এই প্রথম আমার টুঙ্গিপাড়া আসা। কেবল এই গ্রামে নয়, গোপালগঞ্জে আমার এই প্রথম আসা। গোপালগঞ্জ শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে টুঙ্গিপাড়া। অনেকের মতে, এক সময় পারস্য এলাকা থেকে এক দল মুসলিম সাধক এই এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছিলেন। এলাকাটি নিচু হওয়ায় তারা সেখানে ‘টং-ঘর’ বানিয়ে বাস করতে শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে এই টং থেকে এই এলাকার (গ্রাম) নাম হয় টুঙ্গিপাড়া। এখন সেখানে গড়ে উঠেছে পাকা রাস্তাঘাট, দালানকোঠা। তারপরও কোথায়ও কোথায়ও টংঘর দেখা যায় বলে শুনেছি, যদিও তেমনটি সেখানে আমার স্বল্প সময়ের অবস্থানকালে চোখে পড়েনি। গোপালগঞ্জে বয়ে গেছে মধুমতি ও বাঘিরার নদী। বাঘিরার তীরেই টুঙ্গিপাড়া। জাদুঘর পেরিয়ে এগিয়ে যাই বঙ্গবন্ধুর সমাধির দিকে। যেন সব পথ সেখানে এসে থেমেছে। চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ। জুতা খুলে ভেতরে প্রবেশ করি। সৌধের উপরিভাগ এমনভাবে তৈরি যাতে দিনের আলো এসে ভেতরে পাশাপাশি তিনটি কবরের উপর পড়ে।
তিন কবর নিয়েই গড়ে উঠেছে গোলাকৃতি গম্বুজবিশিষ্ট মূল সমাধিসৌধ। মোট ৩৮,৩০ একর জমিতে এই সমাধিসৌধ। মা-বাবার পাশাপাশি দুটি কবর থেকে হাত দেড়েক-দুয়েক দূরত্বে শুয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু। দর্শনার্থীদের কেউ কেউ দু-হাত তুলে মোনাজাত করছেন। কেউ নীরবে, অনিমেষ দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর সমাধির দিকে তাকিয়ে আছেন। সেদিকে দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে আমিও দাঁড়িয়ে থাকি। মনে মনে প্রার্থনা করি এই মহান ব্যক্তিটির আত্মার কল্যাণ কামনায়, যিনি জীবনের সিংহভাগ ব্যয় করেছেন জেলের ভেতর, জীবন দিয়েছেন দেশ ও জনগণের জন্যে। ঘাতক গোষ্ঠী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে। তার অপরাধ ছিল তিনি চেয়েছিলেন বাঙালির ন্যায্য অধিকার, বাংলার স্বাধীনতা। সমাধিস্থলে ধারে-কাছে ছিলেন হ্যাংলা-পাতলা গোছের স্থানীয় এক ব্যক্তি। টুঙ্গিপাড়া তার বাড়ি। স্বপ্রণোদিত হয়ে তিনি সমাধির একটি বন্ধ দরোজা দেখিয়ে বলেন, ‘এই দরোজাটি সব সময় বন্ধ থাকে। কেবল বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা এলে তিনি এই দরোজা দিয়ে সমাধিস্থলে প্রবেশ করেন’। গোলাকৃত এই সমাধিস্থল। লাল সিরামিক ইট আর সাদা-কালো মার্বেল পাথরের সংমিশ্রণে তৈরি এই সমাধিসৌধের দিকে তাকিয়ে এর কারুকাজ দেখি। মুগ্ধ হই। চতুর্দিকে কালো, মাঝে সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে জাতির পিতার সমাধি।
একটু সামনের দিকে যেতেই দেখি উইলিয়াম (ডাচ উচ্চারণে ভিলেম) ও তার স্ত্রী তাজিন। পুরো নাম প্রফেসর ড. উইলিয়াম ফান দের খেইস্ট ও প্রফেসর ড. তাজিন মোর্শেদ। দুজনেই আমাদের পারিবারিক বন্ধু। তাজিন আপা প্রফেসর খান সরওয়ার মুর্শিদের মেয়ে। একাত্তরে তিনি (প্রফেসর মুর্শিদ) ছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্লানিং কমিশনের সদস্য। ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৭২-৭৫)। সফল কূটনীতিবিদ হিসাবে তিনি পোল্যান্ড, চেকোস্লাভিয়া ও হাঙ্গেরিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ সালের ৮ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করলে তাকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়। ইউলিয়াম ও তাজিন আপাকে দেখে ভালো লাগে। ওরা দুজন তখন বঙ্গবন্ধুর সমাধির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। ড. তাজিন মুর্শেদ যাকে তাজিন আপা ডাকি, পাশ ঘেঁষে কানের কাছে মুখ নিয়ে দুষ্টুমি করে বলি, ‘মনে হয় চেনা চেনা’। আমাকে এই সময় এই স্থানে দেখে তাদের দুজনের অবাক হবার পালা। আমার দশাও ভিন্ন নয়।
সমাধিস্থল থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে একে অন্যকে জিজ্ঞেস করি, কখন আসা হয়েছে, কদ্দিন থাকা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। অপ্রত্যাশিত কিছু হঠাৎ করে পেলে যেমন এক ধরণের ভালো লাগায় পেয়ে বসে, উইলিয়াম ও তাজিন আপাকে দেশে দেখে আমার অনুভূতি অনেকটা সেরকম। তাদের সাথে বাংলাদেশের আরো জনা-কয়েক নিকট বন্ধু। সবাই মিলে এক সাথে ছবি তোলা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খানিক আলাপ। তারপর আমাদের আবারো চলা, ভিন্ন পথে। উইলিয়াম, তাজিন আপার সাথে শেষ দেখা গেল বছর অক্টোবরে, জেনেভায়, জাতিসংঘ ভবনে। বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যা শীর্ষক এক আলোচনায় বক্তা হিসাবে এসেছিলেন ড. তাজিন মুর্শেদ। সঙ্গী হয়েছিলেন উইলিয়াম। জেনেভায় আমরা সবাই উঠেছিলাম রেল স্টেশনের কাছাকাছি এক হোটেলে। এর সপ্তাহ খানেক পর বেলজিয়াম ওদের বাসায়, তাজিন আপার জন্মদিন উপলক্ষে উইলিয়ামের দেয়া এক পার্টিতে। দুশো কিলোমিটার পথ গাড়ি চালিয়ে সুমনা সহ গিয়েছিলাম তাতে যোগ দিতে।
যাই হোক- দৃষ্টিনন্দন বঙ্গবন্ধুর এই সমাধিসৌধের ডিজাইন করেছেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা স্থপতি এহসান খান। তিনি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিসৌধ, হাতিরঝিল উন্নয়ন প্রকল্প, গুলশান-বনানী লেইক ব্রিজ সহ আরো অনেক দৃষ্টি-কাড়া নকশা বানিয়েছেন। আগের সংখ্যায় জানিয়েছিলাম, মূল প্রবেশ ফটক পেরিয়ে ডানদিকে কয়েকটি স্যুভেনিয়র শপ, জাদুঘর, তার নিচ তলায় প্রায় ছয় হাজার বইয়ের সংগ্রহ সহ পাঠাগার, গবেষণা কেন্দ্র, প্রদর্শনী কেন্দ্র, মসজিদ রয়েছে। রয়েছে গ্যালারি-প্যাটার্নে তৈরি উন্মুক্ত মঞ্চ, পাবলিক প্লাজা, ক্যাফেটেরিয়া। সমাধিস্থলের দিকে এগিয়ে যেতে হাতের বাঁ দিকে চোখে পড়ে পুকুর, তাতে সাইনবোর্ডে লেখা ‘শেখ পরিবারের ঐতিহ্যবাহী বড় তালাব (পুকুর)’। এর পাশ ঘেঁষে বড় সড় শতবর্ষী আম হিজলের বাগান। গোপালগঞ্জ আসার পথে পথের-ধারে রেস্তোরাঁ ‘সাম্পান’, যেখানে আমরা থেমেছিলাম সেখানেও চোখে পড়েছিল একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা- ‘শতবর্ষী আম গাছ’। তবে কোনটি যে শতবর্ষী আর কোনটি যে অর্ধ কিংবা সিকি-শতবর্ষী আমগাছ তা আর জানা হয়নি। চোখে পড়েনি। খুঁজলে হয়তো পাওয়া যেত। ইচ্ছে ছিল খুঁজে দেখার। কিন্তু সময় ছিল না।
আমরা যখন বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম তখন বেশ দর্শনার্থী। দেশের নানা অঞ্চল থেকে আসা। সকল বয়েসী। সদ্য বিবাহিত দম্পতিও চোখে পড়লো। আমার সাথে ১১ বছরের নাতি তুষার। তাদের দেখে বলে, মনে হয় হানিমুন করতে এসেছে। পাঁকা ছেলে বটে! টুঙ্গিপাড়ার বাইগার নদী-পাড়ে ১৯৯৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ‘বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ’ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। বঙ্গবন্ধুর ৭৯তম জন্মবার্ষিকীতে অর্থাৎ ১৯৯৯ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন এই সমাধিসৌধের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন এবং এর দু-বছর বাদে নির্মাণ কাজ শেষ হলে বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সমাধি সৌধ কমপ্লেক্স উদ্বোধন করেন। সেই অবধি, বলা চলে তারও আগে থেকে এখানে প্রতিদিন নামে মানুষের ঢল, নানা বয়েসী, নানা বিশ্বাসে বিশ্বাসী জনগণ, দেশি-বিদেশি।
ইচ্ছে ছিল আরো খানিক দাঁড়িয়ে যাবো। আরো সময় নিয়ে, স্থানীয় কারো কারো সাথে কথা বলে জেনে নেব বঙ্গবন্ধুর কথা। খুব ইচ্ছে ছিল বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখেছে, জেনেছে তেমন কাউকে খুঁজে বের করে তার সাথে কথা বলবো। কিন্তু সময় বৈরী। আমাদের শুরু হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে ফিরে চলা। গাড়িতে উঠে কারো কারো খেয়াল হলো দুপুরের খাওয়া হয়নি। ঠিক হলো পদ্মা ব্রিজ পেরিয়ে মাওয়া-প্রান্তে শিমুলিয়া ঘাট রোডে ‘প্রজেক্ট ইলিশে’ গিয়ে ইলিশ খাওয়া হবে। সেখানে আমরা যখন পৌঁছি তখন আঁধার নেমেছে, গায়ে প্রচণ্ড শীত জড়িয়ে। কুশায়ায় ঢাকা গোটা এলাকা। সকালে যখন রওনা দেই, তখন ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি সন্ধ্যের দিকে এমন ঠান্ডা নামবে। আঁধো-অন্ধকারে বিশাল সাইজের ইলিশ মাছের আদলে তৈরি এই চমৎকার রেস্তোরাঁটি বেশ ভালো লাগলো। পরিস্কার, গোছালো। ইলিশ বেছে নিয়ে আপনার সামনেই রান্না বা ভেজে দেবে- কিংবা আপনি যেভাবে চাইবেন সেভাবে তৈরি করে দেবে। এ যেন ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’।
আমরাও কিলো ওজনের একটি ইলিশ বেছে নিয়ে শর্ষে দিয়ে রান্না করতে বললাম। সাথে কয়েক পদের ভর্তা, তার মধ্যে একটি ইলিশ লেজ ভর্তা। খাওয়া তো দূরের কথা এই প্রথম শুনলাম ও খেলাম লেজ ভর্তা। রাত আটটা নাগাদ প্রজেক্ট ইলিশ ছেড়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলে ঢাকার দিকে। লক্ষ্য উত্তরা, ভাইপো ঋত্বিকের বাসা। তুষারের তীব্র ইচ্ছে বাসার-ছাদে গিয়ে থার্টি ফাষ্ট নাইটের আতশবাজি পোড়ানোর মচ্ছব দেখবে। আর কয়েক ঘন্টা পরেই ইংরেজি নূতন বছর ২০২৩। কিন্তু না, ঢাকা ঢোকার সাথে সাথে আমাদের গোটা দিনের যে আনন্দ, ভালো লাগা তা নিমিষেই মিইয়ে যায়। অসহনীয় যানজট। অনেক রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে প্রশাসনের তরফ থেকে। আমাদের গাড়ি আক্ষরিক অর্থে দাঁড়িয়ে থাকে শহরের অনেক পয়েন্টে। মাওয়া থেকে উত্তরা পৌঁছুতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। তিলোত্তমা ঢাকাকে অসহ্য ঠেকে। মনে মনে বলি, ঢাকায় গাড়ি পথে আর দূরের রাস্তায় যাওয়া নয়। ঢাকার রাস্তায়ই আমরা ২০২২ সালকে পিছু রেখে আসি। যখন বাসায় এসে পৌঁছি তার অনেক আগেই নূতন বছর ২০২৩ তার আগমনী বার্তা জানিয়ে যায়।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট












