স্মরণের আবরণে স্থপতি মীর মোবাশ্বের আলী

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ৪ মার্চ, ২০২৫ at ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ

প্রকৃতির লীলাভূমি চট্টলভূমির অনন্য এক কৃতীপুরুষ মীর মোবাশ্বের আলী। পিতা মীর হাবীব আলী। যিনি চট্টগ্রামের ডিসট্রিক ফিজিক্যাল অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি করেন। চাকরি ও বিবাহসূত্রে চট্টগ্রামের বাসিন্দা। মা মাহমুদা বেগম যিনি চট্টগ্রাম কলেজের আরবি ও ফার্সি বিভাগের অধ্যাপক ও চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক অলি খাঁ মসজিদের পেশ ইমাম প্রফেসর আব্দুল লতিফ খানের বড় মেয়ে।

১৯৪১ সালে চট্টগ্রামে মাতুলালয়ে মীর মোবাশ্বের আলীর জন্ম, তঁাঁর ডাক নাম মাসুদ। সকলের প্রিয় মাসুদ ভাই। পাঁচ ভাই ও দু’বোনের মধ্যে সকলের বড়। নানা প্রফেসর আব্দুল লতিফ খান কর্তৃক ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত কাতালগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। পরবর্তীতে এম..এস স্কুলের শিক্ষা শেষে নগরীর ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। কলেজিয়েট স্কুল হতে ১৯৫৬ সালে মেধাবৃত্তি নিয়ে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাস করেন। চট্টগ্রামের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘চট্টগ্রাম কলেজ’ হতে বিজ্ঞান বিভাগে মেধাতালিকায় স্থান নিয়ে ১৯৫৮ সালে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ার কলেজে ভর্তি হন। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন কোকারিকুলাম কাজে অংশ নিয়েছেন এবং তিনি এসব গঠনমূলক মানসিক বিকাশ জনিত কর্মকাণ্ডে উৎসাহী ছিলেন।

প্রকৌশলীদের সাহিত্য ও সুকুমার শিল্পের বিকাশ ও মানবিক মননে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী লাভ করেন এবং ১৯৬২ সালে মোবাশ্বের আলী (ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) ইউকসুর সভাপতি নির্বাচিত হন এবং প্রসংশনীয় ভূমিকা রাখেন।

১৯৬২ সালেই প্রথম ইউকসু প্রতিষ্ঠিত হয়। সে হিসেবে তিনি ইউকসুর প্রতিষ্ঠাকালিন সভাপতি ছিলেন। মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে একই কলেজে একই বিভাগে শিক্ষক হিসেবে মনোনীত হন। ১৯৬৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডাতে, যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস এইডের উদ্যোগে উচ্চতর স্থাপত্য শিক্ষার লক্ষ্যে বিদেশ চলে যান। ‘ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়’ যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য গেইলভিনে অবস্থিত। একটি অতি মর্যদাপূর্ণ সরকারি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়, এর স্কুল অব আর্কিটেকচার যা কলেজ অব ডিজাইন, কনস্ট্রকাশন অ্যান্ড প্লানিং এর অন্তর্ভূক্ত এবং স্থাপত্য শিক্ষার জন্য সুপরিচিত এবং সুপ্রসিদ্ধ। উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে ১৯৬৬ তে দেশে ফিরে স্থপতি হিসেবে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগে শিক্ষকতার জীবন শুরু।

১৯৬২ হতে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মোবাশ্বের আলী প্রায় ৪৫ বছর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। এ শিক্ষা অঙ্গনের সাথে তিনি ছিলেন অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। মীর মোবাশ্বের আলীর ন্যায় এত সময় ধরে কেউ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন বলে মনে হয় না। ১৯৭৪ হতে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত দুই বছর ‘ইউনির্ভাসিটি অব নিউক্যাসল আপঅন টাইন’ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য (হাউজিং) বিষয়ে এম ফিল ডিগ্রী লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্যাসল আপঅন টাইনে অবস্থিত, এটি স্থাপত্য নগর পরিকল্পনা এবং ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচারের উপর উচ্চতর ডিগ্রী প্রদান করে।

মীর মোবাশ্বের আলী বাংলাদেশের স্থাপত্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপত্য বিভাগের অর্জন সফলতা বা ব্যর্থতা সব কিছুই অনেকাংশে তাঁর উপর বর্তায়। তিনি দীর্ঘদিন বিভাগীয় প্রধান ও অনুষদের ডীন এর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্চ এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি সব সময় মনে করেন স্থাপত্য শিক্ষা তথা যেকোন সৃজনশীল বৃত্তি অনুশীলনের পরিবেশ, সাধারণ বা প্রকৌশল শিক্ষার পরিবেশের চাইতে একটু ভিন্ন। এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁকে অনেক চড়াই উৎরাই পার হতে হয়েছে। অনেক শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা ও বিধি নিষেধ পেরিয়ে আজ স্থাপত্য বিভাগের যে অবস্থান একজন প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে তাতে মীর মোবাশ্বের আলীর অবদান অনস্বীকার্য্য।

শিক্ষকতার মাঝে থেকেও স্থাপত্য পেশার সাথে তিনি সরাসরি জড়িত থেকেছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে ডিজাইনের কাজ করেছেন। প্রথম পর্যায়ে টেলিফোন ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্পোরেশন (টিআইসি) টঙ্গি, ফৌজি জুট মিল, ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ স্টেশন ও অফিস ভবন, চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বিসিআইসি হাউজিং, ঢাকায় এয়ারপোর্ট সিভিল এভিয়েশন অফিস এবং ফ্রেইট টার্মিনাল ছাড়াও বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্‌্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের ডরমিটরি ও অনেক ব্যক্তিগত হাউজিং এর নঙা তিনি করেছেন। তিনি দেশেবিদেশে বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ায় অংশ নিয়েছেন। এমআইটি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), লুভেন (বেলজিয়াম), অ্যালিক্যান্ট (স্পেন) এবং বিআইটি (কলকাতা) এর মতো মর্যদাপুর্ণ প্রতিষ্ঠানে তিনি বর্ক্তৃতা করেছেন এবং তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ অবদানের জন্য বিশ্বব্যাপি স্বীকৃতি পেয়েছেন। ১৯৯৫ সালে জাপান থেকে প্রকাশিত স্থাপত্য পুস্তিকায় “৫৮১ স্থপতি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড” (581 Architecture in the world) শিরোনামে স্থাপত্য পুস্তিকায় বাংলাদেশ থেকে একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে তাঁর জীবনী এবং নক্‌শাগুলি স্থান পেয়েছে।

দেশেবিদেশে তাঁর অনেক পাবলিকেশন রয়েছে। তিনি ‘ সমতটে সংসদ বাংলাদেশের স্থাপত্য সংস্কৃতি লুই কা’ন ও সংসদ ভবন’ শিরোনামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ লিখেছেন। যা জার্নিম্যান বুক্‌স হতে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি স্থাপত্য জগতে প্রচুরভাবে প্রসংশিত হয়েছে। এ বইয়ে বাংলাদেশের সংসদ ভবনের নির্মাণ ও নক্‌শার বিষয়ে নতুন এক তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তিনি লিখেন, ‘লুই কা’নের মৃত্যুর পর এই ভবনের (অর্থাৎ জাতীয় সংসদ ভবনের) অসমাপ্ত কাজ প্রখ্যাত স্থপতি মাজহারুল ইসলাম কর্তৃক শেষ করা হয় বলে প্রচারিত। এ কথাটি সঠিক নয়। এ কাজটি বাংলাদেশ সরকারের স্থাপত্য অধিদপ্তরের তদারকিতে শেষ হয়। —– সংসদ ভবনের ডিজাইনের কাজে ‘লুই কা’নকে’ নিয়োগের সময় মাজহারুল ইসলাম স্থাপত্য অধিদপ্তরে স্থপতি হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। আলাদাভাবে তাঁর কাজ পাওয়া বা করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে মাজহারুল ইসলাম বাংলাদেশের স্থাপত্য পেশার গুরু। স্থাপত্য পেশার উৎকর্ষ সাধনে তাঁর প্রভাব অপরিসীম। (সূত্রঃ সমতটে সংসদ’ বাংলাদেশের স্থাপত্য সংস্কৃতি লুই কা’ন ও সংসদ ভবন পুস্তক দ্রষ্টব্য)

মোবাশ্বের আলী বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ে প্রায় সকল প্ল্যানিং ও ডিজাইন কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেকস বাংলাদেশের সদস্য ও এককালীন সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের অনরারি সদস্য।

ধর্ম ও দর্শন বিষয়ে পড়াশুনা তাঁর প্রধান শখ, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব ধর্মতত্ব বিভাগে বিজ্ঞান ও ধর্ম বিষয়ে নিয়মিত বক্তা ছিলেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হতে অবসর নেওয়ার পর তিনি সাউথ ইষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় নামীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমৃত্যু তিনি এ পদে কাজ করেছেন।

প্রখ্যাত স্থপতি বাংলাদেশের স্থাপত্য শিক্ষার একজন বিশিষ্ট প্রবক্তা অধ্যাপক মীর মোবাশ্বের আলী ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ শনিবার সকালে দীর্ঘ বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদকশিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রফেসর ড. ইউনূসের ওপর কেন নিশ্চিন্তে আস্থা রাখা যায়
পরবর্তী নিবন্ধশিশুসাহিত্যের প্রকাশনায় লেখক-প্রকাশকের আরো বেশি মনোযোগ চাই