নগরীর কোতোয়ালীর হাজারী লেনের ওষুধের দোকানের কর্মচারী রিপন বিশ্বাস ঋণগ্রস্ত হয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। এর জেরে স্ট্রোকে তার মৃত্যু হলেও হত্যা করা হয়েছে উল্লেখ করে দায়ের করা হয় হত্যা মামলা। মূলত রাগের বশবর্তী হয়ে রিপন বিশ্বাসের স্ত্রী সঙ্গীতা দে, তার ভাই রুবেল দে, মা লাকী ও বাবা দোলন দে’র বিরুদ্ধে মামলাটি করেন রিপন বিশ্বাসের মা পারুল বিশ্বাস।
আদালতের নির্দেশে তদন্তভার গ্রহণ এবং সাড়ে ৪ মাস তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা শেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্ত কর্মকর্তার দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে এসব তথ্য। রিপন বিশ্বাসকে হত্যা করা হয়েছে–এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সম্প্রতি উক্ত তদন্ত প্রতিবেদনটি দাখিল করেছেন পিবিআইয়ের পরিদর্শক কমল কৃষ্ণ ধর।
রিপন বিশ্বাস পটিয়ার কালিয়াইশ গ্রামের বাসিন্দা। সঙ্গীতা দে’র সঙ্গে ২০১৫ সালের ১২ মে তার বিয়ে হয়। ৪ বছর বয়সী একজন ছেলে ও ৯ বছর বয়সী একজন মেয়ে রয়েছে তাদের। নগরীর সদরঘাটের মুন স্টার গলির হাজি সাহেবের বিল্ডিংয়ে তারা বসবাস করতেন। রিপনের মা কালিয়াইশে থাকতেন।
আদালতে দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিয়ের পর থেকে রিপন বিশ্বাস ও সঙ্গীতা দে সুখে বসবাস করে আসছিলেন। বিয়ের আগে থেকেই ওষুধের দোকানে চাকরি করলেও ছেলে–মেয়ের জন্মের পর বাড়তি আয়ের জন্য রিপন ওষুধ কোম্পানির ব্রোকার হিসেবে কাজ শুরু করেন। এছাড়া ওষুধের দোকান পরিচালনার জন্য কোতোয়ালী এলাকায় একটি দোকানের জন্য অ্যাডভান্স প্রদান করেন তিনি। কিন্তু পরবর্তীতে দোকানের জন্য প্রদত্ত অ্যাডভান্সের টাকা নিয়ে গ্রামের বাড়িতে নতুন ঘর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উক্ত সময়ে রিপনের আয়ের উৎস কমে গেলে বাসার আশেপাশে টিউশন শুরু করেন সঙ্গীতা। পরে রিপনের অনুমতি নিয়ে তিনি ব্র্যাকে চাকরি নেন। নগরীর জামালখান এলাকায় ছিল তার অফিস।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রামের বাড়িতে ঘর তোলার জন্য পরিচিত বন্ধু ও নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে ঋণ নেন রিপন। কিন্তু ঋণ পরিশোধ করতে পারছিলেন না। এছাড়া ওষুধ কোম্পানিতেও সমস্যার সম্মুখীন হন। সব মিলে তিনি আর্থিক অনটনে পড়ে যান। এর জেরে সঙ্গীতার সঙ্গে খারাপ আচরণ, এমনকি শারীরিক–মানসিক অত্যাচার শুরু করেন রিপন। সঙ্গীতা কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। পরিবার ও আত্মীয়–স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কয়েকবার রিপনের হাতে তুলে দেন। যা দিয়ে রিপন ঋণ পরিশোধ এবং ঘর তোলার কাজে ব্যবহার করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রিপন যেদিন স্ট্রোক করেন তার সপ্তাহখানেক আগে স্ত্রী সঙ্গীতার সঙ্গে পারিবারিক বিষয়ে ঝগড়া হয়। তখন উত্তেজিত হয়ে সঙ্গীতাকে তিনি মারধর করেন। এর জেরে সঙ্গীতা একই এলাকায় থাকা মায়ের বাসায় তার দুই ছেলে–মেয়ে নিয়ে চলে যান। রিপন প্রতিদিন সেখানে গিয়ে ছেলে–মেয়েকে দেখে এলেও সঙ্গীতা রাগের বশবর্তী হয়ে বাসায় ফিরতে অনীহা প্রকাশ করেন। এরপর ঘটনার দিন অর্থাৎ গত বছরের ৩০ আগস্ট রাতে ছেলে–মেয়েকে দেখতে গিয়ে রিপন চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকেন। সবাই তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে তিনি ছেলেকে সেখান থেকে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। সবাই যখন এ কাজ না করতে তাকে অনুরোধ করেন, তখন তিনি ছেলেকে ফেরত দিয়ে নিজের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু কিছুদূর হেঁটে একটি নির্মাণাধীন ভবনের সামনে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যান তিনি। এ সময় নির্মাণাধীন ভবনের দারোয়ান উজ্জ্বল সঙ্গীতাদের খবর দেন।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, উজ্জ্বলসহ আশেপাশের একাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়া এবং গ্রামের বাড়িতে নতুন ঘর তোলার বিষয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে স্ট্রোক করেন রিপন। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুসনদে বলা হয়, হাসপাতালে নেওয়ার আগেই রিপনের মৃত্যু হয়েছে।
লোহার রড ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ছেলে রিপনকে হত্যা করা হয়েছে উল্লেখ করে মা পারুল বিশ্বাস মামলা দায়ের করলেও তদন্ত কর্মকর্তা তার দাখিল করা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, রিপন শ্বশুরবাড়ি থেকে নিজের বাসায় যাওয়ার সময় দাঁড়ানো অবস্থায় উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে যান। ঘটনাস্থল নির্মাণাধীন ভবনের সামনে বিভিন্ন ভাঙা অংশ পড়েছিল। সেগুলোর কারণে রিপনের শরীরের বিভিন্ন অংশে জখম হয়। এছাড়া মৃত্যু পরবর্তী দীর্ঘক্ষণ খাটে শুইয়ে রাখার কারণে রিপনের পিঠে রক্ত জমাট হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জীবিত থাকাকালীন রিপন সাংসারিক খরচের জন্য তার মাকে টাকা–পয়সা দিয়ে আসছিলেন। মৃত্যুর পর তার স্ত্রী সঙ্গীতার কাঁধে পড়ে এ দায়িত্ব। তিনি পারুল বিশ্বাসকে খরচের টাকা দেওয়ার পাশাপাশি রিপনের ঋণের টাকাও পরিশোধ করছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে সঙ্গীতার চাকরি চলে যাওয়ায় তিনি আর পারুল বিশ্বাসকে টাকা দিতে পারছিলেন না এবং টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। মূলত এর জেরে রাগের বশবর্তী হয়ে ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগে পারুল বিশ্বাস গত ৩১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত–২–এ হত্যা মামলাটি দায়ের করেছিলেন।
আদালতের বেঞ্চ সহকারী শফিউল আজম দৈনিক আজাদীকে বলেন, তদন্ত কর্মকর্তার দাখিলকৃত প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতার ওপর আগামী ১২ আগস্ট শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
ভিকটিম রিপনের বোনের জামাই চন্দন মল্লিক গতকাল আদালত চত্বরে দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা পিবিআইয়ের দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদনে অসন্তুষ্ট। আদালতের কাছে নারাজি পিটিশন দাখিল করব।