নগরীর সড়কগুলোর বেহাল অবস্থা। প্রধান সড়কের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর অবস্থা আরও করুণ। চলমান বিরামহীন বৃষ্টি ও পরবর্তী পরিস্থিতিতে সড়কগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। স্বাভাবিকভাবে চলতে পারছে না যানবাহন। খানাখন্দে ভরা সড়কগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। যেহেতু ঝুঁকি নিয়েই চলছে যানবাহন, সেহেতু দ্রুত নজর দেয়া দরকার। অন্যদিকে বাড়ছে দুর্ঘটনা। সড়কের এ বেহাল দশার কারণে একদিকে যেমন দুর্ভোগ বাড়ছে, অন্যদিকে যানবাহনের ক্ষতি হচ্ছে।
গত ২ জুলাই ‘সড়ক জুড়ে দুর্ঘটনার ফাঁদ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আজাদীতে। এতে বলা হয়েছে, ‘নগরীর সবচেয়ে ব্যস্ত সড়ক হচ্ছে বারিকবিল্ডিং থেকে শুরু করে বিমানবন্দর সড়ক। পতেঙ্গা ও বড়পুল দিয়ে আউটার রিং রোডের সাথেও যুক্ত হয়েছে এই সড়কটি। গত আড়াই বছর ধরে সড়কটির উপর দিয়ে নির্মাণ শুরু হয়েছে বিমানবন্দর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার প্রায় ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এক্সপ্রেসওয়েটি নিয়ে মানুষের মাঝে উচ্ছ্বাস থাকলেও ভোগান্তিও বেশি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। জানা যায়, সামপ্রতিক সময়ে বারিকবিল্ডিং থেকে লালখান বাজারমুখী অংশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ শুরু হলে বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদের বাসিন্দাদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। বিশেষ করে অফিস চলাকালীন পুরো এলাকাজুড়ে যানজটের কবলে পড়তে হয়। একইসাথে চলমান রয়েছে পতেঙ্গা বারিকবিল্ডিং অংশের কাজও। বর্তমানে ওই অংশের সল্টগোলা ক্রসিং থেকে বন্দরটিলা পর্যন্ত আনুমানিক আড়াই কিলোমিটার সড়ক জুড়েই তৈরি হয়েছে গর্ত। চলতি ভারি বর্ষণে এসব গর্ত ডোবায় পরিণত হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, সড়কটির পাশের নালাগুলো ভরাট থাকায় ভারী বর্ষণে আশপাশের পানি রাস্তায় জমে জলাবদ্ধতা তৈরি করছে। এতে পানির মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলাচলের কারণে সড়কটিতে গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে ভারী পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ডাম্পার, ট্যাংক লরি, প্রাইমমুভার চলাচলের কারণে পুরো সড়কটি ভেঙে চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ছে’।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাঙাচোরা সড়ক প্রধানত দুভাবে যানবাহনের পরিচালন ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। প্রথমত, ভাঙাচোরা সড়ক যানবাহনের কারিগরি ক্ষতি করে। এতে মেরামত খরচ বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, খারাপ সড়কে গাড়ির গতি কমে আসে। ভাঙা অংশ পার হতে ইঞ্জিনে বাড়তি চাপ পড়ে। তখন জ্বালানি খরচও বেড়ে যায়। তাঁরা বলেন, সড়ক ভালো থাকলে রোড ইউজার কস্ট সহনশীল পর্যায়ে থাকে। কিন্তু খারাপ হলে যানবাহনের ট্রিপের সময় বেড়ে যায়। এর প্রভাবে বেড়ে যায় ভ্যালু অব ট্রাভেল টাইম। একইভাবে বেড়ে যায় যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও। বাড়তি জ্বালানির প্রয়োজন হয়। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে এবং জনভোগান্তি নিরসনের জন্য সড়ক-মহাসড়কগুলোর সংস্কারের উদ্যোগএখনই নেওয়া উচিত। তবে সংস্কার কাজটি হতে হবে স্বচ্ছ এবং টেকসই ও দুর্নীতিমুক্ত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের মতো বৃষ্টিবহুল দেশে কংক্রিটের রাস্তা টেকসই। প্রাথমিক খরচ বেশি হলেও ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে সেটাই ব্যয়-সাশ্রয়ী বলে প্রমাণিত। আমাদের সড়কে পানি জমে বিটুমিনের ৯০ শতাংশ নষ্ট হচ্ছে, বর্ষায় লাখো কিলোমিটার সড়ক নাজুক হয়ে পড়ছে। তবু আমরা যথাযথ পথ কখনো অনুসরণ করতে চাই না। একটা রাস্তা বানানোর সময় মাটি পরীক্ষা করতে হয়, খোয়া নাকি নুড়ি ব্যবহার করা হচ্ছে, তার আকার-প্রকার কী, কতটা পানি ব্যবহার করা হচ্ছে, কতটা চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে, কোন স্তর কত পুরু করা হচ্ছে, এর প্রতিটির হিসাব আছে, বৈজ্ঞানিক মাপ ও নিয়ম আছে। যথাযথভাবে বানালে বিটুমিনের রাস্তা ১২ বছরেও কিছু হওয়ার কথা নয়। একটা প্রকল্প হতে হবে সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করে, তার পরিবেশগত অভিঘাত বিবেচনায় নিয়ে, তারপর ওই প্রকল্পটা পাবে সবচেয়ে যোগ্য দক্ষ অভিজ্ঞ ব্যয়সাশ্রয়ী প্রতিষ্ঠান, গোপন টেন্ডারের মাধ্যমে, তারপর প্রতিটি স্তরে সেটার প্রকৌশল মান নিরীক্ষা করা হবে। সড়ক কেন ভেঙে যাচ্ছে- এ বিষয়ে সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক পরিচালকের বক্তব্য হলো, সড়ক নির্মাণে নিয়োজিত ঠিকাদার, উপকরণ ও নজরদারি-তিনটিতেই ঘাটতি আছে। এ জন্যই দ্রুত সড়ক ভেঙে যাচ্ছে। যথাযথ যন্ত্রপাতি ও দক্ষতা নেই-এমন অপেশাদার ঠিকাদাররা গুরুত্বপূর্ণ সড়ক নির্মাণ বা মেরামতের কাজ পেয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া বর্তমানে সড়কে ৩০ বছরের পুরোনো উপকরণ-প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। যা ভারী যানবাহনের চাপ নিতে পারছে না। তাই বিটুমিনের সঙ্গে আধুনিক কিছু উপকরণ ব্যবহার করা গেলে পানি এবং ভারী যানের ক্ষতি থেকে কিছুটা রক্ষা করা যাবে। তবে সবকিছুর আগে নজরদারি জরুরি। বর্ষা চলে আসায় সড়কে হয়তো কার্পেটিং করা সম্ভব হবে না, কিন্তু গর্তগুলো দ্রুত ভরাট করে আপাতত চলাচল উপযোগী করা দরকার।