১৩৪০ খ্রীষ্টাব্দে সোনার গাঁওয়ের স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহর সেনাপতি কদলখান গাজির সহায়তায় পীর বদরুদ্দীন আল্লামা তাঁর সহচরদের নিয়ে মগদস্যুদের পরাস্ত করে চট্টগ্রাম জয় করলে এখানে ইসলামী শাসনের সূচনা হয়। কথিত আছে যে খ্যাতনামা বারোজন সূফীসাধক ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। চট্টগ্রামস্থ সীতাকুন্ড থানার সোনাইছড়ি অঞ্চলে যা পরবর্তীকালে বার আউলিয়া নামে সর্বত্র প্রচারিত ও প্রকাশিত তথায় তাঁদের আস্তানা দৃষ্ট হয়।
এ অঞ্চলের পশ্চিম তটে যেখানে বঙ্গোপসাগরের ফেনিল জলরাশি যুগ যুগ ধরে আছড়ে পড়ছে তার পিছনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধ্যানমগ্ন জালালাবাদ পাহাড়। চট্টগ্রামের এই প্রকৃতি পরিবেশ যেন রাব্বুল আলামীন শুধু সূফীদের আত্মিক ক্রিয়াকলাপের জন্য বিশেষভাবে তৈরী করেছেন। তাই চট্টগ্রামের সাথে সূফী সাধকদের চমৎকার আধ্যাত্মিক ও জাগতিক যোগাযোগ লক্ষ্যণীয়।
কোন এক সময় কাদেরীয়া তরীকার প্রবক্তা প্রখ্যাত সাধক বড়পীর হজরত মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী (র.) এর বংশধর ভারতের বিহারে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। মরমীবাদের ব্যাপক প্রচারণা খোদা প্রেমিক পুরুষদের হৃদয়ে ভীষণভাবে নাড়া দেয়, ফলে বড়পীর ছাহেবের বংশোদ্ভূত ত্যাগী পুরুষ শাহ সূফী আমানত (র.) বিহার শরীফের নিজ পিত্রালয় ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জগতের আকুল ইশারায় আত্মিক জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর কাশ্মীরের পথে চলে যান। এখানে এসে তিনি উপযুক্ত মুর্শিদের খোঁজ করতে থাকলেন নীরবে। কাশ্মীরের জনৈক বুজর্গ ব্যক্তি তাঁকে মহান অলী হজরত আবদুর রহিম শহীদ (র.) এর সন্ধান বলে দেন।
হজরত আবদুর রহিম শহীদ (র.) এর কর চুম্বনের মাধ্যমে তিনি এল্ম মারিফাতে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের সান্নিধ্য পেয়ে হজরত অত্যন্ত গৌরবান্বিত হলেন। মাত্র অল্পকাল মধ্যে তিনি মুর্শিদের সাহচর্য থেকে এল্ম বাতেন শাস্ত্রে চরমোৎকর্ষতা লাভ করে অফুরন্ত নেয়ামত হাসিল করলেন। পীর ছাহেব বুঝতে পারলেন শাহ আমানতের অন্তর আল্লাহ প্রেমের জোয়ারে পরিপূর্ণ এবং রাব্বুল আলামীনের সাথে মিলনাকাঙ্ক্ষায় মন তাঁর উন্মুখ। হজরতের ঐশী ক্ষমতার ব্যাপকতা দর্শন করে মুর্শিদ তাঁকে কাদেরীয়া, নকশবন্দীয়া এবং মাদারীয়া তরীকায় খেলাফত প্রদান করতঃ বিবাহিত জীবন যাপনের মাধ্যমে হালাল উপার্জন করার উপদেশ দিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় শহর চট্টগ্রাম যেতে নির্দেশ দিলেন। চট্টগ্রামের আত্মিক জগতের কর্তৃত্বের ভার গ্রহণ করে শাহ সূফী আমানত খান (র.) অত্যন্ত ধন্য হলেন। এদিকে চট্টগ্রাম শহরে এসে তিনি সরওয়ারে কায়েনাত হজরত মুহাম্মদ মোস্তাফা (স.) এর সুন্নত পালনার্থে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে স্থানীয় আদালতে সামান্য একটি চাকরি জুটিয়ে নিলেন। (ঐ সময়কার নবাবী আমলের আদালতটি পরবর্তীকালে মোহসেনিয়া মাদ্রাসা এবং তারও পরে মহসিন কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।) অতঃপর দিনের বেলায় হজরত আদালতের কাজে এবং রাত্রি বেলায় আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্যাপৃত হলেন। পার্থিব জগতের মায়া মমতা তাঁকে আর গৃহাভিমুখী করতে পারলো না। আদালতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি এবাদত বন্দেগীর জন্যে একটি নিরিবিলি স্থানের খোঁজ করছিলেন। অতঃপর একদিন আন্দরকিল্লা পাহাড়ের পাদদেশে পীর বদরুদ্দিন আল্লামার সমাধির কিছুটা পশ্চিমে বদর পুকুরের পশ্চিম পাড়ে একটি নিরিবিলি স্থান নির্বাচন করে তথায় তিনি খানকাহ স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে ঐ স্থান খানকাহ আমানতিয়া নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
চট্টগ্রামের সরল প্রাণের সাধারণ মানুষ তখন একজন ঐশ্বরিক ত্রাণকর্তার প্রয়োজন অনুভব করছিলেন। এদিকে হজরত শাহ সূফী আমানত খান (র.) লোক চক্ষুর অন্তরালে আত্মিক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকেন। বস্তুতঃ তিনি সুন্নতের অত্যন্ত বিনয়ী অনুসারী ছিলেন বিধায় হালাল পন্থায় রোজগার করে জীবিকা নির্বাহের জন্য অত্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন। তিনি সাধারণ লোকের মন জয় করতে পেরেছিলেন তাঁর নম্র ব্যবহার, পরম ধৈর্যগুণ এবং মৌনতার দ্বারা। তাই তাঁকে স্থানীয় বাসিন্দারা সমীহ করতেন তাঁর এ সমস্ত গুণাবলীর জন্যে।
লালদীঘি অঞ্চলে ঘন অরণ্যরাজির ভিতর স্থিত কুঠিরে নীরবে প্রভুর আরাধানা করতেন হজরত শাহ সূফী আমানত খান (র.)। কুঠিরে তখন নীরব আঁধার ছিলো তাঁর সহচর। মৌনতা, সরলতা এবং বিশ্বস্ততার কারণে স্থানীয় জনসাধারণের কাছে তিনি মিয়া ছাহেব নামে পরিচিত ছিলেন। কর্মক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ এবং নিরলস কর্মী। কোন প্রকার শিথিলতা ব্যতীত প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তিনি আদালতে কাজ করতেন। আদালতের কর্মজীবন তাঁকে সুন্নতের পায়রবী করতে সাহায্য করেছে। খেটে জীবিকার্জনের মাধ্যমে খোদার স্মরণ চালু রাখতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। একজন বেলায়েত প্রাপ্ত সূফী হয়েও সামান্য চাকরী গ্রহণ করে তিনি সুন্নতের প্রতি অসীম অনুরাগ দেখিয়েছেন।
জাগতিকতার আবরণে চাকুরীর ছদ্মবেশে হজরত দিনের বেলা আদালতে কাজ করতেন এবং রাত্রি বেলা মরমীবাদের কঠোর সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। মৌনপন্থী ছিলেন বিধায় সাধারণ মানুষ তাঁকে চিনতে পারেননি। কিন্তু অসহায় মানুষের মনোবেদনা তিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতেন। তিনি অত্যন্ত স্বল্পভাষী কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। এমনই এক মাহেন্দ্রক্ষণে এক চরম অসহায় ব্যক্তিকে মামলার দলিলপত্র সংগ্রহে সাহায্য করতে গিয়ে জন সমক্ষে তাঁর আধ্যাত্মিক আভরণ প্রকাশ পেয়ে যায়। রুমাল দিয়ে নৌকা বানিয়ে চোখের পলকে দুর্গম সুমদ্রের শত মাইল পথ সংকুচিত করে মুহূর্তের মধ্যে মামলার কাগজপত্র সংগ্রহের অত্যাশ্চর্য্য ঘটনার কিংবদন্তি আজও বংশ পরম্পরায় চট্টগ্রামবাসীর মুখে মুখে উচ্চারিত।
তদীয় একমাত্র ঔরশজাত পুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ আনোয়ার খানকে খানকাহ শরীফ এবং নিজ বসতবাড়ীর তদারকীর ভার ন্যস্ত করে এই মহিমামন্ডিত সূফী তাত্ত্বিক হজরত শাহ সূফী আমানত খান (র.) ১১৮৭ হিজরীর ৩০শে জিলক্বদ খানকাহ্ শরীফে ইন্তেকাল করেন (আজিমপুর দায়েরা শরীফ পৃষ্ঠা–১১০ সৈয়দ শাহ আহমদুল্লাহ)।
পটিয়া থানার হরিণখাইন নিবাসী জনৈকা খোসা মাবুদী হজরতের দরবারে খেদমত করতেন। আবদুল ওয়াহাব নামে তাঁর অল্প বয়সী একটি ছেলে ছিলো। ছেলেটি অত্যন্ত ডানপিটে ছিলো। সে হজরতকে নানা সম্বোধন করতো। কথিত আছে যে, হজরতের রূহানী ফয়েজের প্রভাবে এই শিক্ষাবঞ্চিত গ্রামের ছেলেটি পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম শহরের স্বনামধন্য উকিল হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। উকিল ছাহেব মরহুম নানাজানের নির্দেশ রক্ষার্থে ওফাতের পূর্বে ১৮০৬ সনে হরিণখাইন গ্রামে একটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করেন। বর্তমানে সেটি কুরা কাটনী মসজিদ নামে পরিচিত।
এতদঞ্চলে হজরতের অসংখ্য মুরীদ ছিলেন। তৎমধ্যে ঢাকাস্থ আজিমপুরা দায়রা শরীফের প্রখ্যাত বুজর্গ হজরত শাহ সূফী মুহাম্মদ দায়েম (র.), মিরসরাই মাস্তান নগরস্থ হজরত শাহ সূফী কেয়ামুদ্দীন (র.) এবং আনোয়ারা থানাধীন হজরত শাহ সূফী মিয়া হাজী দৌলত (র.) হজরতের অন্যতম খলিফা ছিলেন।
জাগতিক ও আধ্যাত্মিক যে কোন পর্যায়ের মনস্কামনা পূরণের উছিলায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ,নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর জন্যে অহোরাত্র অবারিত এই সর্বজনীন দরগাহ শরীফ। দেশি বিদেশী পর্যটকগণ চট্টগ্রাম সফরে এলে তাঁর সমাধি দর্শন করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে থাকেন। হজরত শাহ সূফী আমানত খান (র.) এর একমাত্র পুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ আনোয়ার খান তদীয় পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে এবং নিজ পরিবারের ভরণ পোষণের নিমিত্তে ১১ই বৈশাখ ১২০২ মঘী একখানা ব্যক্তিগত ওয়াক্ফ নামা সম্পাদন করেন। উক্ত ওয়াক্ফনামায় তিনি স্বীয় দুই পৌত্র যথাক্রমে আলিয়ার খান এবং আমানত খানকে উক্ত ওয়াক্ফ এস্টেটের মুতওয়াল্লী নিযুক্ত করেন। (আনোয়ার খানের একমাত্র পুত্র আলেফ খান পিতার জীবিত কালেই ইন্তেকাল করেন)। ওয়াক্ফ নামায় তিনি উল্লেখ করেছেন যে তাঁর পৌত্রদ্বয়ের ইন্তকালের পরে তাঁদের পুত্রগণ এবং পরবর্তীকালে পৌত্র পৌত্রাদি পুরুষানুক্রমে বংশ পরম্পরায় মুতওয়াল্লী হিসাবে গণ্য হবেন।
প্রতি বৎসর ১লা জিলহজ হজরতের পবিত্র ওরশ শরীফ তাঁরই বংশধরগণের তত্ত্বাবধানে হজরতের রওজা শরীফ প্রাঙ্গণে অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক