স্মরণের আবরণে

ডা. ফজলুল আমীন

আয়েশা পারভিন চৌধুরী | শনিবার , ৯ মার্চ, ২০২৪ at ৭:৩৬ পূর্বাহ্ণ

ডা. ফজলুল আমীন অতি সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। তাঁর এই অতি সাধারণ গুণাবলীই তাঁকে অসাধারণ মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষে পরিণত করেছে। তাইতো প্রতি বছর ১০ মার্চ এলাকার মানুষ ও আত্মীয়স্বজন সবাই গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় ডা. ফজলুল আমীনকে স্মরণ করে থাকেন। ১০ মার্চ ভোর থেকেই ওনার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে ও গভীর শ্রদ্ধা জানাতে কবরস্থানে আসেন। কবর জেয়ারত ও কুরআন তেলোয়াতের মাধ্যমে বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে ফুলে ফুলে কবরস্থানটি ঢেকে যায়। পারিবারিকভাবে মেজবান দিয়ে আত্নীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশি ও এতিম দুস্থদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। যেই এলাকাতে ওনার বেড়ে ওঠা ও ডাক্তার হিসেবে খ্যাতি অর্জন সেই এলাকার সীমানা পেরিয়ে পুরো চট্টগ্রামের আনাচেকানাচে আজও খুবই পরিচিতি একটি নাম হচ্ছে ডা. ফজলুল আমীন। তবে মানুষের প্রতি প্রবল ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থেকে তিনি ডাক্তার ফজলুল আমীন থেকে ডাক্তার ফজল আমীন হিসেবে বেশি পরিচিত। এই ডা. ফজল আমীনের নামের এত ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি যে এই নামটি বছরের পর বছর আজো মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে। নিজের যোগ্যতা দক্ষতা বিচক্ষণতা ও মহানুভবতার গুণে ডা. ফজলুল আমীন আজও এই এলাকার মানুষের মনে বেঁচে আছে। ভবিষ্যতেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম একজন মানবিক মানুষ হিসেবে সকলের কাছে অমর হয়ে থাকবেন। উনি যে স্থানটি অর্জন করেছেন সেই স্থানটি আর কেউ হয়তো কখনো দখল করতে পারবে না। উনার মতন এ অঞ্চলে আর কোনও পেশার মানুষ এত ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেনি। যুগের পর যুগ শিক্ষা বিস্তার ও জ্ঞানের প্রসারে উনার ভুমিকা ছিল অপরিসীম। আজ অবধি এই অঞ্চলে অনেক পেশার মানুষ ও জ্ঞানী গুণী প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। অনেকে যোগ্যতা ও দক্ষতার জন্য সংবর্ধিত হয়েছে। তাদের জীবদ্দশায় তারা বিভিন্নভাবে মূল্যায়িত হয়েছে। যেভাবে তাদেরকে মূল্যায়ন করা হয়েছে মৃত্যু পরবর্তী সময়ে ঠিক সেভাবে তাদেরকে স্মরণ করা হয় না। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত সে সব সংবর্ধিত মানুষগুলো এক সময় কালের গহ্‌বরে হারিয়ে যায়। শুধুমাত্র আপনজন ও কিছু ঘনিষ্ঠ মানুষ হয়তো প্রতিবছর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাদের স্মরণ করেন। কিন্তু মানবিক ডা. ফজলুল আমীনকে আজও মানুষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছে এবং আগামীতেও স্মরণ করবে।

ডা. ফজলুলহাজেরা ডিগ্রি কলেজের স্বপ্নদ্রষ্টা ডা. ফজলুল আমীনের ১০ মার্চের স্মরণসভায় এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আমন্ত্রিত হন। সবচেয়ে ভালো লাগে আমন্ত্রিত না হয়েও অনেকে নিজ উদ্যোগে কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই স্মরণসভায় উপস্থিত হন। বিশেষ করে এলাকার কয়েকজন বয়স্ক মানুষ বার্ধক্য জনিত অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও অনেক কষ্ট করে আপনজনের সহযোগিতায় আসেন। কারো হাতে হাত রেখে আস্তে আস্তে কলেজ প্রাঙ্গণে পা রাখেন। ডা. ফজলুল আমীনের চিকিৎসা সেবা ও জনহিতৈষী কাজ নিয়ে আলোচনা করেন। বাবার প্রতি সবার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখে প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের সদস্য ও কলেজের সভাপতি ডা. মো. আরিফুল আমীন বাকরুদ্ধ হয়ে যান। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যখন স্মৃতিচারণ করেন তখন পরিবেশ থমথমে থাকে। ডাক্তার ফজল আমীনের চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। একজন রোগীকে একেবারে আপন করে নেওয়ার যে দৃষ্টান্ত উনি স্থাপন করেছিলেন সেটি ছিল খুবই বিরল। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে রোগীর আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান বোঝার চেষ্টা করতেন। বিনা ফীতে চিকিৎসার পাশাপাশি অনেক দুস্থ মানুষকে নিজের পকেটের টাকা দিয়ে ওষুধ পথ্য কিনতে সাহায্য করেছেন। সারা দিনের চিকিৎসা সেবার পরে রাতের এক পর্যায়ে ক্লান্ত শ্রান্ত ডাক্তার ফজল আমীন রোগীদের নিরাশ করতেন না। জনশ্রুত আছে বেশ ক্লান্ত অবস্থায় চোখ বন্ধ করে রোগীর চিকিৎসা সেবা দিতেন। দক্ষিণ কাট্টলী, কদমতলী হালিশহর, ব্যাপারী পাড়া, মুহড়ি পাড়া, মিস্ত্রি পাড়া, নিমতলা, আগ্রাবাদ ও আশেপাশের এলাকার মানুষের চিকিৎসা সেবায় উনি ছিলেন একমাত্র নির্ভরযোগ্য ভরসার স্থান। তৎকালীন সময় চট্টগ্রামে হাতেগোনা যে কয়েকজন ডাক্তার ছিলেন তাদের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। একজন ডাক্তার হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা ছিল অতুলনীয়। অনেকের মতে শুধু উনার হাতের পরশে অনেক রোগী ভালো হয়ে যেত। পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই আন্তরিকতা ও মহানুভবতায় রোগীদের সারিয়ে তুলতেন।

ডা. ফজলুল আমীনের জ্যেষ্ঠ পুত্র ডা. মো. আফছারুল আমীন একজন রাজনীতিবিদ ও সাংসদ ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা লাভ করেন। একজন ডাক্তার থেকে তাঁর সাংসদ এবং একজন মন্ত্রীর পদ মর্যাদা লাভের এই পথে ডাক্তার ফজল আমিনের নামের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। ডাক্তার ফজুলল আমীনের নাতি এবং ডাক্তার মো. আফছারুল আমীনের ছেলে ফয়সাল বিন আমীন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দাদার অভাবনীয় জনপ্রিয়তাকে তুলে ধরে। ফয়সাল বলেন, তার বাবা ডা. আফছারুল আমীনের রাজনৈতিক প্রচার প্রচারণার প্রাথমিক পর্যায়ে একদিন কোনও এক বাসায় যান। একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে ডা. আফছারুল আমীনের পোস্টার হাতে দেন। কিন্তু সেই বয়স্ক ব্যক্তিটি প্রথম দিকে তেমন কোনও আগ্রহ অথবা সহযোগিতা দেখাননি। একপর্যায়ে ফয়সাল নিজের পরিচয় তুলে ধরে বলেন, ডাক্তার মো. আফছারুল আমীন হচ্ছে ডাক্তার মো. ফজলুল আমীনের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ঠিক তখন বয়স্ক মানুষটি ফয়সালকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে যান। আলাপচারিতার ফাঁকে ডাক্তার ফজল আমীনের চিকিৎসা সেবা সম্বন্ধে অনেক তথ্য বলেন। এভাবে ডা. ফজলুল আমীন সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা দৃঢ় অবস্থান তৈরি করেন।

সেই শৈশব থেকে আমার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে ডা. ফজলুল আমীনের নামটি জড়িয়ে আছে। খুব যখন ছোট ছিলাম তখন থেকে ডা. ফজলুল আমীনের নামটি বারবার শুনতে শুনতে স্মৃতিতে কোথায় যেন একটা জায়গা করে নিয়েছে। যতটুকু জানি যখনই ঘরে কেউ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তো আব্বা ভাইদেরকে তাড়াতাড়ি ডাক্তার আনতে পাঠিয়ে দিতেন। আর সেই ডাক্তারটির নাম ছিল ডা. ফজলুল আমীন। কারণ তখন অত্র অঞ্চলে ডা. ফজলুল আমীনের মত একজন নির্ভরযোগ্য ও আস্থাশীল ডাক্তার খুবই বিরল ছিল। অত্র অঞ্চলে কারো পরিবারে কেউ যখন খুব অসুস্থ হয়ে যেত তখনই ডা. ফজলুল আমীনের নামটি সবার আগে মনে আসতো।

১৯৯০৯১ সালের দিকে আমার সব সময় জ্বর আসতো। ততদিনে চট্টগ্রামে অনেক বিজ্ঞ ডাক্তার বিচক্ষণতার সাথে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছিল। কয়েক দিন পর পর ডাক্তারের কাছে যাওয়া হতো। এক ডাক্তার থেকে অন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত। কিন্তু জ্বর সারতো না। বিভিন্ন ডাক্তারের ব্যবস্থা পত্রে ক্যাপ্সুল ও কুনাইনের পরামর্শ ছিল। সেই সব ডাক্তারদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী বড় বড় ট্যাবলেট ও কুনাইনের তীতা স্বাদ এখনো মুখে লাগে। প্রতিবার ডাক্তার পরিবর্তন করার সময় কেন জানি ডাক্তার ফজল আমীনের নামটি নিয়ে আব্বা আম্মা আলোচনা করতেন। আব্বা আম্মা আফসোস করে বলতেন আজকে যদি ডাক্তার ফজল আমীন বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো এভাবে ডাক্তারের পেছনে ঘুরতে হতো না। এই অসাধারণ গুণসম্পন্ন মানুষটি অত্র এলাকার মানুষের সার্বিক উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেদিনের সেই অজ পাড়াগাঁয়ে শিক্ষার আলো জ্বালানোর প্রত্যয় নিয়ে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। পরবর্তীতে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। যে আলোর মিছিলের ভিত্তি গড়েছিলেন তারই সুদূরপ্রসারী প্রভাবে এ অঞ্চলটি আজ অনেক বেশি সমাদৃত। এলাকার মানুষের জন্য একটি বাসযোগ্য শিক্ষা বান্ধব পরিবেশের জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন। বর্তমানে দক্ষিণ কাট্টলীর অনেক মানুষ শিক্ষায় দীক্ষায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। ক্ষণজন্মা ডাক্তার ফজলুল আমীন চিরকাল স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকবে। মহান আল্লাহ তায়ালা উনার আত্মার মাগফিরাত দান করুন। আমিন।

লেখক

প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ডা. ফজলুলহাজেরা ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধফাগুনের হাওয়া বয় মনের আঙিনায়
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে