হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)-এর সাথে সাক্ষাৎ ও স্মৃতিকথা

মো. গোলাম রসুল | মঙ্গলবার , ১১ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

বাবাজান শাহানশাহ্‌ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) ১৯২৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর মাইজভাণ্ডার শরিফে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শাহ্‌ সুফি হযরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (ক.)। মহান আল্লাহ্‌ যুগের প্রয়োজনে অলি আল্লাহ্‌গণের দ্বারা যুগ সংস্কার ও মানবজাতির কল্যাণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের পথ সুগম করেন। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) এর ওফাতের পর ইসলাম ধর্মকে বিভিন্ন সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার তাগিদেই ধর্ম সংস্কারক হিসেবে অলি আল্লাহ্‌গণকে মহান আল্লাহ্‌ দুনিয়াতে প্রেরণ করেন। এমনই একজন অলি আল্লাহ্‌ ছিলেন শাহানশাহ্‌ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি নির্বিশেষে প্রত্যেকেই তাঁর দরবারে যেতে পারতেন। মহান আল্লাহ্‌কে সম্যকভাবে জানার তত্ত্বজ্ঞান অর্থাৎ মারিফাতের উচ্চতম শিখরে তিনি আরোহণ করেছিলেন। তাসাওউফ সাধনার ক্ষেত্রে তিনি নিজস্ব রিয়াজত বলে খোদায়ী ইচ্ছা শক্তি ও হিকমত অনুযায়ী নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাই জাগতিক কোনো বিষয় তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারেনি, যদিও তিনি সংসার ধর্ম পালন করেছিলেন। তিনি আল্লাহ্‌র নিকট নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন এবং সৎ কর্মশীল হওয়ার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্‌কে জানার চেষ্টা করেছেন। ফলে আল্লাহ্তায়ালা তাঁকে সুনিশ্চিতভাবে হেদায়ত ও সৎপথ প্রদর্শন করেছিলেন। ‘আল্লাহু আল্লাহু’ যিকিরের মাধ্যমে তিনি মহান আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভ করেছিলেন। কোরআন শরিফে সূরা ‘আহাক্বাফ’-এর ১৩নং আয়াতে মহান আল্লাহ্‌ বলেন, ‘যারা বলে, আমাদের প্রতিপালক তো আল্লাহ্‌এবং এ বিশ্বাসে অটল থাকে, তাদের কোনো ভয় নেই, আর তারা দুঃখিতও হবে না। তারাই হবে জান্নাতের অধিবাসী। সৎকর্মের পুরস্কার হিসেবে সেখানে তারা থাকবে চিরকাল।’
বাবাজানের সঙ্গে আমার ১৯৮৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম সাক্ষাত হয়। বাবাজান তখন চট্টগ্রাম বন্দরের তদানীন্তন নির্বাহী প্রকৌশলী আলী নবী চৌধুরীর অফিসার্স কলোনীর বাসায় ছিলেন। সন্ধ্যা বেলায় আমি আলী নবী চৌধুরীর বাসায় গিয়ে বাবাজানের সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম। আলী নবী চৌধুরী বাবাজানের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। কিন্তু বাবাজান বললেন, ‘গোলাম রসুলকে হযরত শাহ্‌ আমানত (র.) এর রওযাপাক যিয়ারত করে আসতে বলেন।’ তখন আমি হযরত শাহ্‌ আমানত (র.) এর মাযার যিয়ারত করতে গেলাম। তিনিও একজন উচ্চ স্তরের আউলিয়া ছিলেন। আমি তাঁর রওযাপাক যিয়ারত করে পুনরায় সল্টগোলা অফিসার্স কলোনীতে ফিরে এলাম। আলী নবী চৌধুরীকে পুনরায় বাবাজানের সাক্ষাতের অনুমতি নিতে বললাম। একটু পরে অর্থাৎ রাত প্রায় ১০টা নাগাদ বাবাজান তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দিলেন। আমি ভেতরে গিয়ে বাবাজানকে সালাম দিলাম। তিনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ‘রাত হয়েছে, বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করুন।’ তখন আমি চট্টগ্রাম বন্দরের ১৮ নম্বর বাংলোতো থাকি এবং সেখানে ফিরে গেলাম। কিন্তু মহান অলির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি সারারাত আমার মনে জাগ্রত থাকলো। তারপর থেকেই বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জায়গায় বাবাজানের সঙ্গে আমি দেখা করতে গিয়েছি এবং তিনি আমাকে সাক্ষাত দানে ধন্য করেছেন।
পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যেই খবর পেলাম বাবাজান তাঁর ভক্ত মীর আহমদের সিডিএ কলোনীর বাসায় অবস্থান করছেন। তখন আলী নবী চৌধুরী, অফিসার্স কলোনীর পেশ ইমাম মাওলানা আহম্মদ সাঈদ এবং আমি একদিন সকালে জনাব মীর আহমদের বাসায় বাবাজানের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। গিয়ে দেখি বাবাজান একটি কক্ষে দরজা বন্ধ করে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন। তখন দরজায় দাঁড়িয়ে মাওলানা আহমদ সাঈদ একটি ফারসি শের বাবাজানের উদ্দেশ্যে নিবেদন করলেন। তখন বাবাজান দরজা খুলে বেরিয়ে আসলেন এবং মীর আহমদকে নাস্তার আয়োজন করতে বললেন, মীর আহমদ সকালের নাস্তার আয়োজন করলেন এবং বাবাজানকে কবুল করতে বললেন। তখন বাবাজান আমাদের সঙ্গে নাস্তার টেবিলে বসলেন এবং চা পান করলেন। নাস্তা খাওয়া শেষ হলে বাবাজান একটি ক্যারম বোর্ড আনতে বললেন। মীর আহমদ ক্যারম বোর্ড এনে দিলে বাবাজানের সঙ্গে আমি ক্যারম খেলায় অংশ নিলাম। ইতিমধ্যে আলী নবী চৌধুরী বললেন, ‘গোলাম রসুল সাহেব ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (প্রশাসন) হিসেবে বন্দরে কাজ করছেন। বাবাজান, আপনি তাকে পদোন্নতি দিয়ে দেন।’ তখন বাবাজান পানির জগ থেকে এক এক করে সাত গ্লাস পানি আমাকে খাওয়ালেন। তারপর বললেন, ‘আলী নবী মামা, গোলাম রসুলকে পদোন্নতির আদেশ দিয়ে দেন।’ তারপর আমরা বাবাজানের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে যার যার বাসায় চলে এলাম। কিছুদিনের মধ্যেই বন্দরের চেয়ারম্যান আমার পদোন্নতির জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করলেন। এভাবে আমার পদোন্নতি হয়ে গেলো বাবাজানের আশীর্বাদে ও মহান আল্লাহ্‌তায়ালার মেহেরবাণীতে।
তারপর বন্দরের চীফ পার্সোনেল অফিসার এ এন এম এ মোমিন, আলী নবী চৌধুরী ও আমি মাইজভাণ্ডার শরিফ যাওয়া শুরু করি। কিন্তু তখনও আল্লাহ্‌র অলির সম্পর্কে আমার তেমন জ্ঞান ছিল না। ইতোমধ্যে কেসি দে রোডে হোটেল টিউলিপে সৈয়দ নুরুল বখতিয়ার মামা ও জামাল আহমদ সিকদার এর সঙ্গে আমাকে আলী নবী চৌধুরী সাক্ষাত করিয়ে দেন। বখতিয়ার মামা ও জামাল আহমদ সিকদারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় দেখা করে আমি বাবাজান সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে অবহিত হই।
মহান আল্লাহ্‌তায়ালা সূরা বাকারার ১১১-১১২ নং আয়াতে বলেন, “ওরা বলে, ‘ইহুদী বা খ্রিস্টান ছাড়া অন্য কেউ কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ এটি ওদের মিথ্যা প্রত্যাশা। বলো, ‘তোমরা সত্যবাদি হলে এর সপক্ষে প্রমাণ পেশ করো।’ আসল সত্য হচ্ছে, তোমাদের মধ্যে যারাই আল্লাহ্‌তে পুরোপুরি সমর্পিত হবে এবং সৎকর্ম করবে, প্রতিপালক অবশ্যই তাদের যথাযোগ্য প্রতিফল দেবেন। তাদের কোনো ভয় বা দুঃখ থাকবে না।’ ধর্মসাম্য বা তৌহিদে আদ্বিয়ানের কাছে যে সব ধর্মের নৈতিক লক্ষ্য বস্তু একক তার সমর্থনে বাবাজান শাহানশাহ্‌ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) ফানা ফিল্লাহ্‌ ও বাকা বিল্লাহ্‌র স্তরে উন্নীত হওয়ার সাধনায় ব্যাপৃত ছিলেন এবং তিনি তা অর্জন করেছিলেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
বাবাজানের সঙ্গে আমার অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তার মধ্যে বিশেষ কয়েকটি উল্লেখ করা হলো:
(১) ১৯৮৬ সালের কোনো এক সময় আলী নবী চৌধুরী ও এ এন এম এ মোমিন সাহেবের সঙ্গে দরবার শরিফ যাচ্ছিলাম। পথে আমার খুব জ্বর আসলো। জ্বর নিয়েই বাবাজানের কাছে গিয়ে সালাম দিলাম। তিনি তখন বললেন, ‘মেহমান খানায় গিয়ে গরুর মাংস দিয়ে ভাত খান, জ্বর ছেড়ে যাবে।’ আমি তাই করলাম এবং তৎক্ষণাৎ জ্বর ছেড়ে গেলো।
(২) একদিন সন্ধ্যা বেলায় এ এন এম এ মোমিন সাহেব, আলী নবী চৌধুরী ও আমি দরবার শরিফ গেলাম। গিয়ে দেখলাম বাবাজান হুজরা শরিফের দরজা বন্ধ করে অবস্থান করছেন। আমরা সালাম দিলে তিনি কিছুক্ষণ পরে যেতে বললেন। অনেকক্ষণ পর আমরা আবার সেখানে গিয়ে বাবাজানকে সালাম দিলাম। তখন তিনি বললেন, “আমি (বাবাজান) হযরত শাহ্‌ জালাল (র.) এর সঙ্গে মিটিং করছিলাম। তাই আপনাদেরকে বিলম্বে আসতে বলেছিলাম।”
(৩) চট্টগ্রাম বন্দরের তদানীন্তন সিএমও ডাক্তার মান্নান সাহেব এর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দরবার শরিফ গেলাম। সেখানে গিয়ে বাবাজানকে সালাম দিলে তিনি ডা. মান্নান সাহেবের ভাইকে পাশের গ্রামে যেতে বললেন। কারণ সেখানে দুইদল লোক মারামারিতে লিপ্ত ছিল। বাবাজান বললেন, ‘আপনি দ্রুত সেখানে গিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে মীমাংসা করে দিবেন।’ পরে আমরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম যে ঐ গ্রামে সত্যিই দুইদল মারামারিতে লিপ্ত ছিল।
(৪) একদিন (যতদূর মনে পড়ে এটি ১৯৮৭ সালের ঘটনা) বাবাজান বন্দর হাসপাতালে ডা. মান্নানের চেম্বারে আসলেন। ডা. মান্নান আমাকে ফোন করলে বন্দর ভবন থেকে আমি সেখানে গেলাম। বাবাজান আমাকে তাঁর গাড়িতে তুলে বেতবুনিয়া নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে বাবাজান বললেন, পাহাড়ের দিকে তাকান, আমি তখন পাহাড়গুলোর দিকে তাকালাম। তখন বাবাজান বললেন, ‘রাতে এ পাহাড়ে আমরা আসি এবং সেখানে খুব ভয় থাকে।’ আমি বললাম, ‘বাবাজান, আপনি তো আল্লাহ্‌র অলি, আপনার ভয় কী’ তখন তিনি বললেন, ‘অলিদের মিটিং এ অনেক ভয়ংকর জীব জানোয়ার আসে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধহযরত শাহজাহান শাহ্‌ (রা.)
পরবর্তী নিবন্ধসাহিত্যে নোবেল ও কথাসাহিত্যিক আনি এরনো