দুপুর গড়িয়ে বিকেল। রোদ নরম হয়ে আসছে। উঠোনের এক কোণে বসে সুমিতা সেলাই করছিলেন। পুরনো একটা শাড়ি, পাড়টা ছিঁড়ে গেছে। নতুন করে পাড় বসানোর কাজ চলছে। সূঁচের প্রতিটি ফোঁড় যেন স্মৃতির এক–একটা সুতো। পাশে ছোট্ট রাজু খেলছে, তার খেলনা গাড়ি নিয়ে। সুমিতা হাসলেন। মনে পড়ল, এমন করেই তো তার মা সেলাই করতেন। পুরনো কাপড় নতুন করে তোলার কত গল্পই না জমা থাকত সেই সেলাইয়ের ভাঁজে ভাঁজে।
সুমিতার স্বামী, রফিক সাহেব, একজন সরকারি কর্মচারী। সকাল থেকে রাত অবধি খাটেন। তাদের সংসারে অভাব নেই, কিন্তু প্রাচুর্যও নেই। যা আছে, তা হলো ভালোবাসা আর একতা। এই দুটোই তাদের সংসারের মূল ভিত্তি।
রাজুর বয়স আট। হাসিখুশি, দুরন্ত ছেলে। তার চোখে সারাক্ষণ হাজারো প্রশ্ন। মা, এটা কী? বাবা, ওটা কেন? ু এমন হাজারো প্রশ্নে সে মাতিয়ে রাখে সারা বাড়ি। রফিক সাহেব যখন অফিস থেকে ফেরেন, তখন রাজু বাবার গলা জড়িয়ে ধরে। রফিক সাহেবও রাজুকে কাঁধে তুলে নিয়ে সারা ঘর ঘোরান। সে এক অন্যরকম আনন্দ।
আজকাল রাজু একটু চুপচাপ। সুমিতা লক্ষ্য করেছেন। বিকেলে খেলতে গিয়েও কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকে। স্কুল থেকে ফেরার পরও আগের মতো হৈচৈ করে না। সুমিতা জিজ্ঞেস করেন,
কী হয়েছে বাবা? শরীর খারাপ লাগছে?
রাজু শুধু মাথা নাড়ে। না মা, কিছু হয়নি।
কিন্তু সুমিতার মায়ের মন। তিনি বোঝেন, কিছু একটা হয়েছে। রাতের খাবারের পর রাজু যখন বিছানায় শুয়ে পড়ে, সুমিতা তার পাশে বসেন। আলতো করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
রাজু, আমায় বলতে পারিস কী হয়েছে? তুই আজকাল কেমন মনমরা হয়ে থাকিস।
রাজু খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ছোট্ট করে বলে,
মা, আমার বন্ধুদের সবার নতুন খেলনা আছে। আমার নেই।
সুমিতার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তিনি জানেন, রাজুর বন্ধুরা বড়লোক ঘরের ছেলেমেয়ে। তাদের কাছে দামি দামি খেলনা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজুকে তিনি কখনো কিছুর অভাব বুঝতে দেননি। ছোটবেলা থেকেই শিখিয়েছেন, যা আছে, তাতেই খুশি থাকতে হয়।
কী খেলনা বাবা? সুমিতা নরম গলায় জিজ্ঞেস করেন।
একটা রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি। খুব সুন্দর, মা। সবাই ওটা নিয়েই খেলে।
রাজুর গলা যেন অভিমানে বুজে আসে।
সুমিতা তাকে বুকে টেনে নেন।
ঠিক আছে বাবা, আমি বাবার সাথে কথা বলব।
রফিক সাহেব যখন জানতে পারলেন রাজুর ইচ্ছার কথা, তার মুখটা মলিন হয়ে গেল। মাস ফুরোতে আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। এই মুহূর্তে নতুন একটা খেলনা কেনার মতো হাতে টাকা নেই। তবুও তিনি রাজুকে আশ্বস্ত করলেন,
“ঠিক আছে বাবা, আমি দেখছি কী করা যায়।”
সুমিতা বুঝলেন, রফিক সাহেব কতটা চেষ্টা করছেন। তিনি তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, চিন্তা কোরো না। আমাদের যা আছে, তা দিয়েই আমরা ওকে খুশি রাখব।
পরের কয়েকদিন রাজু আশার আলো দেখতে পেল না। বাবা বা মা কেউ খেলনার কথা তোলেন না। সে ভাবল, হয়তো তারা ভুলে গেছে। তার মন খারাপ হলো। স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের খেলনা দেখে আরও মন খারাপ হতো।
একদিন বিকেলে সুমিতা রাজুকে ডেকে বললেন, রাজু, চল আজ আমরা একটা নতুন খেলা খেলব।
রাজু অবাক হয়ে তাকাল।
“কী খেলা মা?”
“স্মৃতির সেলাইঘর।” সুমিতা হাসলেন।
আজ থেকে আমরা পুরনো জিনিস দিয়ে নতুন কিছু বানাব। যেমন এই শাড়িটা।
তিনি রাজুকে তার সেলাই করা শাড়িটা দেখালেন।
দেখ, এটা নতুন পাড় বসানোর পর কত সুন্দর লাগছে।
রাজু আগ্রহ নিয়ে শাড়িটা দেখল। সুমিতা তার হাতে একটা পুরনো খবরের কাগজ আর আঠার বোতল দিলেন। চল, আমরা একটা কাগজের প্লেন বানাই।
প্রথম প্রথম রাজু ইতস্তত করল। সে তো কোনোদিন এসব করেনি। কিন্তু মায়ের উৎসাহে সেও লেগে পড়ল। ধীরে ধীরে কাগজের প্লেন তৈরি হলো। সুমিতা আরও পুরনো কাগজ এনে একটা খেলনা নৌকা বানালেন। রাজু আনন্দে আত্মহারা।
এরপর শুরু হলো তাদের নতুন অভিযান। পুরনো বাতিল বোতল দিয়ে তারা পেন হোল্ডার বানাল। পুরনো জামার টুকরো দিয়ে তৈরি হলো একটা রঙিন নকশার কুশন কভার। সুমিতা রাজুকে শেখালেন, কীভাবে পুরনো জিনিসকেও নতুন জীবন দেওয়া যায়। রাজু ধীরে ধীরে বুঝতে শিখল, আনন্দের উৎস শুধু নতুন জিনিস কেনায় নয়, বরং সৃষ্টি করার মধ্যেও রয়েছে।
একদিন রফিক সাহেব অফিস থেকে ফিরে দেখেন, রাজু একটা খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলছে। কিন্তু সেটা রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি নয়। পুরনো একটা জুতার বাঙ দিয়ে তৈরি, তার ওপর রঙিন কাগজ আর বোতলের ছিপি দিয়ে চাকা লাগানো। সে নিজেই বানিয়েছে। রফিক সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
রাজু দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। বাবা, দেখো আমি একটা নতুন গাড়ি বানিয়েছি! মা আমায় শিখিয়েছে।
রফিক সাহেব সুমিতার দিকে তাকালেন। সুমিতা হাসলেন। তাদের চোখে মুখে এক নতুন দিনের স্বপ্ন। রাজু আজ আর নতুন খেলনার জন্য বায়না ধরে না। সে তার নিজের হাতে তৈরি জিনিস নিয়েই খুশি।
মা–বাবার এই শিক্ষা রাজুর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলল। সে শিখল, যা আছে, তাতেই খুশি থাকা যায়। সে আরও শিখল, নিজের হাতে কিছু তৈরি করার আনন্দ কত বড়। তার মন থেকে অভাববোধ দূর হয়ে গেল। কয়েক মাস পর। রাজুর জন্মদিন। রফিক সাহেব তার জন্য একটা সত্যিকারের রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি কিনে আনলেন। রাজু গাড়িটা পেয়ে খুব খুশি হলো। কিন্তু তার চোখে সেই আদিম উত্তেজনা ছিল না, যা সে তার নিজের হাতে তৈরি খেলনা নিয়ে খেললে অনুভব করত। সে গাড়িটা কিছুক্ষণ খেলল, তারপর রেখে দিল। সে মাকে ডেকে বলল,
মা, আজ আমরা একটা নতুন স্মৃতির সেলাইঘর খেলব। পুরনো জুতার বাঙ দিয়ে আমি একটা গ্যারেজ বানাব, আমার নতুন গাড়ির জন্য। সুমিতা হাসলেন। তিনি বুঝলেন, তার আর রফিক সাহেবের দেওয়া শিক্ষা রাজুর মধ্যে গেঁথে গেছে। ভালোবাসার সেলাইয়ে বাঁধা এই সংসারে, নতুন জিনিসের চেয়েও মূল্যবান হলো স্মৃতি আর সৃষ্টির আনন্দ।