হল্যান্ড থেকে

ইউরোপীয় প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর ও কিছু কথা

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৩ জুন, ২০২৩ at ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ

ওরা তিনজন। তিনজনের মধ্যে দুজনের এই প্রথম বাংলাদেশে আসা। বোধকরি সে কারণে আসার আগ থেকে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে এক ধরনের কৌতূহল, উৎসাহ কাজ করছিল। দলনেতা যিনি তিনি হল্যান্ডের প্রবীণ রাজনীতিবিদ, কিন্তু বয়সে তেমন প্রবীণ নন, দেখেও তেমনটি মনে হয় না। নাম হ্যারি ফান বোমেল। দীর্ঘ ২০ বছর একটানা পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন। এখন মানবাধিকার, বিভিন্ন দেশে সংঘটিত জেনোসাইড ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয়। লেখালেখিও করেন। বাংলাদেশে আসার সপ্তাহখানেক আগে বাংলাদেশের ওপর প্রকাশিত একটি বই কেনেন। বইটি দেখিয়ে বলেন, ‘প্রফেসর ইউলিয়াম ফান স্ক্যান্ডেলের লেখা এই বইটি কিনলাম, বাংলাদেশকে আরো একটু ভালো করে জানার জন্যে, তবে বলে রাখি ডাচ ভাষায় লেখা এই বইটি দেশটি সম্পর্কে সাধারণতথ্যের জন্যে নয়। এই বইয়ে লেখক একটু গভীরে গিয়ে দেশটির নানা বিষয় তুলে ধরেছেন’। লেখকের সাথে সৌভাগ্যক্রমে আমার জানাশোনা রয়েছে, যোগাযোগও মাঝে মধ্যে। হল্যান্ডে তিনি বেশ পরিচিত এবং বাংলাদেশবিশেষজ্ঞ হিসাবে তার একটি পৃথক পরিচিতি রয়েছে। তার বিষয় এনথ্রোপোলজি ও এশিয়া। যাই হোক, বলছিলাম ডাচ রাজনীতিবিদ হ্যারির কথা। তিনি সমপ্রতি বাংলাদেশে এসেছিলেন সপ্তাহ খানেকের জন্যে ইউরোপীয় প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য হিসাবে। কেবল সদস্য বলি কেন, তিনি ছিলেন পাঁচ ইউরোপীয় ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমের প্রধান, টিম লীডার। টিম লীডার প্রস্তাবটা তিনিই দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘পার্লামেন্টের কোন প্রতিনিধিদল যখন দেশের বাইরে যায় কোন কাজে, তখন একজন টিম লীডার থাকেন যিনি টিমের মুখপাত্র হিসাবে কাজ করেন’। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট বাংলাদেশে আসা টীমে ছিলেন আরো দুজন ইউরোপীয়। জন্মসূত্রে নন, ইউরোপীয় পাসপোর্টধারী, তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে ইউরোপে তাদের স্থায়ী বসবাস। দু’জনের আদিবাস বাংলাদেশএকজনের সিলেট, অন্যজনের চট্টগ্রাম। যে তিনজনের কথা বলছিলাম তাদের মধ্যে হ্যারি ছাড়াও আর যে দুই শেতাঙ্গইউরোপীয় ছিলেন তারা হলেন, আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সিনিয়র গবেষক ড. এন্থোনি হোলস্ল্যাগ এবং ব্রিটিশ গবেষক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন। অপেক্ষাকৃত তরুণ এই ব্রিটিশ নাগরিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করার জন্যে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘ফ্রেন্ড অব বাংলাদেশ’ পদক লাভ করেন। সেই সময় ক্রিস বাংলাদেশ এসেছিলেন এবং সেই সুবাদে কক্সবাজারও ঘুরে গেছেন। ক্রিসের খুব ইচ্ছে ছিল এবার কক্সবাজার বেড়িয়ে আসবেন, সমুদ্র সঙ্গমে যাবেন, নিদেন পক্ষে হোটেলের সুইমিং পুলে ডুব দেবেন। অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত। কিন্তু সেটিও সম্ভব হয়নি, দুটি কারণে। এক সময় ছিল বৈরী, দুই চিটাগাং সিনিয়র্স ক্লাবে যেখানে তারা দুরাত কাটিয়েছেন সেখানে সাঁতার কাঁটার মত কোনো পুল ছিল না। ক্লাবের সদস্য হিসাবে আশা করি, হয়তো কোন একদিন সুইমিং পুল হবে। দূর কিংবা অদূর ভবিষ্যতে।

ইউরোপীয় প্রতিনিধি দলটি এসেছিলেন সরজমিনে দেখতে, একাত্তরে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া জেনোসাইড নিয়ে বিস্তারিত জানতে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলতে, কয়েকটি বধ্যভূমি ঘুরে দেখতে এবং সেখানে যে সকল পরিবারের সদস্যরা তাদের নিকটজনদের হারিয়েছেন তাদের সাথে কথা বলতে। এই নিয়ে ঢাকাচট্টগ্রামের পত্রপত্রিকায়, ঢাকার কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে তারা কথা বলেছেন, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ও চিটাগাং সিনিয়র্স ক্লাব আয়োজিত দুটি সফল অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছেন। ঢাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একাত্তর ও প্রজন্ম একাত্তর আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থিত থেকে নিজেরা বলেছেন, অন্যদের বক্তব্য শুনেছেন। সে সব কথা ঢাকা ও চট্টগ্রামের পত্রপত্রিকায় ঢালাওভাবে সংবাদাকারে বেরিয়েছে। তাই সেদিকে না গিয়ে তাদের বাংলাদেশ কেমন লাগলো, কী অভিজ্ঞতা হলো, তাদের অভিমত ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লিখবো বলে আজকের কলম ধরা। কথাটা ঠিক বলা হলো না। কলম তো ধরিনা সে অনেক বছর। বলা উচিত লেপটপ নিয়ে বসা। আসার আগেই তাদের বলে রেখেছিলাম ঢাকার অসহনীয় যানজটের কথা। বলেছিলাম চট্টগ্রামে তেমনটি নেই বটে, তবে সামপ্রতিক সময়ে ঢাকার পদাংক অনুসরণ করছে। এটিও বলে রেখেছিলাম, চট্টগ্রাম তোমাদের ভালো লাগবে। প্রফেসর হোলস্ল্যাগ ছাড়া বাকি সবাই অনেকটা বন্ধুপর্যায়ে। তার সাথে এই নিয়ে আমার বার দুয়েক দেখা ও আড্ডা দেয়া। হ্যারির বাসায় আমার যাওয়া হয়েছে। খুব পরিচিত না হলে ডাচরা সাধারণত বাইরের কাউকে নিজ বাসায় ডাকেন না। বাসায় ডেকে আপ্যায়ন করান না। অত্যন্ত হিসেবি বা ‘কিপটে’ বলে ডাচদের ইউরোপে বদনাম রয়েছে। একটা উদাহরণ দেই। আমরা বিশেষ করে বাঙালিরা যখন কোন রেস্তোরাঁয় কয়েকজন মিলে খেতে বসি তখন ব্যতিক্রম ছাড়া উপস্থিতদের মধ্যে একজনই খাবারের বিল চুকায়। কিন্তু ডাচরা প্রায় ক্ষেত্রে খাবার শেষে ভাগাভাগি করে বিল চুকায়। এমন কী প্রেমিকপ্রেমিকারাও। এ নিয়ে কোন রাখঢাক নেই। এটিই ওদের কাছে স্বাভাবিক। আর এই জন্যে কোথায়ও খেতে গেলে ‘লেটস গো ডাচ’ এই কথাটি উচ্চারিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ যার যার বিল সে সে দেবে। এটি তাদের রীতি, যা আমার অপছন্দের। তবে এর যে ব্যতিক্রম নেই তা ভাবার কোন কারণ নেই।

আমাদের পরিচিত, কাছের, পারিবারিক বন্ধু এক তরুণ ডাচ এমপি আছেন। গ্রীন পার্টির। নাম নীলস ফান দেন বের্গ। স্বল্প সময়ের জন্য দুদুবার এমপি হয়েছিলেন। বাংলা মোটামুটি চালিয়ে নেবার মত বলতে পারেন। বিয়ে করেছেন বরিশালের মেয়ে শম্পাকে। চাকরির সুবাদে শম্পার সাথে চেনাশোনা, প্রেম ও বিয়ে। ইতিমধ্যে বাঙালি রীতিনীতি, আচার বেশ শিখেছেন। দেখা হলেই ‘বিকাশ দা কেমন আছেন’ বলে বাঙালির মত আন্তরিকতার সুরে বাসার ভেতরে নিয়ে বসান, আপ্যায়ন করেন। বাংলাদেশে এসে নীলস তো অনেকটা ‘স্টার’ বনে গেলেন হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানদের মধ্যে দিয়ে। ওই অনুষ্ঠানে একটি স্লট আছে যেখানে বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশীরা নাটকগানে অংশ নেন। নীলস সেই অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশ নিতেন। কিছুদিন কাজ করার পর বাংলাদেশে নিজেই একটি এনজিও খুলে বসলেন এবং মোটামুটি বেশ কয়েক বছর কাজ করলেন বাংলাদেশে। এমপি মনোনীত হবার পর হল্যান্ড ফিরে এলেন এবং এখন সেখানেই আছেন। কোথা থেকে কোথা চলে এলাম। বলছিলাম ইউরোপ থেকে আসা ইউরোপীয়দের কথা।

ঢাকায় যে দম বদ্ধ হবার মত দশা তা চট্টগ্রাম এসে কেটে গেল ওদের সবার। বললো, চট্টগ্রামে ঢাকার মত বড় অট্টালিকা, ভবন নেই বটে, তবে এখানে নেই ঢাকার অস্থিরতা। অনেক প্রাণবন্ত চট্টগ্রাম। হেঁটে চলার মত কিছু পথ আছে। যদিওবা সেটিও ঠিক নয়। সবাই উঠেছিলেন চিটাগাং সিনিয়র্স ক্লাবে। ক্লাবের পরিসর, ঝকঝকে তকতকে কামরা। সবার খুব পছন্দ হলো। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট বন্ধু ড. সেলিম চৌধুরী অতিথিদের যেন সামান্যতম অসুবিধা না হয় তার তাবৎ ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। যেদিন ক্লাবে রাতে আমরা সবাই উঠলাম, রাতে খাবার শেষে হ্যারি বলেন, বাইরে একটু হাঁটতে চাই। তখন রাত প্রায় বার। জামালখান এলাকাটা তখন অনেকটা নীরব। আসল কারণ (ছিনতাই ইত্যাদি) না বলে তাকে বলি, অনেক রাত, আমরা বরঞ্চ নিজ নিজ কামরায় ফিরে যাই। তিনি নাছোড়বান্দা, বলেন, ‘তাহলে আমি একা একটু হেঁটে আসি’। অত রাতে তাকে তো একা ছাড়া যায় না। অতএব, আমরা সবাই (প্রফেসর হোলস্ল্যাগ ছাড়া, তিনি ফিরে গেলেন তার কামরায়), আমি, লন্ডন থেকে আসা ক্রিস ও আনসার ভাইআমরা চারজন পাশাপাশি হাঁটতে থাকি। জামালখান এলাকাটা শহরের অন্যান্য স্থানের চাইতে অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন। ক্লাব থেকে বের হয়ে ডানদিকে আমরা হেঁটে চলি। আইডিয়াল স্কুল তক পৌঁছে তাদের বলি, ‘চলো, ইউ টার্ন নেই, ফিরে চলি’। নানা বিষয় নিয়ে গল্প করতে করতে আমরা ডিসি হিল পর্যন্ত পৌঁছি। তারপর আবারো ফিরে আসা। প্রেস ক্লাবের কাছাকাছি আসতেই দেখি উল্টোদিক থেকে হেঁটে আসছেন প্রেস ক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারি দেবদুলাল ভৌমিক। তার সাথে ইউরোপিয়দের পরিচয়পর্ব, ক্ষণিক আলাপ। এর একদিন পর চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব আয়োজন করবে ইউরোপীয় প্রতিনিধি দলের সাথে সাংবাদিকদের মত বিনিময় অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান হবে প্রেস ক্লাবে। আশাতীত সফল ছিল সেদিনের অনুষ্ঠান। পরে আমাদের মধ্যে যখন আলাপ হচ্ছিল তখন তিন ইউরোপীয়দের মন্তব্য হলো, ‘চট্টগ্রামের সাংবাদিকরা ঢাকা জাতীয় প্রেস ক্লাবের চাইতে অনেক ভালো করেছেন, বিষয় নিয়ে তাদের অনেক প্রশ্ন ছিল, তাদের মাঝে প্রস্তুতি ছিল, তাদের মাঝে মুক্তিযোদ্ধাও ছিল।’ সত্যি বলতে কী আমিও যে একটু অবাক হইনি তা নয়। অবাক হয়েছি, মুগ্ধও। মনে হলো, এখনকার রিপোর্টাররা, সাংবাদিকরা অনেক স্মার্ট, ইংরেজি জানেন, বলতে পারেন। আমাদের সময়, অর্থাৎ আশির দশকে যখন সাংবাদিকতা শুরু করি, তখন চট্টগ্রামে খুব কম রিপোর্টার ছিলেন যারা ইংরেজি লিখতে পারলেও খুব একটা ভালো বলতে পারতেন না। সেদিন দেখলাম বেশ কয়েক তরুণ রিপোর্টার ও সিনিয়র সাংবাদিক, প্রেস ক্লাবের নেতৃবৃন্দ চমৎকারভাবে ইউরোপিয়দের সাথে ভাব বিনিময় করলেন। এর আগের দিন চমৎকার সম্মেলনের আয়োজন করেছিল চিটাগাং সিনিয়র্স ক্লাব। ইউরোপীয় ডেলিগেটদের বাড়তি পাওনা ছিল সম্মেলনশেষে সন্ধ্যায় চমৎকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রীতিভোজ। সে নিয়ে লিখবো পরের সংখ্যায়। লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষা উপকরণের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধএশিয়ার লৌহমানবী অভিধায় শেখ হাসিনা