মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের সামপ্রতিক চীন সফর, প্রেসিডেন্ট সি সিন পিং, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সহ দেশটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক এবং পাশাপাশি ব্লিনকেনের আশ্বাসবাণী, ‘ওয়াশিংটন তাইওয়ানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে না’ শুনে অনেকে মনে করতে পারেন যে এই দুই বৃহৎ শক্তিশালী দেশের মধ্যে বিরাজমান বৈরী মনোভাব ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে বুঝি বরফ গলতে শুরু করেছে। কিন্তু বাস্তবে তার ভিন্ন চিত্র। বলতে হয়, ‘দিল্লি দূর অস্ত’। তবে এই দু–দেশের মধ্যে সম্পর্কে যে স্থবিরতা ও একে অন্যের প্রতি বৈরী মনোভাব এবং সময়ে সময়ে ‘ডিপ্লোমেসিকে’ পাশ কাটিয়ে দু পরাশক্তি যে পেশিশক্তি প্রদর্শন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে, তাতে হয়তো আগামীদিনে কিছুটা ভাটা পড়তে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রায় পাঁচ বছর পর এই প্রথম কোন মার্কিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা চীন সফরে গেলেন। সে কারণে এই ‘হাই লেভেল’ সফরকে ঘিরে গোটা বিশ্বজুড়ে ছিল আগ্রহ ও উৎসাহ। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই সফর শেষে মন্তব্য করেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টোনি ব্লিনকেন ‘হ্যাস ডান এ হেল অব জব’। দু’দিনের সফরের শেষ পর্যায়ে ব্লিনকেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি সিন পিংয়ের সাথেও ৩৫ মিনিটের এক আলোচনা সভায় মিলিত হন।
চীন–আমেরিকা এই দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে সম্পর্ক কখনোই মধুর ছিল না। দুই পরাশক্তির মাঝে ক্ষমতা ও শক্তির দম্ভ, দ্বন্দ্ব লেগেই ছিল বরাবর। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। সামপ্রতিক সময়ে দু–দেশের মধ্যে বিরাজমান যে ‘টেন্সড’ সম্পর্ক তা আরো খারাপের দিকে এগোয় যখন মার্কিন পার্লামেন্টের স্পিকার, ন্যান্সি পেলোসি গেল বছর আগস্ট মাসে চীনের তীব্র প্রতিবাদের মুখে তাইওয়ান সফর করেন। চীন বরাবর তাইওয়ানকে তার মূল ভূখণ্ডের অংশ বলে দাবি করে আসছে এবং এই ব্যাপারে চীন কোন ছাড় দিতে রাজি নয়– সে কথা ব্লিনকেনের এই সফরেও নতুন করে জানান দিতে চীন ভুলেনি। ন্যান্সি পলোসি যখন তাইওয়ান সফর করেন তখন অনেকে এমন কী যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজনীতিবিদ এই সফরের পক্ষে ছিলেন না। তাদের ধারণা এই সফর ‘সময়োচিত’ হয়নি। চীন ন্যান্সির এই সফরে এতই ক্ষেপে গিয়েছিল যে তার সফরের সময় চীন তাইওয়ানের উপকূলে পাঁচটি সামরিক মহড়া চালিয়েছিল এবং আমেরিকার সাথে সকল ধরনের দাপ্তরিক (অফিসিয়াল) সম্পর্ক স্থগিত করেছিল। সে সময় অনেকে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে বলে আশংকা করেছিলেন। তবে এর মাস দুয়েক পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইন্দোনেশিয়ার বালি নগরীতে চীনের প্রেসিডেন্ট সি সিন পিংয়ের সাথে তিন ঘন্টা ধরে আলোচনা করলে বিরাজমান টানটান উত্তেজনা কমতে থাকে। ওই মিটিংয়ে এই দুই রাষ্ট্রপ্রধান দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান ইস্যুগুলিতে ঐকমত্যে পৌঁছুতে না পারলেও তারা দুজনেই এই সিদ্ধান্ত পৌঁছেছিলেন যে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে দু–দেশের মধ্যে আলোচনা চলবে। ঠিক হলো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে চীন সফর করবেন। কিন্তু সেই সফর বাতিল হলো, যখন আটলান্টিক মহাসাগরের উপর চীনের রহস্যঘেরা বিশালাকৃতি বেলুন উড়তে দেখাল গেল। অন্যদিকে সমপ্রতি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে চীন কিউবাতে গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপন করেছে মর্মে এক তথ্য প্রকাশ পেলে অনেকে আশংকা করেছিলেন যে শেষ মুহূর্তে বুঝি ব্লিনকেনের চীন সফর বাতিল করা হবে। কিন্তু শুভ বুদ্ধির উদয় হলো, সফর বাতিল করা হয়নি। ব্লিনকেনের এই সফর শেষে দু’পক্ষকেই আশাবাদী বলে মনে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, ‘আমরা সঠিক পথে আছি’। এই সফরে কোন অগ্রগতি হয়েছে কিনা এই মর্মে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘সেটি প্রশ্ন না করে বরঞ্চ প্রশ্ন করুন কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে।’ সুখের বিষয়, অনেকটা একই সুরে কথা বলেন চীন প্রেসিডেন্ট সি সিন পিং। চীন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেলকে এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, বালিতে (ইন্দোনেশিয়া) প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং আমি যে সমস্ত বিষয়ে একমতে পৌঁছেছিলাম, তা অনুসরণ করে দু’পক্ষই কাজ করে যাবার জন্যে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। কিছু কিছু নির্দিষ্ট ইস্যুতে ‘এক’ হতে পেরেছে’। তবে কোন কোন ইস্যু তা তিনি উল্লেখ করেননি। আমেরিকার সাথে স্থিতিশীল সম্পর্কের প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে চীন প্রেসিডেন্ট সি সিন পিং আরো বলেন, ‘বিশ্বের প্রয়োজন অর্থনৈতিক ভাবে অতি শক্তিশালী দুটি দেশের স্থিতিশীল সম্পর্ক’।
সম্পর্ক যাই থাকুক না কেন প্রচলিত প্রথা মাফিক দু–দেশের মধ্যে সরকারি উচ্চ পর্যায়ের সফর নিয়মিত হয়ে থাকে। কিন্তু সফর হয়নি অনেকদিন। ব্লিনকেনের এই প্রথম চীন সফর। অথচ হিলারি ক্লিনটন চার বছর পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন সাতবার চীন সফর করেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এখনো চীন সফর করেননি। তিনি হবেন প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি চীন সফর করেননি। তবে ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আগামী সেপ্টেম্বরে চীন সফর অনেকটা চূড়ান্ত হয়ে আছে, যা দু–দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক লক্ষণ বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। এর আগে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগেন, জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ, জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প সবাই চীন সফর করেন, প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতায় থাকার প্রথম চার বছর সময়ে। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন চীন সফর করেন তার ক্ষমতায় থাকার দ্বিতীয় মেয়াদে।
বলা বাহুল্য, তাইওয়ান, ইউক্রেনের যুদ্ধকে ঘিরে রাশিয়াকে চীনের অস্ত্র সরবরাহ, জিনজিয়াং, তিব্বত ও হংকংয়ে চীনের মানবাধিকার লংঘন, তাইওয়ান প্রণালিতে চীনের ‘উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড’ সহ নানা ইস্যুকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র বরাবর চীনকে দোষারূপ করে আসছে এবং একঘরে করে রাখারও চেষ্টা চালায়। অন্যদিকে চীন মনে করে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব মোড়ল হিসাবে আবির্ভুত হবার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। চীনকে পাশ কেটে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ডজন খানিক দেশের সমন্বয়ে ইন্দো–প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি নিয়ে আমেরিকা যে উদ্যোগ নিয়েছে তাকে চীন মনে করে তাদের (চীন) ঘিরে রেখে তাদের দেশের অগ্রগতিকে থামানোর প্রচেষ্টা। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র চীনের এই দাবিকে অস্বীকার করে বলে, তাদের এই উদ্যোগ চীনের সাথে প্রতিযোগিতামূলক, অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। দু’দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্পর্ক এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, যে কোন মুহূর্তে এর পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। যেমন গেল মাসে একটি চাইনিজ জে–১৬ ফাইটার দক্ষিণ চীন সাগরের উপরে উড়তে থাকা একটি মার্কিন আর সি–১৩৫ সার্ভেলেন্স প্লেনের একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছিল। একই ধরনের আর একটি ঘটনা ঘটেছিল গত বছরের ডিসেম্বর মাসে, যখন মার্কিন ও চীন এয়ারক্রাফট খুব কাছাকাছি চলে আসে। ভাগ্য ভালো চূড়ান্ত কোন দুর্ঘটনা ঘটার আগেই উত্তেজনা প্রশমিত করা সম্ভব হয়। এই দুই দেশের সম্পর্ক সামপ্রতিক বছরগুলিতে এমন খারাপের দিকে পৌঁছেছিল যে অনেকে মনে করেছিলেন যে তাইওয়ানকে ঘিরে দু–দেশের মধ্যে একদিন সামরিক যুদ্ধ বাঁধবে। চীন যে সামরিক মহড়া চালিয়েছিল তাতে তার প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলি অনিরাপত্তায় ভুগছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে বিশ্ব শান্তির লক্ষ্যে মার্কিন–চীন সম্পর্কে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আর সে কারণে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ব্লিনকেনের সামপ্রতিক চীন সফর যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। গেল রোববার ব্লিনকেন তার চীন প্রতিপক্ষের সাথে সাড়ে সাত ঘন্টা দীর্ঘ আলোচনায় মিলিত হন। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট এই মিটিংকে ‘স্পষ্ট, মৌলিক ও গঠনমূলক’ হিসাবে উল্লেখ করলেও বিরাজমান সমস্যা, পারস্পরিক সন্দেহ নিরসনে খুব একটা যে অগ্রগতি হয়েছে তা কিছুতেই দাবি করা যায় না। তবে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্পর্ক উন্নয়নে আলোচনা চালিয়ে যাবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন, যদিও বা এখনো এই ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা দেয়া হয়নি। চীন সরকারি টেবলয়েড গ্লোবাল টাইমস তার এক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে এই বলে উল্লেখ করে যে, ব্লিনকেনের চীন সফরে সাফল্যের তেমন কোন প্রত্যাশা না থাকলেও, আশা করা হচ্ছে যে উভয় পক্ষই সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের ‘বটম লাইন’ বজায় রাখবে।
তাইওয়ানের প্রশ্নে চীন একেবারে অনড়। চীনকে আস্বস্ত করে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘এক চীন নীতির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অবস্থান এখনো অটুট রয়েছে এবং ওয়াশিংটন তাইওয়ানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে না’। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে তাইওয়ান–বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমরা তাইওয়ানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করি না’। তবে তাইওয়ান প্রণালিতে চীনের ‘উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের’ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের কাছে তুলে ধরেন বলে ব্লিনকেন জানান। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, প্রেসিডেন্ট সির সঙ্গে বৈঠকে ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘আগ্রাসনমূলক যুদ্ধ’ সহ বৈশ্বিক নানা বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। তবে চীনের পক্ষ থেকে এটিও স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয় যে চীন চায়, যুক্তরাষ্ট্র চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করুক এবং চীনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করুক। প্রতিযোগিতার নামে চীনের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের স্বার্থের অবমূল্যায়ন বন্ধ করতে হবেও চীন দাবি করে।
পাঁচ বছর পর অনুষ্ঠিত ব্লিনকেনের চীন সফর হয়তো কংক্রিট কোন ফলাফল আনতে সক্ষম হয়নি কিন্তু সেই ফলাফল অর্জনে সামনের দিনগুলিতে যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রয়োজন তার ভিত তিনি (ব্লিনকেন) দিয়ে গেলেন। এমন কী চলতি বছরের শেষ দিকে প্রেসিডেন্ট সি এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মধ্যে আলোচনার দ্বার খুলে দিল। মোটকথা, আলোচনার টেবিলে দু–পক্ষকেই কিছু ছাড় দিতে হবে। তা না হলে কোন লক্ষ্যেই পৌঁছানো সম্ভব না। আগামী সেপ্টেম্বরে নতুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিতব্য জি–২০ শীর্ষ বৈঠকে এই দুই রাষ্ট্রপ্রধান মিলিত হবেন এবং চলতি বছরের নভেম্বরে আমেরিকার সান ফ্রান্সিস্কোতে অনুষ্ঠিতব্য যুক্তরাষ্ট্র আয়োজিত এশিয়া–প্যাসিফিক ইকোনমিক কোঅপারেশন ফোরামে চীন প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে সেখানে জো বাইডেন ও সি সিন পিং মিলিত হয়ে দু–দেশের মধ্যে বিরাজমান শীতল সম্পর্ককে উষ্ণ করার উদ্যোগ নেবেন। এই দুই পরাশক্তির সম্পর্ক উন্নয়ন ও পারস্পরিক বিশ্বাসের উপর অনেকটা নির্ভর করছে বিশ্বশান্তি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট