ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য (কাস্টমস ও ভ্যাট) ড. মো. মতিউর রহমানকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করার পর যোগদান করলেও তার কোনো হদিস মিলছে না। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে তার জন্য আলাদা কোনো কক্ষ নেই। এমনকি তার বসার জন্য কোনো চেয়ার–টেবিলও নেই। তিনি মন্ত্রণালয়েও আসেননি। তবে অন্য ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি যোগদানপত্র পাঠিয়েছেন বলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
গতকাল সোমবার অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে মতিউর রহমানকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে মতিউর রহমান পদোন্নতি পেয়ে এনবিআরের সদস্য (কাস্টমস ও ভ্যাট) হয়েছেন। তিনি এখনো ওই পদেই আছেন। তবে তাকে যেহেতু অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে, তিনি এনবিআরের কোনো কার্যক্রম করতে পারবেন না। তার কর্মক্ষেত্র হবে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ।
এদিকে মতিউর রহমান, তার স্ত্রী লায়লা কানিজ এবং ছেলে আহম্মেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। দুদকের আবেদনের শুনানি করে ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন গতকাল এই নিষেধাজ্ঞা জারির আদেশ দেন। আর মতিউরের দায়িত্ব পেয়েছেন বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডারের কর্মকর্তা সুরেশ চন্দ্র বিশ্বাস। খবর বাংলানিউজ ও বিডিনিউজের।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, কাস্টমস, এঙসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে মতিউর রহমানকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করার অর্থ হলো তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। সংস্থাপন বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের জন্য ওএসডি করার বিধান আছে। এর বাইরে অন্য বিভাগ, সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ের জন্য ওএসডির বদলে সংযুক্ত করার পদ্ধতি চালু আছে। মতিউর রহমানের ক্ষেত্রে সেটিই হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, মতিউর রহমানকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করার পর এরই মধ্যে তিনি মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেছেন। কিন্তু যোগদান করতে তিনি নিজে আসেননি। মন্ত্রণালয়ে যোগ দিলেও তার জন্য আলাদা কোনো কক্ষ বা চেয়ার–টেবিল নেই।
এ কর্মকর্তা বলেন, আমরা গুঞ্জন শুনছি মতিউর রহমান দেশে নেই। তিনি দেশের বাইরে চলে গেছেন। এ কারণেই হয়তো তিনি অন্যের মাধ্যমে যোগদানপত্র পাঠিয়েছেন। অন্যের মাধ্যমে পত্র পাঠিয়ে যোগদান করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।
এদিকে ছাগলকাণ্ডে আলোচনায় আসার পর মতিউর রহমানকে সর্বশেষ ঈদের দ্বিতীয় দিন ১৮ জুন একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ইন্টারভিউতে দেখা যায়। এরপর ধানমন্ডিসহ মতিউরের বিভিন্ন বাসভবনে খোঁজ নিয়েও সন্ধান মেলেনি তার। এমনকি কোরবানির ঈদের ছুটির পর অফিস খুললেও তিনি আর এনবিআর কার্যালয়ে আসেননি।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করতে তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করে। একইদিন কাস্টমস, এঙসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে তাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। এছাড়া তিনি হারিয়েছেন সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদও।
মতিউর ও স্ত্রী –পুত্রের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা : ‘ছাগলকাণ্ডে’ আলোচিত রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমান, তার স্ত্রী লায়লা কানিজ এবং ছেলে আহম্মেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। দুদকের আবেদনের শুনানি করে ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন গতকাল এই নিষেধাজ্ঞা জারির আদেশ দেন বলে আদালতের পেশকার ফয়েজ আহমেদ জানান। মতিউর রহমানের ‘অবৈধ সম্পদের’ বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য গঠিত অনুসন্ধান দলের প্রধান দুদকের উপপরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন এদিন আদালতে ওই আবেদন করেন।
মতিউরের দায়িত্ব পেলেন সুরেশ চন্দ্র বিশ্বাস : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য (কাস্টমস ও ভ্যাট) ড. মো. মতিউর রহমানকে কাস্টমস, এঙসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডারের কর্মকর্তা সুরেশ চন্দ্র বিশ্বাসকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গত রোববার উপসচিব মকিমা বেগম স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায় সুরেশ চন্দ্র বিশ্বাসকে ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী অর্থ বিভাগ কর্তৃক জারি করা আদেশে উল্লেখিত হারে ও শর্তে কার্যভার ভাতা পাবেন। অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত পদের সঙ্গে আবশ্যিকভাবে ‘অতিরিক্ত দায়িত্ব’ শব্দদ্বয় যোগ করবেন। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে এ আদেশ জারি করা হয়েছে। অবিলম্বে এটি কার্যকর হবে।
কোরবানির জন্য ঢাকার মোহাম্মদপুরের সাদিক এগ্রো থেকে ইফাত নামের এক তরুণের ১৫ লাখ টাকা দামে ছাগল কেনার ফেইসবুক পোস্ট ঘিরে ঈদের আগে রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা শুরু হয়। ছাগল কিনতে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন ইফাত। ধানমন্ডির বাসায় ঈদের দিন ছাগলটি কোরবানি দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। তখন ছাগলসহ ইফাতের ছবি জুড়ে দিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন তোলেন, ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কেনার অর্থের উৎস কী?
এ প্রশ্ন ঘিরে সামনে আসতে থাকে ইফাতের পরিচয়। ইফাত নিজেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিসহ পোস্ট দিয়ে ও সংবাদমাধ্যমে বাবার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, তার বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এঙসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি মো. মতিউর রহমান। ইফাতের বাবার পরিচয় ধরে অনেকে প্রশ্ন তোলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার ছেলের বিপুল ব্যয়ে কোরবানির পশু কেনার সামর্থ্য হলো কী করে? অবশ্য ছাগলটি ইফাত শেষ পর্যন্ত কেনেননি বলে দাবি সাদিক এগ্রোর কর্ণধার মোহাম্মদ ইমরান হোসাইনের। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ইফাত শুধু ১ লাখ টাকা দিয়ে ছাগলটির বুকিং করেছিলেন। তবে অবশিষ্ট মূল্য পরিশোধ করে ছাগলটির তিনি আর নিয়ে যাননি।
বিষয়টি নিয়ে ইফাতের বক্তব্যও এসেছে সংবাদমাধ্যমে। তার দাবি, ইমরান হোসাইনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তার ‘অনুরোধে’ ছাগলটি নিয়ে প্রচারের জন্য এতটা দামের কথা বলে পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি। মতিউর রহমান এ আলোচনায় ঘি ঢালেন ছেলের পরিচয় অস্বীকার করে। একটি টেলিভিশনের প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, মুশফিকুর রহমান ইফাত নামে কেউ তার ছেলে বা আত্মীয় নয়, এমন নামে কাউকে চেনেন না পর্যন্ত। তার একটিই ছেলে, তার নাম তৌফিকুর রহমান।
এরপর ইফাতের পরিচয় ও পারিবারিক ঠিকুজি নিয়ে ফেইসবুকে নানা তথ্য আসতে থাকে। ইফাতের সঙ্গে মতিউর রহমান এবং পরিবারের অন্যদের ছবিও প্রকাশিত হয়। এক পর্যায়ে সামনে আসেন ফেনী–২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেন, ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। আর মতিউর রহমানই ইফাতের বাবা। মতিউর রহমান এর আগে ব্রাসেলসে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলের, চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার, ভ্যাট কমিশনারসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। ছাগল নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হলেও তার বিপুল সম্পদের তথ্য এখন সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনাম হচ্ছে।