স্মার্ট মন্ত্রিসভা: সম্মুখে এগিয়ে চলার প্রত্যয়

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ১৬ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৯:২৩ পূর্বাহ্ণ

দেশীবিদেশী বিভিন্ন মহলের নানামুখী বাধা অতিক্রম করে দলীয় সরকারের অধীনেই উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান দেশেবিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। বহুলভাবে আলোচিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে টানা চতুর্থ এবং পঞ্চম মেয়াদে সরকার প্রধান হওয়ার অনন্য নজির গড়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্মার্ট বাংলাদেশের উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান এ শ্লোগান দিয়ে এগিয়ে চলার প্রত্যয় জানিয়ে নতুন বছরে নতুন সময়ে নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী স্মার্ট মন্ত্রীসভা গঠিত হয়েছে। দ্রব্যমূল্য কমানো কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সহ ১১ বিষয়ে অগ্রাধিকার এবং ঘুষ দুর্নীতি, ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার ও নতুন বেতন কাঠামো সহ বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দাভাব, আন্তর্জাতিকভাবে বিরূপ অবস্থা ও রিজার্ভের নিম্নগামী প্রভৃতি কঠিন চ্যালেঞ্জকে সামনে নিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের দৃঢ়প্রত্যয়ে নতুন সরকার তাদের পথচলা শুরু করেছে।

নতুন সরকারের পথচলাকে স্বাগত ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমরা আশাবাদী, মানুষ আশা নিয়ে পথ চলে। আশা নিয়ে পথ চলতে শিখেছে বলেই বাঙালি কঠিন ও কঠোর সংগ্রামকে জয় করে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।

নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের কঠিন চ্যালেঞ্জ এই সরকারের সামনে। ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগ কী কী করবে জাতির সামনে তুলে ধরেছিলেন ইশতেহারে। প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ক্ষুধাদারিদ্র্যমুক্ত স্মার্ট সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলা হবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের প্রাধান্য, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠন সুনিশ্চিত করা হবে। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের মাধ্যমে দক্ষ, উদ্যোগী, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর, দুর্নীতিমুক্ত দেশপ্রেমিক ও জনকল্যাণমুখী প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা চলমান থাকবে।’

প্রতিশ্রুতির মধ্যে আরও রয়েছে– ‘স্মার্ট বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে স্মার্ট ও আধুনিক হিসেবে গড়ে তোলা হবে। জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে দায়িত্ব বিভাজন অধিকতর স্পষ্ট করা হবে। বাজারমূল্য ও আয়ের মধ্যে সঙ্গতি প্রতিষ্ঠা করা হবে। কর্মোপাযোগী প্রশিক্ষিত যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ঋণ সরবরাহ সম্প্রসারণ করা হবে। দারিদ্যের হার ১১ শতাংশে, চরম দারিদ্র্যের অবসান এবং ২০৪১ সাল নাগাদ দারিদ্যের হার ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। গ্রামের যুবসমাজের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা কমাতে গ্রামেই আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

কর্মসংস্থান সম্প্রসারণের জন্য ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প, তাঁত ও রেশমশিল্পকে সংরক্ষণ এবং প্রতিযোগিতা সক্ষম করা হবে। বেনারসি ও জামদানিশিল্পকে উৎসাহিত করা হবে। দক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক চাহিদা অনুযায়ী ট্রেডভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বাড়ানো হবে। দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গ্যাস ও এলপিজির সরবরাহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হবে। শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়াবে এবং তার কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারী শিক্ষকের অনুপাত ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করা হবে। দরিদ্র ও দুর্বলতর জনগোষ্ঠীর সন্তানদের উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ আরও প্রসারিত করা হবে। ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য দেশের প্রত্যেক মানুষের কাছে একটি ইউনিক হেলথ আইডি প্রদান এবং হাসপাতালে অটোমেশন ব্যবস্থাপনা চালু করা হবে। সকলের জন্য সমান সুযোগ রেখে সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চালু করা হবে। স্বাস্থ্য ইন্সুরেন্স চালু, হেলদি এজিং স্কিমের আওতায় প্রবীণদের অসংক্রামক রোগব্যাধি নিরাময় এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র তৈরি করা হবে। প্রবীণ নাগরিকদের কল্যাণে দেশের সকল সরকারি হাসপাতালে জেরিয়াট্রিক সেবা প্রচলনের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। অটিস্টিক শিশুদের জন্য গৃহীত বিশ্বে সমাদৃত কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানো হবে। অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রয়োগে বাধা দূর করা হবে এবং সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এবং সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হবে।’

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শতভাগ শিক্ষিত নাগরিকেরা যাতে নতুন নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে নিজেদের এবং সমাজের সকলের জীবন ও জীবিকার মান বদলে দিতে পারে সে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মোবাইল, ইন্টারনেট বা কম্পিউটারের মাধ্যমে তারা সমাজের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। সরকারি ও বেসরকারি খাত প্রদত্ত পণ্য ও সেবা গ্রহণ করবে। দেশবিদেশের অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে নিজেদের অর্থনৈতির সঙ্গে যুক্ত থেকে নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন ঋদ্ধ করে তুলবে। প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেদের সমস্যা সমাধান করবে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারবে।

প্রযুক্তির ব্যবহার সরকার পরিচালনা ব্যবস্থাকে দক্ষ, কার্যকর এবং সাশ্রয়ী করে তুলবে, সর্বোপরি সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করবে। সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্তই হবে জ্ঞানভিত্তিক ও তথ্যনির্ভর। প্রতিটি সেবা হবে চাহিদা অনুযায়ী এবং সমন্বিতভাবে। আইওটি, মেশিন লানিং, ক্লাউড কম্পিউটিং ইত্যাদি প্রযুক্তির মাধ্যম সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যাবলী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে স্মার্ট নাগরিকদের স্মার্ট প্রতিনিধির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরকার পরিচালনার সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করবে। সরকার তথা রাষ্ট্র হয়ে উঠবে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক। সব রকমের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জ্ঞানভিত্তিক স্মার্ট সমাজে যাতে নাগরিকেরা জ্ঞান চর্চা ও প্রয়োগের সহ সুযোগ পাবেন। ফলে কমে যাবে ভুল ও মিথ্যা তথ্য প্রবাহের অনৈতিক সুযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারে সংস্কৃতি চর্চা, বিনোদন ও মানসিক উৎকর্ষতা সাধনের সময় ও সুযোগ বৃদ্ধির কাজে সহায়ক হবে। স্মার্ট অর্থনীতি ও শিল্প বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জ্বালানী খাতকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখতে হবে।

বিগত সময়ের বাস্তবতা ও প্রকৃত অবস্থান বিবেচনায় জ্বালানি সেক্টরে ছিল অস্থিতিশীল পরিবেশ। এর থেকে উত্তোরণ জরুরি। দেশে বর্তমানে শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক গ্যাস একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। গ্যাসের অভাবে দেখা গেছে বিনিয়োগ ক্ষেত্রে দেশিবিদেশী বিনিয়োগকারিদের মাঝে নিরুৎসাহিত মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে।

স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য স্মার্ট অর্থনীতি গড়ে তুলতে হলে বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ জরুরি। যত বেশি বিনিয়োগ বাড়বে তত বেশি শিল্প গড়ে উঠবে। শিল্প গড়ে উঠলে বেকার সমস্যা সমাধান হবে এবং দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। এবিষয়ে বিশেষজ্ঞ মহলের পরামর্শ হলো, ‘ইউরিয়া সার কারখানার বিষয়ে সরকারকে নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে।’

দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ এলএনজি হিসেবে আমদানি করতে হচ্ছে। যদি নতুন কোন সুখবর না আসে তবে এর পরিমাণ দিন দিন বাড়তে থাকবে। বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাসের এক তৃতীয়াংশ ব্যবহৃত হয় সার কারখানাগুলোতে। এতে সরকারকে দুদিকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, প্রাকৃতিক গ্যাস বেশি মূল্যে আমদানি করছে এবং আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যে সার ক্রয়ে সরকার এবং অর্থনীতিবিদরা যদি চিন্তা করেন প্রাকৃতিক গ্যাস সমৃদ্ধ দেশ সমূহে যদি সার কারখানা স্থাপন করে সার দেশে আনা হয় তবে গ্যাসের ব্যবহার এক তৃতীয়াংশ কমে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। উদ্বৃত্ত গ্যাস দেশের শিল্পায়নে ব্যবহার করা গেলে বড় ধরনের শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টি নতুন, ভেবে দেখা প্রয়োজন।

বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই চীনের অর্থনীতির অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির আকার প্রায় ২৭ ট্রিলিয়ন ডলার ‘নোমিনাল জিডিপি’। সেখানে চীনের অর্থনীতির অধিকার প্রায় ১৮ ট্রিলিয়ন ডলার ‘নোমিনাল জিডিপি’ এর পরের অবস্থানের দেশগুলোর অর্থনীতির আকার ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের ঘরে।

অথচ চীনের আছে উন্নত প্রযুক্তি, জনসংখ্যার তুলনায় ভালো কর্মসংস্থান সৃষ্টির নজির এবং শক্তিশালী ব্যাংকিং অবস্থা। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ এবং উন্নত বিশটি ব্যাংকের মধ্যে দশটিই চীনে অবস্থিত। উল্লেখ্য চীন যেহেতু বিশাল জনসংখ্যার দেশ। তাই সেখানে আত্ম কর্মসংস্থাপন বেকারত্ব দূর করতে ভালো ভূমিকা রাখে। বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত করতে হলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের বিকল্প নেই। যা বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে বিদ্যমান।

দেশকে উন্নয়নের পথে তুলে দিয়ে পঞ্চমবারের রেকর্ড সৃষ্টিকারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে পথ চলতে চাচ্ছেন, তাতে তাঁর যোগ্য ও দক্ষ টিম ও যোগ্য সহকর্মীর কোনও বিকল্প নেই। তা না হলে সময় মতো তাঁর গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য স্মার্ট মন্ত্রীসভার সাথে সাথে স্মার্ট মনমানসিকতা এখন সময়ের দাবি। তবেই এদেশ সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়ন সম্ভব।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদকশিল্পশেলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজাদী অন্তঃপ্রাণ মঈনুল আলম বাদল স্মরণে
পরবর্তী নিবন্ধস্কুলের শ্রেণিকক্ষকে আনন্দময় করে তুলতে হবে