবে এবং তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কম করে হলেও ১৪ বছর ধরে বসবাস করতে হবে। প্রার্থীর চরিত্র বা অপরাধমূলক রেকর্ডের উপর ভিত্তি করে কোন সীমাবদ্ধতা নেই। যদিও আমেরিকার কোন কোন রাজ্য এমন প্রার্থীদের প্রার্থিতা অনুমোদন করে না। তবে দুই কনজারভেটিভ আইন অধ্যাপক সহ কয়েক মার্কিন আইনজ্ঞ এই প্রসঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তারা মনে করেন, ১৪তম সংশোধনীর ৩ ধারার অধীনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অযোগ্য ঘোষণা করা উচিত। কেননা কেউ যদি দেশের শাসনতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্যে শপথ নেবার পরও দেশ বা প্রচলিত গণতন্ত্রের বিদ্রোহে উস্কানি দেয় তাহলে তিনি কিছুতেই দেশের প্রেসিডেন্ট পদের জন্যে লড়াই করার উপযুক্ত হবেন না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০২২ সালে নির্বাচনের ফলাফলকে উল্টিয়ে দেবার জন্যে তার সমর্থকদের ক্যাপিটল হিল আক্রমণের জন্যে উস্কিয়ে দিয়েছিলেন এবং মজার ব্যাপার হলো, ক্যাপিটল হিলে আক্রমণের অভিযোগে ইতিমধ্যে যারা কারাভোগ করছে ট্রাম্প তাদের এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে তিনি পুনরায় ক্ষমতায় এলে তিনি তাদের ক্ষমা করে দেবেন। এদিকে রিপাবলিকান দলের সিনেটর বিল ক্যাসিডি সিএনএন কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরে আসা উচিত। কেননা তিনি এখন চারটি অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত। তিনি যদি অভিযুক্ত প্রমাণিত হন তাহলে আমার ধারণা ভোটাররা নিশ্চয় একজন প্রমাণিত অপরাধীকে প্রেসিডেন্ট পদে দেখতে চাইবেন না। তারপরও তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, যদি ট্রাম্প প্রার্থী হন, তিনি কি তাকে ভোট দেবেন, না জো বাইডেনকে? সরাসরি এর উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থীকেই তিনি ভোট দেবেন। সিনেটের ক্যাসিডি ট্রাম্পের কট্টর সমালোচক। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার পর বিদ্রোহের উস্কানি দেবার জন্যে ট্রাম্পকে দ্বিতীয় অভিশংসনের (ইম্পিচমেন্ট) বিচারে দোষী সাব্যস্ত করার পক্ষে রিপাবলিকান দলের যে সাত সিনেটর ভোট দিয়েছিলেন ক্যাসিডি তাদের অন্যতম।

কেবল ক্যাসিডি নয়। রিপাবলিকান দলের আর এক নেতা, টেক্সাসের প্রাক্তন কংগ্রেসম্যান উইল হার্ড বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২৪ নির্বাচনে লড়তে চাইছেন কেবল ‘জেল থেকে বাইরে থাকার জন্যে’। সিএনএনর সাথে এক সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চারটি অপরাধের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেনকে হারাতে পারবেন কিনা। এখন কথা হলো, ক্যাসিডি যাই বলুক না কেন, মাঠের চিত্র তো ভিন্ন। ট্রাম্পের রয়েছে বিশাল ভোট ব্যাংক। রিপাবলিকান দলীয় নেতারা যে তাকে তাদের আদর্শ প্রার্থী মনে করেন তা ভাবার কোন কারণ নেই। কিন্তু দলীয় স্বার্থের কারণে এবং ভোটারদের নাক্ষেপাণোর জন্যে তার বিরুদ্ধাচারণও করতে পারছেন না তারা। ট্রাম্প ছাড়াও রিপাবলিকান দলের আর যে সকল প্রার্থী প্রেসিডেন্ট পদের নমিনেশনের জন্যে লড়বেন তারা হলেন, ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডিসেন্টিস, প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স (যিনি ট্রাম্পকে অন্যায়ভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ঘোষণা দিতে রাজি হননি এবং যার কারণে ট্রাম্প ও তার সমর্থকদের রোষের কারণ হন), সাউথ ক্যারোলিনার প্রাক্তন গভর্নর ও জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন স্থায়ী প্রতিনিধি নিকি হ্যালি, বায়োটেক উদ্যোক্তা ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিবেক রামস্বামী, সাউথ ক্যারোলিনার সিনেটের টিম স্কট, নিউ জার্সির প্রাক্তন গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টি, নর্থ ডেকোটার গভর্নর ডগ বার্গাম এবং আরাকানসের প্রাক্তন গভর্নর আশা হুটচিনসন।

এখন দেখার পালা এদের মধ্যে কে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্যে দলীয় মনোনয়নলড়াইয়ে হারাতে পারেন। আগেই বলেছি এই তালিকার সবাই এখন ট্রাম্পের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছেন। আগামী দিনগুলিতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলে তারা এই নিয়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারবেন। চেষ্টা করবেন দলীয় ভোটারদের নিজেদের দিকে ফিরিয়ে আনতে। এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো, পারবেন কি তারা ট্রাম্প থেকে তাদের সমর্থন সরিয়ে আনতে? না হলে যে বিশ্বগণতন্ত্র আবারো অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবার ক্ষমতায় ফিরে আসা মানে, ‘ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ নড়বড়ে হওয়া, বিশ্ব জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে আসা, রাশিয়ার পুতিনের কাছে নত হওয়া, ন্যাটো ও ইউক্রেন পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করার সম্ভাবনা, বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রকে আরো হেয় প্রতিপন্ন করা, সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের বারোটা। তার আগে দেখা যাক, রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কে হন। আর তা দেখার জন্যে আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। রচনাকাল : ২৪..২৩।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা শিশু সুরক্ষা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক চির অটুট