স্মৃতিতে ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান ও আবদুল্লাহ আল নোমান

এ. কে.এম. আবু বকর চৌধুরী | সোমবার , ১৭ মার্চ, ২০২৫ at ৪:৪৮ পূর্বাহ্ণ

৫২র ভাষা আন্দোলন ও ৬২র শরীফ শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনের পর ৬৯’র ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলন তথা ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যৌথ দ্বিতীয় স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান ও আবদুল মোনেম খানের চরম পতনের আন্দোলনে রাজপথের অন্যতম সাথী সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল নোমান গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকাস্থ বাসভবনে ইন্তেকাল করে। বয়সের দিক থেকে আমার তিন বছরের ছোট। এই আন্দোলনে ২০ জানুয়ারি হতে ২১ মার্চ পর্যন্ত ৬১ দিনে ১২৩ জন ছাত্র শিক্ষকসৈনিকশ্রমিক কৃষক নিহত হয়।

১১ দফা আন্দোলনকালে চার ছাত্রদলের তথা ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) সভাপতি আবদুল্লাহ আল নোমান ও সম্পাদক কাজী সিরাজউদ্দিন, ছাত্রলীগের সভাপতি মোখতার আহমদ ও সম্পাদক এসএম. ইউসুফ, ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া), সভাপতি আবু তাহের মাসুদ ও সম্পাদক মুহাম্মদ মুসা এবং এন.এস.এফের (১১ দফা পন্থ/দুলন) সভাপতি হিসাবে আমি (.কে. এম. আবু বকর চৌধুরী) ও সম্পাদক এম. সামসুল আলম, নোমান ও ইউসুফ ৬৮র আগস্ট থেকে কারারুদ্ধ থাকায় যথাক্রমে ছাত্র ইউনিয়নে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দিলীপ শূর ও ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক চৌধুরী আলী রেজা খান এবং ছাত্রশক্তির সভাপতি সামসুল আলম (নদীয়া কি পাড় খ্যাত) ও সম্পাদক জামাল উদ্দিন সমন্বয়ে চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম গঠিত হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে ১১ দফা আন্দোলনকে সমর্থন না দেয়ায় জেলা ছাত্রশক্তিকে ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে সংগ্রাম পরিষদ থেকে বাদ দেয়া হয়। সংগ্রাম পরিষদে কেউ আহ্বায়ক ছিলাম না।

আন্দোলনকালে ১০ ফেব্রুয়ারি কারামুক্ত হওয়া নোমানইউসুফখোরশেদবালাগত উল্লাহগিয়াস উদ্দিনশাহ আলম প্রমুখকে নজির আহমদ রোডস্থ আইন কলেজ প্রাঙ্গণে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এতে আবু তাহের মাসুদ, চৌধুরী আলী রেজা খান, কাজী সিরাজউদ্দিন ও আমি বক্তৃতা করি। সভায় নোমান আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলল “মামা সময়মত আমাদের কাতারে দেখে খুব ভালো লাগছে।” একথা শুনে আমারও ভালো লাগলো। সংগ্রাম পরিষদে কোনো আহ্বায়ক না থাকায় বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো জনসভাগুলিতে কে সভাপতিত্ব করবে।

নোমান এক ঐতিহ্যবাহী ডানপন্থী পরিবারে জন্ম নিলেও ষাট দশক থেকে আশি দশক পর্যন্ত বাম রাজনীতির ধারকবাহক ছিল। মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে বাম রাজনীতিতে বিচরণ থাকলেও শ্রমিক রাজনীতিতে সুদৃঢ় অবস্থান ছিল।

নোমানের মায়ের দিক থেকে আমাদের পরিবারের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল সেই সূত্রে তাঁর পিতা আহমদ কবির চৌধুরী ছিলেন আমার ভগ্নিপতি। নোমানদের পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের গভীর সম্পর্কটি ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ১৯৫৫৫৬ সালের দিকে গহিরা হাইস্কুলকে কেন্দ্র করে। এই স্কুলে দীর্ঘ ২০ বছর যাবত সেক্রেটারী ছিলেন আহমদ কবির চৌধুরী। ১৯৫৫৫৬ তে এই স্কুলে ছাত্রঅভিভাবকশিক্ষকদের চাপে পড়ে আমার পিতা বজলুল রহমান চৌধুরীকে সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে হয়। আমাদের এই পরিবারের মাঝে মধুর সম্পর্কটি ভেঙে যায়।

পরবর্তীতে ৬২র শিক্ষা আন্দোলন, চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকাল ও ৬৯র গণঅভ্যুত্থানে নোমানের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। ৬৫তে চট্টগ্রাম কলেজে এন.এস.এফের ইউ.এস.এফ, ছাত্র ইউনিয়নের ইউ.এস.পি.পি এবং ছাত্রলীগের যাত্রিক দলের সম্পাদক পদে যথাক্রমে আমি, আবদুল্লাহ আল নোমান ও কাজী আবু জাফর নির্বাচিত হয়। আমাদের সবার বাড়ি রাউজানের গহিরায় ১ সিকি মাইলের মধ্যে। তখন ফজলুল কাদের চৌধুরী পাকিস্তানের দ্বিতীয় ক্ষমতাসীন তথা জাতীয় পরিষদের স্পিকার (১৯৬৩৬৫)। একদিন সকালে কলেজে গিয়ে দেখি চারিদিকে চিকা ও পোস্টারে ভরে গেছে। ভাষা হল ফকা চৌধুরীর দালালরা তিন দলকে দখল করেছে হুশিয়ার সাবধান। নোমানবকরজাফররা নিপাত যাক ইত্যাদি। আমিতো ক্ষেপে গেলে নোমান এসে বলল খুব ভালো লাগছে। মিষ্টি দিয়ে চা খেয়ে আসি। তার হাসিমুখের কথাগুলো শুনে আজো আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে ভাসছে। নোমানের ছাত্ররাজনীতি শুরু হয় ১৯৫৯ সাল থেকে ও আমার শুরু হয় ১৯৫৭ সালে মুসলিম হাইস্কুলে এন.এস.এফের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে (২৫ ডিসেম্বর ১৯৫৭)

১৯৬৯র গণঅভ্যুত্থানকালে আমরা জনসভা করতাম লালদিঘি মাঠ, আইন কলেজ চত্ত্বর, সিটি কলেজ চত্ত্বর ও রাইফেল ক্লাব চত্বরে। সভাগুলি আগের রাতে চার দলের নেতারা বসে সিদ্ধান্ত নিতাম কে সভাপতিত্ব করবে। ইতোমধ্যে রাইফেল ক্লাব ও আইন কলেজ চত্ত্বরে আমি দুটি সভায় সভাপতিত্ত্ব করলেও ছাত্র ইউনিয়নের নোমানের সভাপতিত্ব করার সুযোগ হয়নি। সুযোগ এলো ২১ ফেব্রুয়ারি ২টি সভা হবে দুপুরে লালদিঘি মাঠ, সকালে রাইফেল ক্লাব চত্ত্বরে। যথাক্রমে ছাত্রলীগের মোক্তার আহমদ ও আমি সভাপতিত্ব করব। এদিন প্রভাতফেরী শেষে রাইফেল ক্লাব চত্বরে আমি মাইক হাতে নিয়ে সভাপতিত্ব করার জন্য নোমানের নাম প্রস্তাব করলে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) নেতারা অবাক হয়ে যায়। মানুষ চলে যায়, স্মৃতি থেকে যায়। আব্দুল্লাহ আল নোমানের রাজনৈতিক জীবন সমার্থক ও সার্থক। মন্ত্রী (১৯৯১১৯৯৬ ও ২০০১০৬) থাকাকালে চট্টগ্রামে ভেটেরিনারী সাইয়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান উইমেন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণ, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণে অক্লান্ত পরিশ্রম ও অবদান রেখে গেছেন তার জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। নিজস্ব অর্থায়নে ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাকলিয়া একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করে গেছে।

১৯৬৯’র গণঅভ্যুত্থানকালে ১২ মার্চ ডাকসুর জিএস, এনএসএফ নেতা নাজিম কামরান চৌধুরী, ছাত্রলীগের সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-এর সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমদ মনিক, এনএসএফের (১১ দফা পন্থী) সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সী ও ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ লালদিঘি মাঠে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন। এতে সভাপতিত্ব করার জন্য নোমান আমার নাম প্রস্তাব করায় ছাত্রলীগ বিরোধিতা করলেও তৎসময় ছাত্ররাজনীতিতে আমি সিনিয়র বলে তাঁর যুক্তিতে অটল ছিল এবং তাঁর প্রস্তাবেই সমর্থিত হয়।

১৯৯০ সালে আমাকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হলে প্রথমবার ও সর্বশেষ ১৯৯৭তে রাজনীতি অঙ্গন থেকে দূরে সরে গেলে আবদুল্লাহ আল নোমান আমাকে বিএনপিতে যোগদান করতে বলেছিল। কিন্তু আর রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হবো না বলে জানিয়ে দিয়েছি। উত্তরে সে বলেছিল ‘মামা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ যা আজো আমার কানে প্রতিধ্বনিত হয়। পরিশেষে এইটুকু বলব সুন্দর যেন স্বরলিপি ভরা, / একটি গানে কলি তোমার মন / আমিতো পারিনি তোমার মত সাগর হৃদয় হতে / আমিতো পরে আছি পাথরভরা পৃথিবীতে।

লেখক : কলামিস্ট; জীবন সদস্যবাংলা একাডেমি

পূর্ববর্তী নিবন্ধডেভিল হান্টের পরিবর্তে বিশেষ অভিযান : রমজানে শান্তি শৃঙ্খলায় আশীর্বাদ হোক
পরবর্তী নিবন্ধ‘ডেড-এন্ড জব’ : ১২টি লক্ষণ ও করণীয়