খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় বৃহস্পতিবার পাহাড়ি–বাঙালি সহিংসতায় তিনজনের মৃত্যুর ঘটনার জেরে গতকাল শুক্রবার পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতেও সংঘর্ষ হয়েছে। এতে রাঙামাটিতে একজন নিহত হয়। দুই জেলায় চারজন নিহতের পর সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে উভয় জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। উভয় জেলায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এদিকে ঢাকায় বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র–জনতার ডাকে তিন পার্বত্য জেলায় ৭২ ঘণ্টার সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি আহ্বান করা হয়েছে।
জানা গেছে, খাগড়াছড়ি সদরে বুধবার মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মো. মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে দীঘিনালায় বাঙালি শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এসময় লারমা স্কয়ারের বাজারে আগুন লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। তাতে ৭০টির বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়ে যায়। আহত হন পাঁচজন।
এরপর রাতেই আহতদের খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এরমধ্যে জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০) নামে তিনজন মারা যান। এদিন রাত সাড়ে ১০টায় খাগড়াছড়ি জেলা শহরের নারানখাইয়া স্বনির্ভর এলাকায় ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায়। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
খাগড়াছড়িতে নিহত ৩ : খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালির সংঘর্ষের জেরে পুরো জেলায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। বৃহস্পতিবার রাতের গোলাগুলি ও বিকেলের সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)।
খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রিপল বাপ্পি চাকমা বলেন, আহত হয়েছেন ৯ জন। তাঁরা বেশির ভাগই সদর উপজেলা থেকে রাতে এসেছেন। এর মধ্যে তিনজন মারা যান। নিহত ব্যক্তিদের মৃত্যুর কারণ ময়নাতদন্ত শেষে বলা যাবে। তিনজনের মরদেহ সদর হাসপাতালের মর্গে রয়েছে।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সংঘাতের জেরে সহিংসতা ও নাশকতা রোধে খাগড়াছড়ি পৌর শহর ও জেলা সদরে ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক মো.সহিদুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, যে কোনো ধরনের সহিংসতা রোধে প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট সুজন চন্দ্র রায় স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তি বলা হয়, ‘উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৯৮ সালের ১৪৪ ধারা মতে নিষেধেজ্ঞা আরোপ করলাম।’ শুক্রবার দুপুর ২টা থেকে রাত ৯ টা
পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে শুক্রবার সকালে দীঘিনালা লারমা স্কয়ারে যান জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান, খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল, দীঘিনালা জোন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ওমর ফারুক। তারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলেন। ক্ষতিগ্রস্তদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়। দীঘিনালা জোন লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ওমর ফারুক বলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও শান্ত আছে। আইনশৃক্সখলা বাহিনীর টহল জোরদার করা হয়েছে।’
এদিকে শুক্রবার বিকেলে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে বিশেষ আইনশৃক্সখলা বিষয়ক সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ির রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ মো. আমান হাসান, পুলিশ সুপার মো.আরেফিন জুয়েল, জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভূঁইয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ মো. আমান হাসান বলেন, ‘সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। গুজব ছড়াতে দেয়া যাবে না। গুজব না ছড়ালে খাগড়াছড়ি অন্যান্য জেলায় মতোই স্বাভাবিক থাকবে।’
রাঙামাটিতে সংঘর্ষ : রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান, রাঙামাটি শহরে পাহাড়ি–বাঙালিদের দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়াকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্র হয়েছে শহরের প্রধান প্রাণকেন্দ্র বনরূপা বাজারসহ হ্যাপির মোড়, বিজন সরণী এলাকা। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ভবন ও হ্যাপির মোড়ের এসকে মার্কেট ও পার্শ্ববর্তী মার্কেটে আগুন, ভাঙচুর, হামলা চালানো হয়েছে। এ সময় আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়ের সামনে থাকা নয়টি গাড়িসহ সড়কের আশপাশে থাকা অনেকগুলো মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শহরজুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও সেনাবাহিনীর টহল জোরদার করা হয়। জেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের দোকানপাট বন্ধ রয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার বোয়ালখালী বাজারে বৃহস্পতিবার বিকালে দোকানপাটে আগুন–সংঘর্ষ ও রাতভর খাগড়াছড়িতে সংঘর্ষের প্রতিবাদে রাঙামাটি শহরে শুক্রবার সকালে মিছিল বের করে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা। ওই সময় মিছিল থেকে বনরূপা বাজারের মসজিদে ‘ইটপাটকেল ছোঁড়া’ হয়েছে এমন অভিযোগে পাহাড়ি–বাঙালি দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষ চলাকালে পাহাড়িরা পিছু হটে এবং বাঙালিরা এগিয়ে আসে। বাঙালিদের জমায়েত থেকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মালিকানা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। অনেক বাঙালির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. শওকত আকবর জানান, সংঘর্ষের ঘটনায় দুই পক্ষের ৫৮ জন রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। ভর্তি আছেন ১৯ জন এবং নিহত হন একজন। নিহতের নাম–পরিচয় জানা যায়নি।
এদিকে, দুপুরের দিকে দুই পক্ষের সংঘর্ষ থামলেও লাঠিসোটা হাতে রাস্তায় দুই পক্ষের লোকজনকেই দেখা গেছে। শহরজুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আইনশৃক্সখলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় রাঙামাটি পৌরসভা এলাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। আজ শনিবার রাঙামাটিতে পরিদর্শনে আসবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা।
রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি মাঠে আছে। আইনশৃক্সখলা পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে। ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে আমরা এখনো গভীরভাবে জানতে পারিনি।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান জানান, শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এখনো সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে জানা যাবে। আইনশৃক্সখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। শুক্রবার সংঘর্ষের ঘটনায় রাঙামাটিতে একজন মারা গেছেন। তবে তার নাম–পরিচয় পাওয়া যায়নি। আগামীকাল (শনিবার) স্বরাষ্ট্র ও পার্বত্য উপদেষ্টা রাঙামাটিতে আসবেন।
এদিকে, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে হামলায় নিহত ও সংঘর্ষের ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। দলটি ঢাকায় ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র–জনতার’ আয়োজিত সমাবেশ থেকে ঘোষিত তিন পার্বত্য জেলায় (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) ৭২ ঘণ্টা সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচির প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছে।
শুক্রবার বিকেলে গণমাধ্যমে দেয়া এক বিবৃতিতে ইউপিডিএফের সহ–সভাপতি নতুন কুমার চাকমা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির ঘটনাকে বর্বরোচিত ও ন্যাক্কারজনক উল্লেখ করে ঢাকায় বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র–জনতার ডাকে তিন পার্বত্য জেলায় শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) থেকে ৭২ ঘণ্টার সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানান এবং কর্মসূচি সফল করতে নেতাকর্মী, সমর্থকসহ সর্বস্তরের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান।