স্মরণে শ্রদ্ধায় মহান নেতা স্বামী বিবেকানন্দ

ড. উজ্জ্বল কুমার দেব | মঙ্গলবার , ১১ জানুয়ারি, ২০২২ at ৮:০২ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গবেষণা করা বিষয়গুলির মধ্যে সম্ভবত একটি হল নেতৃত্ব এবং এটিকে বিভিন্ন উপায়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে। যদিও নেতৃত্ব নিয়ে অনেক কিছু বলা এবং লেখা হয়েছে, তারপরও নেতৃত্বের বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলা খুবই কঠিন। একইভাবে স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়েও অনেক লেখা ও বলা হয়েছে। তাঁকে একাধারে একজন সন্ন্যাসী, একজন সমাজ সংস্কারক, একজন জাতীয়তাবাদী, একজন দার্শনিক, একজন যোগী, একজন প্রখ্যাত লেখক, একজন বক্তা, একজন শিক্ষাবিদ এবং আরও অনেক কিছু বলা হয়েছে। কিন্তু একজন নেতা হিসেবে তাঁকে নিয়ে খুব কম বিশ্লেষণ বা গবেষণা করা হয়েছে। তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলি এখন খোলামেলা হতে শুরু করেছে। আগামীকাল স্বামীজীর জন্মদিন। এ উপলক্ষ্যে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই।
যদিও নেতৃত্বের অনেক সংজ্ঞা রয়েছে, তারপরও বেশিরভাগ মানুষ একমত যে, একটি সক্ষমশীল এবং ক্ষমতায়ন দৃষ্টিভঙ্গির আদর্শ বিকাশ লাভের মাধ্যমে বেঁচে থাকাই হল কার্যকর নেতৃত্বের মূলকথা। দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ বলতে সফল নেতাদের দ্বারা নির্বাচিত অনুপ্রেরণামূলক শব্দ বা বক্তৃতা যা সংগঠনের দিকনির্দেশনাকে স্পষ্টভাবে এবং সংক্ষিপ্তভাবে বোঝায়। একজন যোগ্য নেতা একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির দ্ধারা শক্তিশালীভাবে নিজের উদ্দেশ্যগুলিকে ব্যক্ত করতে পারে এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি আকর্ষণীয় এবং অনুপ্রেরণাদায়ক গ্রহণযোগ্য উপলব্ধি তৈরী করার মাধ্যমে তাঁর দল বা সংগঠনকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। আমরা জানি সমাজ বা রাষ্ট্রে বিদ্যমান বাস্তবতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উপলব্ধি করার পরে শুধু কেউ কেউ কৌশলগতভাবে চিন্তা করতে পারে এবং একটি ভবিষ্যতের রূপরেখা তৈরি করতে পারে। ম্যাক্স ডি প্রি ছিলেন একজন নেতৃত্ব বিশেষজ্ঞ, তাঁর মতে, একজন নেতার প্রথম দায়িত্ব হল বাস্তবতাকে সংজ্ঞায়িত করা এবং বাস্তব থেকে অবাস্তবকে আলাদা করতে পারা।
স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন সেই বিরল ব্যক্তিদের মধ্যে একজন যিনি বাস্তব ও আধ্যাত্মিক উভয় জগতের মধ্যে বিচরণ করতে পেরেছিলেন এবং একটি অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পেরেছিলেন যা কেবল বাহ্যিককে অভ্যন্তরীণের সাথে একীভূতই করেনি, বরং এটিকে পুনর্মিলনও করেছিল। প্রকৃত অন্তর্জগৎ আবিষ্কার করার জন্য সংগ্রামরত লোকদের ঈশ্বরানুভূতির সন্ধান ও দিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার তিনি সেসময়ে এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছিলেন, যাতে তৎকালীন ভারতবর্ষ যে পরাধীনতার রূঢ় বাস্তবতার মধ্যে ছিল তা মনে রেখে দেশের তরুণদের জনসাধারণের উন্নতির দিকে কাজ করার জন্য আহবান ছিল। এই কাজের মাধ্যমে, তিনি চেয়েছিলেন যে তারা তাদের আসল অন্তর্নিহিত আত্মাকে আবিষ্কার করুক। এই বাস্তবতার একটি উপলব্ধি এবং এই বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে তিনি রামকৃষ্ণ মঠ এবং মিশন স্থাপনে ‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্বিথায়চঃ’ – জগতের মুক্তি ও কল্যাণের মাধ্যমে আত্মাকে লাভ করার মাধ্যমে নিজের মুক্তি-এ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছিলেন।
দূরদৃষ্টিসম্পন্ন স্বামী বিবেকানন্দের দুটি পৃথক চিন্তাধারা ছিল-একটি জাতীয় এবং অন্যটি বৈশ্বিক। জাতীয় স্তরে, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দেশের জনসাধারণের জীবনমান এমন একটি ভাবের মাধ্যমে উন্নীত করা যাতে তাঁরা আধ্যাত্মিক এবং ঐতিহ্যের মেলবন্ধন খুঁজে পায়। আমেরিকার শিকাগো বিশ্ব ধর্মসম্মেলনে তিনি হিন্দু ধর্মকে একটি সার্বজনীন ধর্মের ধারণা হিসাবে তাঁর একটি বক্তৃতায় এ ধর্মের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এটি এমন একটি ধর্ম, যাতে নিপীড়ন বা অসহিষ্ণুতার কোনো স্থান নেই, যেটি প্রতিটি নর-নারীর মধ্যে দেবত্বকে স্বীকৃতি দেবে এবং যার সমগ্র পরিধি, সমস্ত শক্তি, মানবতাকে তার নিজস্বতা উপলব্ধি করতে সহায়তা করার জন্য তৈরী’। এই দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান বিশ্বে আগের চেয়ে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।
বিবেকানন্দ শুধু একজন অনুপ্রেরণাদায়ক নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন অত্যন্ত বাস্তববাদীও। তিনি শুধু ‘সেবক-ভিত্তিক নেতৃত্বে’ বিশ্বাস করেননি বরং তার চারপাশের সকলকে ক্ষমতায়নের জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করেছেন। ১৮৯৫ সালে লন্ডনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা থেকে স্বামী বিবেকানন্দের নেতৃত্বের দিকটি দেখা যায়। ঐসময় তিনি স্বামী সারদানন্দের সাথে লন্ডনে এসেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের একটি পাবলিক বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। যখন উঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার সময় হল, স্বামীজী হঠাৎ ঘোষণা করলেন যে স্বামী সারদানন্দ তাঁর পরিবর্তে বক্তৃতা দেবেন। বিস্মিত হলেও, সারদানন্দ সেদিন এবং তার পরেও চমৎকার বক্তৃতা করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ বুঝতে পেরেছিলেন যে সারদানন্দকে তার আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য সামান্য চাপ প্রয়োগের প্রয়োজন ছিল। এই ঘটনাটি থেকে হয়তো খুব বেশি কিছু বলা যাবে না, তবে স্বামী বিবেকানন্দের নেতা তৈরী, নেতৃত্ব পরিচালনা শৈলীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মনে হবে অনেক বড় কিছু। স্বামী বিবেকানন্দের সবসময় তাঁর অনুসারীদের প্রতি উচ্চ প্রত্যাশা ছিল এবং তিনি স্পষ্টভাবে তাদের কাছে তা জানিয়েছিলেন। নেতারা তাদের অনুগামীদের তাদের উপর বিশ্বাস করে ক্ষমতায়ন করে এবং ফলস্বরূপ তারা মহানুভব হয়ে উঠে। যোগ্য নেতারা অন্যকে বড় করে নিজেকে বড় করে তোলেন। মহান নেতারা ক্রমাগত তাঁর চারপাশের জনগণকে নির্ভরতা থেকে স্বাধীনতা এবং পরবর্তীতে আত্মনির্ভরতার দিকে নিয়ে যাওয়ায় লক্ষ্য রাখেন। স্বামী বিবেকানন্দ ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল’-এর পরিবর্তে ‘ক্ষমতায়ন এবং সুবিধা প্রদান’- এর দর্শন বেছে নিয়েছিলেন।
নেতৃত্বের বিকাশে বিশ্বাস প্রক্রিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নেতা যদি তাঁর অনুসারীদের বিশ্বাস না করেন, তাহলে তিনি ক্ষমতায়নের পরিবর্তে, তাদের নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করবেন। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্যদের কাজের সর্বোচ্চ স্তরের জন্য পরামর্শ দেওয়ার সময় তাঁদের সক্ষমতার উপর পূর্ণ আস্থা রেখেছিলেন। ১৮৯৭ সালে তাঁর সরাসরি শিষ্য স্বামী শুদ্ধানন্দকে লেখা চিঠি থেকে তাঁর চারপাশের লোকদেরকে উচ্চ স্তরের কর্মক্ষমতা অর্জনের জন্য অনুপ্রাণিত করার জন্য তাঁর তাগিদ দেখা যায়। তিনি লিখেছিলেন, ‘ভাই, আমি চাই আমার প্রতিটি সন্তান আমার থেকে একশো গুণ বড় হোক। তোমাদের প্রত্যেককেই এক একটা বিশাল নেতা হতে হবে। আনুগত্য, প্রস্তুতি এবং কারণের প্রতি ভালোবাসা-এই তিনটি যদি তোমাদের কাছে থাকে তবে কিছুই তোমাদের আটকে রাখতে পারবে না’। এ দ্বারা স্বামীজির আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা এবং লোকেদের অনুপ্রাণিত ও বিকাশমান করার ক্ষমতাকে দেখতে পাই আমরা।
যুবকদের জন্য স্বামীজির আহ্বান হলো, দেশের যুবকরা রাজনৈতিকভাবে দেশের জন্য কাজ করুক। তিনি মনে করতেন, যুবকদের আধ্যাত্মিক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার ইতিবাচক সম্ভাবনার সাথে প্রচুর সৃজনশীল শক্তি রয়েছে। ‘উঠো, জাগো এবং লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত থেমো না। নিজের উপর বিশ্বাস রাখো, তুমি সব করতে পারবে’! স্বামীজির এমন আহ্বান, যুবসমাজকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। একজন মহান নেতার লক্ষ্য হল মানুষকে নিজের সম্পর্কে আরও উচ্চ চিন্তা করতে সাহায্য করা। এটি সম্ভবত যুবকদের আত্মবিশ্বাসী করার জন্য ঐ সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা স্বামী বিবেকানন্দের সেরা উক্তি। স্বামী বিবেকানন্দের মতো মহান একজন নেতার জন্মদিনে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ,
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশের আশাতীত অগ্রযাত্রা : এবার ভাবতে হবে জ্বালানি খাত নিয়ে
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল