আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর সৃষ্টির সেরা মানব জাতিকে শ্রেষ্ঠত্ব ও পরিপূর্ণতার স্তরে পৌঁছানোর জন্য নবীকুল শ্রেষ্ঠ, রসূলকুল সরদার ও আল্লাহ্ তা’আলার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি, আমাদের আক্বা ও মাওলা হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম–এর মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে শ্রেষ্ঠতম দ্বীন ইসলাম দান করেছেন। এ দ্বীনের যাহেরী (বাহ্যিক) দিক ‘শরীয়ত’কে সুন্দর ও সাবলীলভাবে প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছেন এ দ্বীনের দক্ষ ও নিষ্ঠাবান ওলামা–ই কেরাম। আর এর বাত্বেনী (আত্মিক/অভ্যন্তরীণ) দিক ‘ত্বরীক্বত’, ‘মা’রিফাত’ ও ‘হাক্বীক্বত –এর যথাযথ দীক্ষা দিচ্ছেন ও প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছেন হক্বক্বানী– রব্বানী পীর–মাশাইখ, আউলিয়া কেরাম। হযরত আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহ্ তেমনি এক মহান ওলী।
মহান মুর্শিদ, সিলসিলাহ্–ই আলিয়া ক্বাদেরিয়া সিরিকোটিয়ার মহান শায়খ পীরে কামিল, মুর্শিদ–ই বরহক হযরতুল আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহ্ এমনই এক মহান দ্বীনি পথ–প্রদর্শক।
তিনি একাধারে সুন্নী আক্বীদার প্রবাদ পুরুষ, শরীয়তের এক দক্ষ আলিমে দ্বীন ও দ্বীনি শিক্ষা প্রসারের পথিকৃত, পীর–ই ত্বরীক্বত এবং আল্লাহ্র এক মহান ওলী। তিনি এ উপমহাদেশে বরং সুন্নী দুনিয়ায় সহীহ্ আক্বীদা (সুন্নী আক্বীদা) সমৃদ্ধ এবং শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের অনন্য সমন্বিত ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠায় এক যুগান্তকারী অবদান রেখেছেন।
জন্ম : হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহ ১৮৫৬ সালে পাকিস্তানের উত্তম–পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হাজারা জিলার সিরিকোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিতার দিক দিয়ে হাসানী এবং মাতার দিক দিয়ে হোসাঈনী। তাই তিনি নজীবুত্ব ত্বরফাঈন।
তাঁর বংশ–পরম্পরা হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা হয়ে রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছে। সুতরাং তিনি রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম– এর ৩৮তম অধস্তন বংশধর।
শিক্ষা : অতি অল্প বয়সে তিনি পবিত্র ক্বোরআন হিফয (মুখস্থ) করে নেন। এরপর তিনি ইলমে ক্বিরাআত, ফিক্বহ্, আক্বাইদ, দর্শন (মানত্বিক), তাফসীর এবং হাদীস শরীফ ইত্যাদি বিষয়ে বুৎপত্তি অর্জন করেন। তিনি ১৮৮০ ইংরেজি সালে প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি স্বরূপ ‘ফাযিল সনদ’ লাভ করেন। তাঁর সনদে লিখিত হিজরী সন হিসেবে ১২৯৭ হিজরী এবং শা’বান মাস উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর তিনি ভারতে গিয়ে সেখানকার প্রসিদ্ধ মাদরাসাগুলো থেকে দ্বীনি বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। আরেক বর্ণনা অনুসারে ১২৯৭ হিজরীর শা’বান মাসে তাঁকে ‘মুমতাযুল মুহাদ্দিসীন’ হিসেবে ‘দস্তারে ফযীলত’ বা পাগড়ি ও সনদ প্রদান করা হয়েছিলো।
বায়’আত গ্রহণ ও পীরের দরবারে নজিরবিহীন খিদমত : হযরত সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহ্ প্রখ্যাত ওলী–ই কামিল উলূম–ই ইলাহিয়্যার ধারক, মা‘আ–রিফ–ই লাদুন্নিয়ার প্রসবণ হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হির বরকতময় হাতে বায়’আত গ্রহণের সুন্নাত পালন করেন।
বায়’আত গ্রহণের পর থেকে তিনি আপন মুর্শিদের খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯১২ ইংরেজি সনে তিনি হযরত চৌহরভীর মসজিদ নির্মাণের কাজে আর্থিকসহ বিভিন্ন বিষয়ে অংশ গ্রহণ করেন। তাছাড়া, উল্লেখ যে, হযরত সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহ্ নিজের উপার্জিত অর্থে আফ্রিকার প্রথম মসজিদটা নির্মাণ করেছিলেন। তিনি নিজের অর্থে আরো বহু মসজিদ নির্মাণ করেন। তন্মধ্যে একটি হরিপুর বাজারে রয়েছে। তাছাড়া, তিনি নিজ বাড়ি সিরিকোট দরবারের জামে মসজিদটিও তাঁর অর্থে নির্মাণ করেন ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে হযরত চৌহরভী হরিপুর বাজারে ‘দারুল উলূম ইসলামিয়া রহমানিয়া’ (মাদ্রাসা) প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ মাদরাসার যাত্রার সূচনাকাল থেকেই হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এ যুগান্তকারী মহান কাজের সাথে সম্পৃক্ত হন এবং তাঁর হাতেই এ প্রতিষ্ঠান বিশাল মারকায হিসেবে পূর্ণতা লাভ করেছে। হযরত চৌহরভীর ওফাত শরীফের পর এ মাদরাসার পরিচালনার দায়িত্ব হযরত সিরিকোটির হাতে অর্পিত হয়েছিলো। ওই মাদরাসা প্রশংসনীয় অবস্থানে রয়েছে। এ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান থেকে বুযুর্গ ও দক্ষ ওলামা বের হয়ে আসছেন।
দ্বীন, মাযহাব ও তরীক্বতের খিদমতের উদ্দেশ্যে বার্মাার রেঙ্গুনে গমন : ১৯২০ ইংরেজিতে হযরত সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহ আপন পীর–মুর্শিদের নির্দেশে স্বদেশের মায়া ত্যাগ করে সুদূর রেঙ্গুনে চলে যান। তখন তাঁর বয়স অন্তত তেষট্টি বছর। সেখানে তিনি ১৯৪১ ইংরেজির ডিসেম্বর পর্যন্ত সদয় অবস্থান করেন। সেখানে তিনি সর্বমোট ২১/২২ বছর যাবৎ নিরলসভাবে দ্বীন ও মাযহাবের খিদমতআন্জাম দেন।
হযরত চৌহরভী আলায়হির রাহমাহ্ তাঁকে খিলাফত প্রদান করে শরীয়ত ও তরীক্বতের বিশাল দায়িত্ব অর্পণ করেন। তিনিও আপন পীর–মুর্শিদের প্রদত্ত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন।
১৯২০ ইংরেজী থেকে ১৯৪১ ইংরেজি পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছরে হাজার হাজার বার্মিজ নাগরিক এবং বিভিন্ন দেশের প্রবাসীদের মধ্যে দ্বীন–ইসলাম ও ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আত’–এর আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেন।
চট্টগ্রামে হুযূর ক্বেবলার তাশরীফ আনয়ন : হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোট হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহ্ ১৯২০ ইংরেজিতে আপন মুর্শিদ–ই কামিলের নির্দেশে পাকিস্তান থেকে বার্মা তাশরীফ নিয়ে যান এবং ১৯৪১ ইংরেজি সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছর সেখানে সদয় অবস্থান করেন।
এ সময়ে রেঙ্গুনের হাজার হাজার (বার্মিজ) নাগরিক এবং বর্তমানকার বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আগত কর্মরত প্রবাসীদের মধ্যে অসংখ্য মানুষ তাঁর সান্নিধ্যে এসে অকল্পনীয়ভাবে উপকৃত হতে থাকেন। তাঁদের অনেকে ভিন্ন ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ করেন আর অনেকে অন্ধকার জীবন থেকে আলোর দিকে ফিরে এসেছিলেন। রেঙ্গুনের বিখ্যাত বাঙালি মসজিদের ইমামত ও খেতাবতের পাশাপাশি রেঙ্গুন ও রেঙ্গুনের পার্শ্ববর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দ্বীন, মাযহাব ও তরীক্বতের প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি, যার প্রভাব এখনো সেখানে বিদ্যমান রয়েছে। এ সময়সীমায় সমগ্র রেঙ্গুনে হযরত সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহর অগণিত কারামতের কথা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দলে দলে লোকজন এসে তাঁর কাছ থেকে দুনিয়া ও আখিরাতের অমূল্য নি’মাতরাজি লাভ করে ধন্য হয়।
চট্টগ্রামের সংবাদপত্র শিল্পের পুরোধা ‘দৈনিক আজাদী’র প্রতিষ্ঠাতা জনাব আলহাজ্ব মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার এবং মাস্টার মুহাম্মদ আবদুল জলীলসহ চট্টগ্রামের প্রবাসী মুরীদগণ হুযূর ক্বেবলাকে চট্টগ্রামে তাশরীফ নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ জানিয়ে আসছিলেন। ১৯৪১ ইংরেজি সালের শেষের দিকে তিনি রেঙ্গুন থেকে স্থায়ীভাবে এ মিশনের কেন্দ্রস্থল বাংলাদেশের চট্টগ্রামে স্থানান্তর ও স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন।
আনজুমান প্রতিষ্ঠা : সুদীর্ঘ ২১ বছর রেঙ্গুনে শরীয়ত ও তরীক্বতের খিদমত আনজাম দেওয়ার পর স্বদেশ থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে প্রতি বছর তাশরীফ আনার ফলে এ দেশেও তাঁর মুরীদানের সংখ্যা কল্পনাতীতভাবে বৃদ্ধি পায়।
১৯৫৮ সালে চট্টগ্রাম সফরকালে ‘আনজুমান–এ শূরা–এ রহমানিয়া’র নাম পরিবর্তন করে ‘আনজুমান–এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ রাখা হয়। এ আনজুমান গঠনকাল থেকে বড় বড় খিদমত আনজাম দিতে থাকে। বর্তমানে ওই ‘আনজুমান’–এর নাম ‘আনজুমান–এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’। এ ‘আনজুমান’–এর কর্ম পরিধি এখন চট্টগ্রামের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। বর্তমানে এ আনজুমান বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়েছে।
শাহানশাহে সিরিকোট সত্যিকার অর্থে ওলী : শাহানশাহে সিরিকোট যেভাবে যুগশ্রেষ্ঠ আলিমে দ্বীন ছিলেন তেমনি ছিলেন এক মহান ওলী–ই কামিল। তাই তাঁর প্রতিষ্ঠিত সিলসিলায় রয়েছে শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের অপূর্ব সমন্বয়। তিনি তাই একদিকে তরীক্বত চর্চা ও অনুশীলনের জন্য খানক্বাহ্ প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন, অন্য দিকে দ্বীনের প্রকৃত খিদমত ও তরীক্বতের স্বচ্ছতা রক্ষার জন্য দ্বীনের দক্ষ ও সাচ্চা আলিম তৈরীকে পূর্বশর্ত বলেও তিনি মনে করতেন। তিনি বলেছেন, ‘কাম করো, দ্বীনকো বাঁচাও, ইসলাম কো বাঁচাও, সাচ্চা আলিম তৈয়্যার করো।’ অর্থাৎ কাজ করো, দ্বীনকে রক্ষা করো, ইসলাম বাঁচাও, সাচ্চা আলিম তৈয়ার করো। যেমন কথা তেমন কাজ। তিনি ‘জামেয়া’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাচ্চা আলিম তৈরীর এবং দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার শুভ সূচনা করেন। সুতরাং তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ‘জামেয়া’ এখন সত্যিকার অর্থে ‘জামেয়া’ বা ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হয়েছে।
ওফাত শরীফ : হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহ্ ১১ই যিলক্বদ ১৩৮০ হিজরী, মোতাবেক ২৫ মে ১৯৬১ ইংরেজি একশ’ বছরের বেশি বয়স অতিবাহিত করে ওফাত বরণ করেছেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন তাঁরই সুযোগ্য সাহেবযাদা হযরত সাইয়্যেদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহ্। তাঁর পরে তাঁর সাহেবযাদাগণ হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ মুদ্দাযিল্লুহুল আলী এবং হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবির শাহ্ সাহেব দামাত বরকাতুহুমুল আলিয়া হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহ্ প্রদত্ত খিলাফতের দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করছেন।
মাওলা তা’আলা এ খান্দানকে আবাদ রাখুন, তাঁদের ইলমী ও রূহানী ফুয়ূযকে চিরদিন জারী রাখুন। আ–মী–ন। এ মহান হযরতের ৬৪ তম সালানা ওরস মোবারকে তাঁর ফুয়ূযাত কামনা করছি।
লেখক: মহাপরিচালক– আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।