কথা ছিল সপ্তাহ তিনেক দেশে থাকবো। কিন্তু দু–সপ্তাহের মাথায় তড়িঘড়ি করে ফিরে আসতে হলো। আগের সংখ্যায় লিখেছিলাম এবারের বাংলাদেশ–সফর শুরু থেকেই যেন উল্টোপথে চলছিল। শুরু থেকে একটার পর একটা বাধা। সব বাধা অতিক্রম করে দেশে যখন পৌঁছি তখন ঢাকা চট্টগ্রাম ডেঙ্গু–আক্রান্ত। ডেঙ্গুর কারণে নিকটজন, পরিচিত অনেকের শারীরিক দশা কাহিল। ভয়ে ভয়ে ছিলাম। ঢাকায় যে ক’দিন ছিলাম, ছিলাম রেস্ট হাউজে। চারিদিকে দরোজা–জানালা বন্ধ। ভেতরে এসি। বাইরের আলো–বাতাস থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, যেন কোন দূরদ্বীপ। রেস্ট হাউজ থেকে বের হয়ে সোজা গাড়ি। গাড়ির জানালা খোলা যাবে না। দিনের বেলা বাইরের তপ্ত হাওয়া, ধুলোবালি, সন্ধ্যের সময় মশার আতংক। ছোট্ট একটি প্রাণীর ভয়ে সারাক্ষণ যেন ‘গ্লাস হাউজে’ বন্দী। ঢাকা পৌঁছার আগেই ড্রাইভারকে বলে রেখেছিলাম, ভালোমানের এরোসেল কিনে রাখতে এবং এয়ারপোর্ট আসার আগে যেন ভালোভাবে স্প্রে করে নেয়। একই দশা চাটগাঁ পৌঁছে। ঘরের জন দেশে যাবার আগে কয়েক বাক্স শপিং করার পাশাপাশি মশা থেকে বাঁচতে হল্যান্ড থেকে ‘বিফোর–বাইট’, ‘আফটার বাইট’ ইত্যাদি স্প্রে, মলম ব্যাগজাত করেছিল। দেখে মনে হয়েছিল বেড়াতে না, দেশে যাচ্ছি মশার সাথে যুদ্ধ করতে। ঢাকায় পৌঁছে পরদিন চাটগাঁ। দুদিনের মাথায় ফের ঢাকা উড়াল দেয়া। পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সেখানে গিয়ে শরীর খারাপ হতে লাগলো, মৃদু জ্বর শুরু হলো, গায়ে প্রচন্ড ব্যথা। নিকটজনেরা ধরে নিলো নির্ঘাৎ ডেঙ্গু। উদ্বিগ্ন মেজদা আমার যাতে সামান্যতম কষ্ট না হয় সে জন্যে ল্যাবরেটরি থেকে লোক নিয়ে এলো রক্ত নেবার জন্যে। বিকেলে রিপোর্ট এলো নেগেটিভ।
শরীরের অমন দশা নিয়ে ঢাকার দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠান শেষে আবারো চাটগাঁ। আমার ‘হল্যান্ড থেকে’ বই প্রকাশনা অনুষ্ঠান। ইতিমধ্যে সব আয়োজন হয়ে গেছে। ঢাকা থেকে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে পরিচিত অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আমন্ত্রণ পত্র বিলি হয়ে গেছে। সভাপতি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক একুশে পদক প্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব এম এ মালেক। এমন পরিস্থিতিতে কোনভাবেই এই অনুষ্ঠান বাতিল করা সমীচীন নয়। প্যারাসিটামলের উপর ভর করে এরই মধ্যে সব কিছু সামলাতে হচ্ছে। বাসায় ফিরে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। যে ক‘দিন দেশে ছিলাম প্রতিদিন সকালে ঘরের জনের নির্দিষ্ট কাজ ছিল আমাকে ম্যাসেজ করা। ইতিমধ্যে জ্বর এলো আত্মজ অতীশের। নিজের জন্যে উদ্বিগ্ন তেমন ছিলাম না। কিন্তু অতীশের জ্বর এবং তার সহসা দুর্বল হয়ে পড়ায় বেশ ভড়কে গেলাম। অতীশ ও তার বোন, সপ্তর্ষির দু–সপ্তাহ বাদে হল্যান্ড ফিরে আসার কথা। কথা ছিল আমি আর সুমনা ঢাকা গিয়ে ওদের ‘সী–অফ’ করে সেদিনই দুপুরে চাটগাঁ ফিরবো। আমরা ফিরবো আরো এক সপ্তাহ পর। আমার শারীরিক দশা এতই কাহিল যে আমার আর ঢাকা যাওয়া সম্ভব হলোনা। ওদের নিয়ে সুমনা একলা ঢাকা রওনা হলো সকালের ফ্লাইটে। পরদিন সকালে অতীশ–সপ্তর্ষি হল্যান্ডের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়বে। চাটগাঁ থেকে যাবার সময় সুমনাকে বললাম, তোমার পাসপোর্ট সাথে রাখো। সে বললো, দরকার নেই। আমি তো ফিরে আসছি, তাছাড়া ডোমেস্টিকে পাসপোর্ট লাগে না। তবুও জোর করে তাকে পাসপোর্ট দিলাম। বললাম, ‘ইউ নেভার নো’।
ভাগ্যিস জোর করে দিয়েছিলাম। ঢাকা এসে রেস্ট হাউজে পৌঁছে অতীশের শরীর আরো দুর্বল হয়ে পড়ে, তার জ্বর বাড়তে লাগলো। কিছুতেই মাথা তুলতে পারছিলো না। এমন অবস্থায় সন্তান দুটোকে কিছুতেই গার্ডেন–ছাড়া পাঠানো সমীচীন হবেনা বিবেচনায় তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে সুমনা ওদের সাথে যাবে। সে রাতেই সুমনার জন্যে নতুন টিকেট কেনা হলো অনলাইনে। গচ্চা গেল প্রায় আশি হাজার টাকা। তার চাইতে বড় কথা, তার সমস্ত লাগেজ, পরনের কাপড়, গয়না–গাটি, কসমেটিক ইত্যাদি সব রয়ে গেলো চাটগাঁয়। তাকে নিশ্চিত করি যে পরের সপ্তাহে যখন ফিরবো সাথে নিয়ে আসবো। ঢাকা যাবার সময় বাড়তি কোন কাপড়ও সাথে নেয়নি। ফলে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে সালওয়ার–কামিজ কিনে টয়লেটে গিয়ে সেগুলি পড়ে প্লেনে উঠে সে। এক নাটকীয় ব্যাপার। নাটকের এইখানে শেষ নয়। ওরা যেদিন ঢাকা ছাড়লো সেদিন রাতে আমার শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়লো। ছেলের জন্যেও মানসিকভাবে খুব চিন্তিত ছিলাম। তার আগের সন্ধ্যায় কথা ছিল রেডিসনে যাবো সবাই মিলে। সিনিয়র্স ক্লাবের প্রেসিডেন্ট বন্ধু ডাক্তার সেলিম চৌধুরীর আমন্ত্রণ। সব ঠিকঠাক। শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করতে হলো। কিন্তু খাওয়া ঠিকই পৌঁছুলো আমাদের ডাইনিং টেবিলে। বসে আছি। দরোজার কলিং বেল বেজে উঠে। খুলে দেখি আরিফ। ড. সেলিম চৌধুরীর ড্রাইভার। দু–হাত ভর্তি খাবারের প্যাকেট, স্যুপ থেকে শুরু করে হরেক রকমের আইটেম। প্রয়োজনের চাইতে অত্যধিক খাবার যা আমাদের পক্ষে কয়েক বেলা খেলেও শেষ হবার নয়। শেষ পর্যন্ত তা বিলিয়ে দিতে হলো। আমাকে দেখতে আসা ভাগ্নে, ছোট ভাইকে জোর করে গছিয়ে দেই। গছিয়ে দেই কাজের মেয়ে ও বাড়ির দারোয়ানকে।
আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত। অতীশের এই লম্বা জার্নিতে সাথে তার মা আছে, বোনও। টেনশনের আর কোন কারণ নেই। কিন্তু টেনশন বাড়লো গভীর রাতে। ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ি। তার উপর ফ্ল্যাটে একা। রাত–বিরোতে যদি মরেও থাকি তাহলেও তো কেউ টের পাবে না। ফোন করি আমার ট্রাভেল এজেন্টকে। বলি, আমার জন্যে ইমিডিয়েট নেক্সট এভেইল্যাবেল ফ্লাইট দেখেন। চেক করে উনি বলেন, স্যার অনেক টাকা লস যাবে। ‘সেতো আমার ব্যাপার। আপনি দেখেন টিকেট পান কিনা।’ ঘন্টা কয়েক বাদে জানালেন, পাওয়া গেছে। পরদিন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা এমিরেটসের ফ্লাইট। ঠিক হলো ভোরে ফার্স্ট ফ্লাইটে ঢাকা, তারপর সন্ধ্যের ফ্লাইটে হল্যান্ড। তড়িঘড়ি করার পেছনে আর একটি যে কারণ ছিল, তা হলো যদি শরীর আরো খারাপ হয়ে পড়ে, জ্বর বাড়ে তাহলে তো প্লেনে উঠতে দেবে না। অথচ আমার হল্যান্ড ফেরা খুব দরকার। অনেক কাজ পড়ে আছে। ভোর ছ’টায় ড্রাইভার ইব্রাহিম এলো। ক’দিন ধরে চট্টগ্রামে প্রচণ্ড বৃষ্টি। শহরের অনেক স্থানে রাস্তা ডুবে গেছে। ভাবি এয়ারপোর্ট যাওয়া যাবেতো? আবহাওয়া যে বৈরী এবং যে মুষুলধারে বৃষ্টি পড়ছে প্লেন উড়বে তো? ভালোর চাইতে মন্দ যা তাই কেবল মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো। কিছুটা দেরিতে হলেও বাংলাদেশ বিমান ঠিকঠাক পৌঁছুলো ঢাকা। দুবাই হয়ে পৌছুলাম নির্দিষ্ট সময়ে শিফল এয়ারপোর্ট। রাজধানী আমস্টারডামে। সেখান থেকে হেগ শহর, আমার দ্বিতীয় আবাস, একটানা দীর্ঘ ৩৩ বছর যে শহরে আমার বসবাস। অনেকটা সময়। এতটা বছর তো অনেকেই বাঁচে না। বাঁচেনি বন্ধু মোমিন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ এফ রহমান হলে তার কামরায় থেকে অনার্স দিয়েছিলাম। সে সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে পাস দিলো। কিন্তু জেনে যেতে পারেনি। রেজাল্ট বের হবার আগেই ধনুষ্টঙ্কারে মারা গেল তরতাজা আমার কাছের বন্ধু মোমিন। ৩৩ বছর পৌঁছার আগে মারা গিয়েছিল কলেজিয়েট স্কুলের সহপাঠী বন্ধু তৌহিদুল করিম চৌধুরী। অনার্স ও মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে জয়েন করেছিল। হঠাৎ সেও চলে গেল চিরতরে।
ফিরে এলাম হল্যান্ড। সুমনা এসেছিল এয়ারপোর্টে। স্টিয়ারিংয়ে তার হাত। তার পাশের সীটে বসে মাথা এলিয়ে দেই। ক্লান্ত আমি। প্রানভরে নিঃশ্বাস নেই। বাইরে চমৎকার রৌদ্রস্নাত দিন। আহ, কী মুক্ত বাতাস। গত দুই সপ্তাহ দেশে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারিনি। গাড়ি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে, সাথে সুমনার অনর্গল কথা বলা। ফেরার কথা ছিল আরো এক সপ্তাহ পর। কী চেয়েছিলাম, কী ঠিক করে রেখেছিলাম। আর কী হলো! হল্যান্ড ফিরে আসার সপ্তাহ খানেক আগে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের দৃষ্টিনন্দন বাসভবনে খাবার টেবিলে আড্ডা দেবার সময় তাঁর স্ত্রী কামরুন মালেক ভাবি কথা প্রসংগে বলেছিলেন : ‘ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস’, অর্থাৎ “মানুষ যে কোন পরিকল্পনা করতে পারে, কিন্তু তার সাফল্য বা ব্যর্থতার সিদ্ধান্ত নেন উপরওয়ালা।” তাই নয় কি?
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট