হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৫ মার্চ, ২০২৩ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

ইংরেজিতে একটি কথা আছে– ‘এক্সিডেন্ট কামস একসিডেন্টলি’। কথাটা নানা দেশে প্রযোজ্য হলেও আমাদের দেশে তা কতটুকু প্রযোজ্য সে প্রশ্ন থেকে যায়, যখন পত্রিকার পাতায় কিংবা টিভি পর্দায় প্রতিদিনের সড়ক দুর্ঘটনায় হয় যাত্রী, নয় পথচারী কিংবা চালক, সহকারীর মৃত্যু ও নিহতআহতের সংবাদ দেখি।

 

অন্যান্য দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ‘এক্সিডেন্টলি’ এলেও আমাদের দেশে এটি আসে অনেকটা স্বাভাবিক নিয়মে। আমরা ধরেই নিয়েছি সড়কে দুর্ঘটনা ঘটবেই এবং প্রতিদিন, দেশের কোথায়ও না কোথায়ও তা ঘটছে। এর থেকে যেন পরিত্রাণ নেই আমাদের। কেবল আমাদের দেশেই বোধকরি ট্রাফিক সিগন্যাল বাতিগুলি

অসহায়ের মত তাদের রং বদলায় ক্ষণে ক্ষণে। কারো সেদিকটায় কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। না চালকের, না পথচারীর। কোথাও কোথাও ট্রাফিক পুলিশ কিংবা সার্জেন্টকে রাস্তার মাঝে কিংবা একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, হাতে ওয়াকিটকি জাতীয় যন্ত্র। কোনো কোনো স্থানে তাদের সক্রিয় হতে দেখা যায়

ট্রাফিক ব্যবস্থাকে একটু মানুষকরতে, কখনোসখনো কিছুটা সফল হন, বেশির ক্ষেত্রে ব্যর্থ। অনেক স্থানে তারা হাল ছেড়ে দিয়ে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে প্রাইভেট কার, বাস, মিনি বাস, সিএনজি, রিক্সা, মোটর সাইকেল, পথচারীর ‘এক্রোবেটিক মুভমেন্ট’ দেখেন। ট্রাফিক ব্যবস্থার এমন বেহাল দশা তাদের পক্ষে

আসলে আদৌ সম্ভব নয় আয়ত্তে আনা। প্রতিদিনকার এই দৃশ্য দেখে মনে হয়, আমরা সবাই যেন অনিয়মটাকে নিয়মে দাঁড় করিয়ে দেবার এক বিশ্রী অসম প্রতিযোগিতায় নেমেছি। আর এর জন্যে কেবল চালক নন, দায়ী আমরা সবাইযাত্রী থেকে শুরু করে পথচারী, আইনপ্রয়োগকারী ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা সবাই। কে

কার আগে যাবে তার একটা অসম প্রতিযোগিতা আমাদের সবার মাঝে। কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নই। একটু ফাঁক পেলেই সিএনজি, গাড়ি, রিক্সা তার সামনের চাকা ঢুকিয়ে দেবে। পথচারীও। বেপরোয়া বাসচালক তার বাহন চালিয়ে উঠিয়ে দেবে পথচারী বা সড়কের পাশের দোকানে, বাড়িতে।

তাতে চালক গ্রেপ্তার হলে, শাস্তি পেলে শুরু হবে আন্দোলন। বাড়বে যাত্রীদের আরো ভোগান্তি। ফলে চালক বেপরোয়া হবেই। সে জানে অন্যায় করলে তাকে আইনের ফাঁক গলিয়ে বের করে নিয়ে আসবে তার অর্থবান মালিক, যিনি কেবল অর্থবান নন, ক্ষমতাবানও, হয়তো সরকারি রাজনীতি সাথেও আছে তার সংশ্লিষ্টতা।

আমাদের দেশে যানবাহনের ক্ষেত্রে এই যে অব্যবস্থা তার পেছনে মূল যে কারণ সেটি হলো আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব। তা না হলে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ভিন্ন চিত্র আমরা দেখতে পাই কী করে। এই এলাকায় ট্রাফিক সিস্টেম গোটা দেশের যে চিত্র তার একেবারে উল্টো হতে পারে কী করে? দেখা যায় যে

ড্রাইভারটির ঢাকার সড়কে আইন অমান্য করে চলা অভ্যেস, সেই একই চালক ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশ মাত্র তার গাড়িচলার ধরন বদলায়। তার অর্থ কি এই যে ‘ডাণ্ডা না হলে ঠাণ্ডা’ না হবার অভ্যেস আমাদের? প্রতিদিন যে হারে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মৃত্যুবরণ করে তাতে আর আজকাল আমাদের মনে তেমন

দাগ কাটে বলে মনে হয় না। এ যেন রোজা এলে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উর্ধ্বমুর্খী মূল্যের মত। আমরা যেমন মেনে নিয়েছি রোজা এলেই জিনিস পত্রের দাম বাড়বে, তেমনি মেনে নিয়েছি সড়ক দুর্ঘটনায়ও প্রতিদিন মানুষ মরবে। এ আর নতুন কী! যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে দেখলাম ২০২২ সালে

গোটা দেশে ৬৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় দশ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে, আহত হয় প্রায় তের হাজার। শিক্ষার্থীর মৃত্যুর হারও বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে, শতকরা ১৬% ভাগ। এই সংখ্যা তারা প্রকাশ করেছেন কেবল মাত্র পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে। অনেক দুর্ঘটনা দিনের আলো দেখে না।

সেই অর্থে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা যে আরো অনেক বেশি তা বলা বাহুল্য। সমিতির মতে ২০১৫ সালের তুলনায় গাড়ি রেজিস্ট্রেশন বিশেষ করে মোটরসাইকেল, ইজিবাইক বেড়েছে চারগুণ। আর ২০২১ সালের তুলনায়, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা বেড়েছে যথাক্রমে ১৯,৮৯% ও ২৭,৪৩% ভাগ। কেবল যে আইন অমান্য করে গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে তা ভাবার কোনো কারণ নেই। অনেক গাড়ির কোনো ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই।

টাকা দিলেই মিলছে রেডিমেইডফিটনেস সার্টিফিকেট। কোনোগাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে, কোনোগাড়ির নেই তা আমরা কেবল তখনই শুনি যখন কোনো গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটায়। তখনই তদন্তে বেরিয়ে আসে যে দুর্ঘটনা ঘটানো গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল না। এখন প্রশ্ন এই অতীব প্রয়োজনীয়

সার্টিফিকেট ছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কী করে ওই গাড়িকে রাস্তায় নামতে দিলেন। আর যাদের এই সার্টিফিকেট আছে কী নেই, তা দেখার কথা যাদের তারা কি তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করছেন? অন্যদিকে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় চালকদের বিশেষ করে বাসট্রাক চালকদের দীর্ঘ সময় ধরে একটানা গাড়ি চালাতে

হয়। কোনো বিরতি নেই তাদের এই চলার। গত ১৯ মার্চ যে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটলো তাতে ১৯ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে। জানা যায়, খুলনা থেকে আসা ইমাদ পরিবহনের এই বাসটি পদ্মা সেতুতে উঠার আগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে ছিটকে পড়ে। যে সমস্ত দুর্ঘটনা ঘটে তার অন্যতম কারণ গাড়ির

ফিটনেস সার্টিফিকেট না থাকা। ইমাদ পরিবহনের যে বাসটি তারও ছিল না কোনো ফিটনেস সার্টিফিকেট। তার উপর জানা যায় বাসটির চালক ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বাস চালিয়েছিলেন, ফলে ছিলেন ক্লান্ত। একটানা দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালানোর পেছনে আর একটি কারণ হলো দেশে চালকের সংখ্যা কম।

অন্যদিকে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় হেলপার বসেছে চালকের আসনে। ফলে বাড়ে দুর্ঘটনা। এমনটি হরহামেশা দেখা যায়। কিশোর চালকের আসনে বসে গাড়ি চালাচ্ছে পুলিশের চোখের সামনে। কিন্তু পার পেয়ে যায়। কীভাবে সে কি আমাদের অজানা? এখন প্রশ্ন হলো, এতো মৃত্যুর দায় কে নেবে? বাসের মালিক?

বিআরটিএ? আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। কে? জানিনে। কেবল জানি একে অন্যের উপর দায় চাপাবে। এড়িয়ে যাবে নিজের দায়বদ্ধতা। যেমন বিআরটিএর চেয়ারম্যান এই বলে নিজের দায় এড়িয়ে যেতে চাইলেন যে ‘অনুমতি না থাকার পরও যদি সড়কে গাড়ি চলে সেটি বাস্তবিক অর্থে বিআরটিএর দেখার সুযোগ

নেই’। সড়ক দুর্ঘটনায় কেবল যে অমূল্য প্রাণ যায় তা নয়। সড়ক দুর্ঘটনায় বছরের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। বছরে এই যে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ তা পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয়ের চাইতেও বেশি বলে একটি পত্রিকার এক সংবাদে দেখলাম। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় দেখি গাড়িপথে

চলে পথচারী, সড়ক দখল করে দাঁড়িয়ে আছে ভ্যান তাতে সবজি, মাছ, পিয়াজ রসুন থেকে শুরু করে পেয়ারা, কুলসহ নানা ধরনের ফল। পথচারীর হাঁটার কোনো পথ নেই, বাধ্য হয়ে তাকে হাঁটতে হয় গাড়ি রাস্তা ধরে। এঁকেবেঁকে তাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এমন অব্যবস্থা থেকে

কি পরিত্রাণের কোনো পথ নেই?

ইউরোপের দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। সাতসমুদ্দুর পাড়ি দেবারও প্রয়োজন নেই। কাছেই পাশের দেশ নেপালের দিকে তাকাই। সেখানে যানজট দেখেছি। কিন্তু যানগুলি সারিবদ্ধভাবে সড়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। একে অন্যকে ডিঙিয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছে না। এক সময় আপনাতেই জট খুলে

যাচ্ছে। যেখানে ট্রাফিক সিগন্যাল সেখানে বাতির রং দেখে গাড়ি থামছে আর চলছে। যেখানে ট্রাফিক সিগন্যাল নেই সেখানে গাড়িচলাচল করছে দুটি হাতের উঠানামার উপর, ট্রাফিক পুলিশের। দেখে অবাক হয়েছি, ট্রাফিক আইনের প্রতি নেপালি জনগণের শ্রদ্ধা দেখে লজ্জিত হয়েছি। আমাদের নাকবোঁচা নেপালি

চালক বলে, নেপালে ট্রাফিক আইন খুব কড়াকড়ি। উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে দেশ বলে যখন আমরা আমাদের গলা ফাটাই, তখন এই সমস্ত ছোটখাটো অথচ অত্যন্ত জরুরি বিষয়ে নেপালের চাইতেও আমাদের পিছনে পড়েথাকা দেখি, তখন আর কারো হয় কিনা জানিনে, আমার লজ্জা হয়, মনে হয় মিথ্যে বড়াই আমাদের। কবে হবে এ থেকে আমাদের উত্তরণ!

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বীকৃতিহীন গণহত্যার রজনী : ২৫ মার্চ
পরবর্তী নিবন্ধঅর্থবহ স্বাধীনতার প্রাসঙ্গিক ধারা