ইউরোপে জীবন, পথ চলাচল কত সহজ! কেবল দেশের ভেতরেই নয়, এক দেশ থেকে ইউরোপের আর এক দেশে সড়কপথে যেতে চাইলে পথের দূরত্ব হিসেব কষে ঠিক সময় মত গন্তব্যস্থলে পৌঁছা যায়, কদাচিৎ কোন ব্যতিক্রম ছাড়া। দূরত্ব যদি হয় ১০০ কিলোমিটার তাহলে এক ঘন্টা, এমন কী তার চাইতেও কম সময়ে আপনি পৌঁছে যেতে পারবেন আপনার নির্দিষ্ট স্থানে। ইউরোপের হাইওয়েতে গাড়ির মজা সেখানে। ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি চলছে সামনের দিকে, কখনো ডানে–বামে রাস্তা এগিয়ে গেছে, কিন্তু কোন ট্রাফিক সিগন্যাল নেই, নেই কোথায়ও থামা, নেই কারো অনিয়ম আর ইচ্ছে মাফিক গাড়ি চালানো। হাইওয়েগুলি যে শহর বা গ্রামকে পাশ কেটে বাইরে দিয়ে এগিয়ে গেছে এক শহর ছেড়ে আর এক শহরের দিকে, এক দেশ ছেড়ে আর এক দেশের দিকে। গেল হপ্তায় যেতে হয়েছিল বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে এক সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে। অনুষ্ঠান রাজধানীর ইউরোপিয়ান প্রেস ক্লাবের সম্মেলন কক্ষে। সাংবাদিক হিসাবে এই ক্লাবের সদস্য আমি। সদস্য হিসাবে চাইলে যে কোন সময় দুজন অতিথি বা সঙ্গী নিয়ে ক্লাবে যেতে পারি, সেখানে ক্যান্টিনে কফি, চা, পানি খেতে পারি। তার জন্যে কোন অর্থ ব্যয় হবে না। সেখানে বসে নিরিবিলি কাজও করতে পারি, ল্যাপটপ খুলে। কেবল বছরে একশো ডলার খোয়াতে হবে। ক্লাবের পরিচালক লরেন্ট ব্রিহের সাথে বেশ সখ্য। সময়ের বিচার্যে কম করে হলে তার সাথে পরিচয়, যোগাযোগ বছর দশেক তো হবে। একবার ভেবেছিলাম ট্রেনে যাবো। কেননা একা যাবো। তেমনটিই কথা ছিল। কেননা আজকাল আর একা লং–ড্রাইভ ভালো লাগেনা। এক সময় ছিল ভালো লাগতো, ‘বোরড’ হতাম না। কেননা একা চলার পথে আমার কাছে রবীন্দ্র সংগীতের চাইতে আর কোন ভালো সঙ্গী হতে পারেনা। আমার এই ‘দো–মনা’ ভাব দেখে ‘সু–মনা’ এগিয়ে এলো। তাতে সুবিধা হলো গোটা পথটুকু ভাগাভাগি করে যাওয়া হলো। তাতে এক চালকের উপর চাপটা কম পড়ে। টুকটাক কথাবার্তা হয়, কথা কাটাকাটিও কখনো–সখনো। সেদিন ছিল রবিবার। আমার দেরি করে ঘুম থেকে উঠার দিন। কিন্তু সেদিন একটু আগ বাড়িয়ে উঠতে হলো। অনুষ্ঠান শুরু হবে দুপুর দুটোয়। অনুষ্ঠানের মূল আয়োজকদের থেকে স্নেহভাজন মুর্শেদ মাহমুদ ও জাহাংগীর চৌধুরী রতন বার কয়েক ফোন করে অনুরোধ জানিয়ে বলেছিল, অনুষ্ঠানে থাকতে হবে, কিছু বলতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিষয় ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন ও চ্যালেঞ্জ’। রতন আমার সহোদর সঞ্জয়ের ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয়ের সতীর্থ। সেই সুবাদে তার সাথে পরিচয়। বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ গণহত্যা নিয়ে কাজ করে। অন্যদিকে মুর্শেদের একটি নিজস্ব মানবাধিকার সংগঠন আছে বেলজিয়ামে। এর বাইরে তার আর একটি পরিচয়, যা দিলে সে কিছুটা বিব্রত বোধ করে। হয়তো ভেতরে ভেতরে তার ভালোই লাগে, দেখায় না। আমাদের দেশে কেউ যদি জেলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কিংবা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতার ভাই হন, এমন কী আত্মীয়, তাহলে তো তার পা মাটিতে পড়ে না। তার দাপট দেখে কে। ব্যতিক্রম দেখলাম মুর্শেদকে। সে আমার স্নেহভাজন। মাঝে মধ্যে দুষ্টুমিও করি। তাকে দেখলে যখন বলি, ‘কী খবর মন্ত্রীর ভাই, কেমন আছো’? তখন সে বিনয়ের সাথে বলে, ‘দাদা, ওভাবে বলবেন না’। শুনে বলি, ‘তুমি তো আর যেই সেই মন্ত্রীর ভাই নও, প্রভাবশালী মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতার ছোট ভাই। অন্য কেউ হলে তো এমন ক্ষমতাসীন ভাইয়ের নাম বিক্রি করে চলতো’। ধর্মভীরু মুর্শেদ বলে, ‘দাদা, আপনি তো আমাকে চেনেন’। আমি জানি। আর জানি বলেই তাকে আমার পছন্দ। তার বাসায় একবার সে আমাদের ঘটা করে খাইয়েছিল। ব্রাসেলসসেই তার বাসা। মুর্শেদের ভাই হলেন তথ্য মন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ। ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার কারণে তিনি আমার সহোদর, সঞ্জয়ের সহপাঠী। সে কথা জানিয়েছিলেন মন্ত্রী নিজেই। সেবার ২০১৬ সালে যখন ঢাকায় ‘মাইগ্রেসন’ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হলো তখন সন্ধ্যায় এক অনুষ্ঠানে তার দেখা। তখন অবধি তার সাথে আমার কখনো দেখা–সাক্ষাৎ বা পরিচয় হয়নি। পরিবেশ নিয়ে ঢাকার এক হোটেলে ছিল অনুষ্ঠান। তিনি প্রধান অতিথি, আমি সাধারণ বক্তা। যদিও বা আমার কিছু বলার কথা ছিল না। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল তার প্রধান কর্তাব্যক্তি হঠাৎ ঘোষণা দিলে। মাইকের সামনে দাঁড়াতে হয় কিছু বলার জন্যে। অনুষ্ঠান শেষে খাবার টেবিলে ড. হাসান মাহমুদের মুখোমুখি বসে, তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলি, ‘আপনি আমাকে চিনবেন না, আমার নাম বিকাশ’। ‘আপনার লেখা তো আমি দৈনিক আজাদীতে প্রায় সময় দেখি, পড়ি’। শুনে ভালো লাগলো। সেদিনই প্রথমবারের মত তার ইংরেজি বক্তব্য শুনলাম এবং মনে আছে বেশ ‘ইমেপ্রসড’ হয়েছিলাম। এর আগে তার কোন বক্তব্য আমার শোনা হয়নি। তারপর খাবার শেষে বললেন, ‘বেলজিয়াম গেলাম, সঞ্জয়কে দু’বার ফোন করলাম। সে কোন রেসপন্স করলো না’। উত্তরে বলি, ‘সে আমার মত সামাজিক নয়, বাইরের সাথে যোগাযোগ কম রাখে’। গেল মাসে মন্ত্রীর সাথে আবারো দেখা ঢাকা বিমানবন্দরে। চাটগাঁ থেকে ঢাকা ফিরে লাগেজ বেল্টে অপেক্ষা করছি ব্যাগের জন্যে। এমন সময় দেখি কয়েক লোক পরিবেষ্টিত হয়ে মন্ত্রী আসছেন। এগিয়ে গিয়ে কথা বলতেই তিনি চট্টগ্রামে আঞ্চলিক ভাষায়, ‘আপনাকে দেখে মনে হয় সঞ্জয়ের ছোট ভাই’ বলে মৃদু হাসলেন। বললাম, ‘দরকার আছে দেখা করবো এক সময়। (বলে রাখি, কোন তদবিরের জন্যে নয়)। বললেন, চলে আসেন। দেখা করা আর হয়নি। তার দিন দুয়েক পর আমাকে ঢাকা ছাড়তে হবে। কিছু জরুরি কাজ সারা তখনও হয়নি। তার উপর উনি ব্যস্ত মানুষ। তার সময়ের মূল্য তো আমার চাইতে অনেক বেশি। ফিরে আসি মূল বিষয়ে–
সাধারণত হেগ শহর থেকে ব্রাসেলস পৌঁছুতে ঘন্টা দুয়েক লাগে। ঘন্টা খানেক ড্রাইভ করে মাঝে বর্ডারে গাড়ি থামিয়ে কফি আর স্ন্যাকস খেতে থাকি। সাথে বাসা থেকে বানিয়ে–আনা চা আর খাবার ছিল। দূরে কোন লং ড্রাইভে গেলে এমনটাই করা হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ওই ফ্লাঙ আর খোলা হয়না, ফ্লাঙে থাকা চা–ও খাওয়া হয় না। ফিলিং স্টেশন থেকে চা কিংবা কফি এবং স্ন্যাকস কিনে খাওয়া হয় প্রতিবার। এবারও তার কোন ব্যতিক্রম হলোনা। কফি খেয়ে কিছুটা চাঙ্গা হয়ে নেই। অবশ্য হল্যান্ড–বেলজিয়াম বর্ডার তক সুমনাই ড্রাইভ করে আসছিল। ওয়াশ রুম থেকে ফিরে এসে আমাদের আবার সামনের দিকে চলা। আরো একশো কিলোমিটার পথ পেরোতে হবে। এবার গাড়ির হাত বদল হলো। গাড়ি চলতে থাকে, পেন ড্রাইভে থাকা বাংলা গান বেজে চলে। কোন অনুষ্ঠানে যাবার আগে প্রতিটি মহিলার যা না করলেই নয়, সেই কর্মটি করার জন্যে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে সুমনা এখন তাই করতে মনোযোগী হয়ে পড়ে, মিনি মেক–আপ বঙ খুলে তার ‘আপনা’ কাজ করতে থাকে। মহিলাদের এই মেকআপ নিয়ে আমার অতি ঘনিষ্ট বন্ধু মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর একটি মজার কথা বলেছিলেন একবার। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো ভেবে পাইনে, যদি মেক–আপ না থাকতো তাহলে আজকালকার মহিলাদের কী দশা হতো’। দিন যায় কথা থাকে, তেমনি মানুষ যায় কথা থাকে। বন্ধু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আর নেই আমাদের মাঝে। কিন্তু তার উচ্চারিত এই কথাগুলি ঠিক রয়ে গেছে। একটা সময়, আমার ছোটবেলায় মা, দিদিকে কোনোদিন কোন মেকআপ ব্যবহার করতে দেখিনি। মা দিদি দুজনেই ছিলেন দারুন সুন্দর। মাকে মাঝে মধ্যে দেখতাম একটি পিতলের ছোট পাত্র কুপির আলোয় ধরে কালো করতে, আর সে কালো ধোঁয়া কাজল হয়ে ঠাঁই পেতো তার সুন্দর দুটি চোখে। আর এখন দেখি কেবল কালো নয়, নীল, বাদামী হেন কোন রং নেই যা চোখের পাতায়, চোখের উপরে–নীচে মহিলারা লাগান না। যাই হোক– সৌন্দর্য্য নিয়ে আলোচনার এখানেই ইতি টানা ভালো। না হলে মূল আলোচনার বিষয় আর উঠে আসবে না এই লেখায়।
সেদিনকার অনুষ্ঠানের মডারেটর এন্ডি। মঞ্চে আসন নিয়ে গ্যারির সাথে বিজনেস কার্ড বিনিময় হলো। এন্ডি জানালে, তার ভিজিটিং কার্ড নেই। ই–মেইলও নেই। একটু অবাক হলাম। বললো, ‘আমি হোয়াটস আপ ব্যবহার করি’। কাগজ নিয়ে তার নাম, হোয়াটসআপ নম্বর লিখে দিলো। দুজনের মধ্যে এন্ডি বেশ আলাপী ও বন্ধুসুলভ। ভালো লাগলো দুজনের বক্তব্য শুনে। একাত্তর সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে জেনোসাইড/গণহত্যা করেছে এবং তাকে ঘিরে ইউরোপ–বাংলাদেশে যে ক্যাম্পেইন চলছে তার প্রতি তাদের সম্পূর্ণ সমর্থন জানালেন তারা। তার উপর বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশ–বিরোধী একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী দেশ ও দেশের বাইরে যে অপপ্রচার চালাচ্ছে তার নিন্দা করেন দুজনেই। প্রশংসা করেন শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের। গ্যারি বলেন, ‘নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি বেলজিয়ামে জোরেশোরে দবিভ্রান্তিমূলক মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে’। তিনি সবাইকে এই সমস্ত অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হবার আহবান জানান। অনুষ্ঠানে পর্দায় দেখানো হলো বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. আবুল মোমেনের একটি ভিডিও বার্তা। সেটি সেদিনই ঢাকা থেকে পাঠানো হয়েছে বলে জানালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর চৌধুরী রতন। বার্তার সাইজ এত বড় ছিল যে সেটি বলা চলে একটি ছোটখাট ভাষণ। সুন্দর আয়োজন ছিল। শুরু হয়েছিল সময়মত। যা বাংলাদেশী অনুষ্ঠানে সাধারণত দেখা যায় না। এই ধরনের অনুষ্ঠানে বাড়তি যে ভালোলাগা তা হলো, অনেকের সাথে দেখা হয়, পরিচয় ঘটে নতুনের সাথে। দেখা হলো প্যারিস থেকে আসা চট্টগ্রামের সন্তান, এম এ হাসেম, ফ্রান্সে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল, চ্যানেল আই এর প্রতিনিধি। দেখা ও আলাপ হলো আরো জনা কয়েকের সাথে। অনুষ্ঠানের শেষে গ্যারি কথা প্রসঙ্গে জানালেন, তিনি হন্যে হয়ে একাত্তরের জেনোসাইডের উপর তৈরি ডকুমেন্টারি ফিল্ম খুঁজছেন। তাকে আশ্বাস দেই ব্যবস্থা করা যাবে।
অনুষ্ঠান শেষ। হাতে আরো অনেকটা সময়। ব্রাসেসল থেকে আরো শ‘কিলোমিটার দূরে এক ছোট্ট শহরে (গ্রামই বলা চলে, নিরিবিলি এলাকা) থাকেন ড. আহমেদ জিয়াউদ্দীন। কিছুটা অসুস্থ। ভাবলাম তাকে দেখে আসা দরকার। অনেকদিন ধরে বিশেষ করে কোভিডের পর আর সেদিকে যাওয়া হয়ে উঠেনি। তাকে মেসেজ পাঠিয়ে সেদিকে রওনা দেই। ভাবীর সার্ভ করা মিষ্টি, ডালপুরি আর চা খেয়ে চলে কিছুক্ষণ আড্ডা। পাশে টিভি স্ক্রীনে শব্দবিহীন চলতে থাকে ভারতীয় টিভি চ্যানেলে হিন্দী সিরিয়াল। জিয়া ভাই বলেন, সারাদিন তো বসে বসে সে এইসব দেখে। ‘আমি তো আর সারাদিন কোন কাজ করি না’, অনুযোগের সুরে ভাবি বলে উঠেন। শুনেছি দেশেও প্রায় প্রতিটি ঘরে নাকি এই ‘সর্বনাশা’ হিন্দি সিরিয়াল চলে, আর এর প্রধান দর্শক বাড়ির মহিলারা। আমি দেখিনি, কিন্তু শুনেছি এই সমস্ত সিরিয়াল দেখলে নাকি শেখা যায় কী করে সংসার ভাঙতে হয়। ফিরে আসার জন্যে যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাত। দিনের আলোয় তখনও কোন কমতি নেই। শরীর বলে, আমার একটু বিরাম দরকার। কিন্তু আমাদের বিরাম নেবার সময় নেই। আমাদের ফিরতে হবে। আগামীকাল কাজ। আমরা ফিরতে থাকি। গাড়ির গতি দ্রুত হয়। ঝামেলাবিহীন ও নিরাপদ সড়ক ধরে আমাদের গাড়ি ফিরে চলে, যেখান থেকে শুরু তার উদ্দ্যেশ্যে।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট