স্মরণ: ভাষা সংগ্রামী বদিউল আলম চৌধুরী

অসিত দাশ পুলক | শুক্রবার , ১০ অক্টোবর, ২০২৫ at ৭:০১ পূর্বাহ্ণ

বৃটিশ শাসনামলে বাংলার নওয়াব রেজা খাঁর আমলে পরিচিতি লাভ করে উত্তর কাট্টলী। বিখ্যাত জমিদার বাড়ির (নাজির বাড়ি) প্রতিষ্ঠাতা আদিপুরুষ মোহাম্মদ হাশিম নাজির খান চৌধুরী। তাঁরই পৌত্র জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরী। তাঁদেরই বিশাল সম্পত্তি কর্নেলহাট দিঘি (যা বর্তমানে ভরাটকৃত প্রশান্তি আবাসিক এলাকা) দিঘির পশ্চিমপাড়ে ঢাকাচট্টগ্রাম ট্রাঙ্করোডের পূর্ব পাশে ফয়েজ আলী চৌধুরী ও তাঁরই ভাগিনা মরহুম নাজির আহমেদ চৌধুরীর যৌথ প্রচেষ্টায় কর্নেলহাট দিঘির পাড়ে ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কাট্টলী মাধ্যমিক ইংলিশ স্কুল (এম ই স্কুল )

কিন্তু সময়ের দুর্ব্যবহার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অবহেলার শিকার হয়ে এ বিদ্যালয় যখন বিলুপ্তির পথে ঠিক সেই সময় কাট্টলীর কৃতী সন্তান বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য, কোলকাতা হাইকোটের স্বনামধন্য আইনজীবী, প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র, গণপূর্ত, সংখ্যালঘু মন্ত্রী মরহুম এডভোকেট নুরুল হক চৌধুরী এগিয়ে আসেন শিক্ষাব্রতের অনির্বান শিখা হয়ে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখার্জীর নিকট বিদ্যালয়টির স্বীকৃতির জন্য আবেদন জানালে উপাচার্য মহোদয় কাট্টলী মাধ্যমিক ইংলিশ স্কুলকে কাট্টলী নূরুল হক চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় নামে অনুমোদন দেন।

মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের মূলে রয়েছে শিক্ষা। সভ্যতার আদিকাল থেকে বিশেষ করে গ্রীক সভ্যতা থেকে শুরু করে বর্তমান কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জাতির বিকাশ ও উন্নতি সাধিত হয়ে আধুনিক পর্যায়ে এসেছে। মূলত আধুনিক শিক্ষার গোড়াপত্তন হয় সর্বপ্রথম গ্রীসে। এজন্য গ্রীসকে বলা হয় আধুনিক শিক্ষার জন্মভূমি। সভ্যতার ক্রমবিকাশ ধারায় পরবর্তীকালে ষোড়শ শতকে ইউরোপে সৃষ্টি হয় নবজাগরণ আন্দোলন। এ নবজাগরণ আন্দোলনের ফলে ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মানুষের সার্বিক মুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটে। যাকে বলা হয় মানবতাবাদ। মানবতাবাদের প্রধান লক্ষ্য শিক্ষা প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে থাকবে মানুষ অন্য কিছু নয়। এই ভাবনায় বৃটিশভারতেও রামমোহন রায়, রামকমল সেন, দ্বারকানাথ ঠাকুর, স্যার সৈয়দ আহমেদ, নবাব লতিফ, সৈয়দ আমির আলী প্রমুখ শিক্ষাবিদ জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি ভারতবাসীকে আগ্রহী করে তোলে। মূলত এসব কর্মকাণ্ড উনিশ শতকে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের বাস্তব রূপ পরিলক্ষিত হয় সমগ্র ভারতবর্ষে। যার সুফল কাট্টলী মাধ্যমিক ইংলিশ স্কুল (এম ই স্কুল ) পরবর্তীকালে এর নামকরণ করা হয় কাট্টলী নূরুল হক চৌধুরী উচ্চ বিদ্যলয়।

সময় ১৯৪১ সাল। যাঁদের ভূমি, শ্রম ও অর্থের বদৌলতে প্রায় ৮৫ বছরের প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে আছে,সেসব মহান প্রতিষ্ঠাতাদের বিনম্র চিত্তে স্মরণ করছি। তাঁরা হলেনমরহুম নজির আহমেদ চৌধুরী, মরহুম জমিদার ফয়েজ আলী চৌধুরী, মরহুম এডভোকেট নুরুল হক চৌধুরী, মরহুম মৌলভী ছিদ্দিক আহমেদ চৌধুরী, মরহুম আহমেদ কবীর চৌধুরী, মরহুম আতাউর রহমান চৌধুরী, মরহুম মাহাবুবুর রহীম চৌধুরৗ, মরহুম ফসিউল আলম চৌধুরী, মরহুম খোরশেদ আলম চৌধুরী, মরহুম বদিউল আলম চৌধুরী ও মাওলানা তমিজুর রহমান চৌধুরী।

এ বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ভাষা সংগ্রামী বদিউল আলম চৌধুরী। জন্ম: ১৯৩২ মৃত্যু: ১০ অক্টোবর ২০০৭। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তাঁর কৃতী সন্তানরা হলেন: . নাজনীন কাউসার চৌধুরী (সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার), রাজনীতিবিদ ও শিক্ষানুরাগী আহমেদ উল আলম চৌধুরী, (রাসেল), অ্যাডভোকেট কানিজ কাউসার চৌধুরী (অতিরিক্ত জিপি, চট্টগ্রাম জজ কোর্ট), অ্যাডভোকেট মাহমুদ উল আলম চৌধুরী মারুফ, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট (হাইকোর্ট বিভাগ) ও জজ কোট, চট্টগ্রাম। এছাড়াও কাট্টলী নুরুল হক চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

বঙ্গোপসাগরের উপকূল উত্তর কাট্টলী। সাগরের নোনাজল, হিংসুটে জলোচ্ছ্বাস আর বার আউলিয়ার আশীর্বাদপুষ্ঠ মরহুম বদিউল আলম চৌধুরী। ব্যক্তি হিসাবে তিনি যেমন ছিলেন আধুনিক, সময়োপযোগী ও সৃষ্টিশীল তেমনি আবার তাঁর সমগ্র সত্তা জুড়ে রয়েছে মামাটিমানুষ আর শিকড়ের প্রতি তীব্র অনুরাগ। আর ছিল দেশের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা। দেশ বিভক্তির প্রাক্কালে গোটা পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ মানুষের মুখের ভাষাকে অগ্রাহ্য করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় তখন ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ অনেক বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদ জানান। পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গড়ে উঠে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তমুদ্দুন মজলিস। এই সংগঠন দেশব্যাপী ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। বিশেষ করে চট্টগ্রামেও রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রশ্নে তমুদ্দুন মজলিস নামক সাংস্কৃতিক সংগঠনটি নেতৃত্ব দেয়। যার অগ্রভাগে ছিলেন সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী ও তমুদ্দুন মজলিস নেতা আজিজুর রহমান। সাহসের ইস্পাত কঠিন দৃঢ় মনোবল নিয়ে পাদপ্রদীপের মতো এগিয়ে এসেছিলেন সেই সময়ের তমুদ্দুল মজলিসের তরুণ তুর্কি বদিউল আলম চৌধুরীর মতো অনেকে। যাঁরা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে ক্রমাগত মিছিল বের করেন। সংগ্রাম আর সৃষ্টি মিশে আশে তাঁর মস্তিস্কের প্রতিটি নিউরনে। তিনি যেমন ছিলেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে আপোসহীন আবার বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে তিনি অগ্রসৈনিক। আবার মানবিক সমাজ অন্বেষণে তুলনাহীন। পুরো জীবন যৌবন তিনি ব্যয় করেছেন দেশ দেশমাতৃকার কল্যাণে। পরাধীনতার শৃঙ্খলকে তিনি ভেঙেছেন বুক চিতিয়ে। আবার রাষ্ট্রীয় নাগরিককে স্নিগ্ধ কোমল চিত্তে আলিঙ্গন করেছেন শিক্ষাঙ্গনের সবুজ ক্যাম্পাসে। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন একটি সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রগঠনের নিয়ামক শক্তি শিক্ষা। এজন্য তাঁদেরই প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তিনি কাট্টলী নূরুল হক চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের নিরবচ্ছিন্ন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসাবে এবং ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ ও ২০০৬ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে তৎকালিন মূলভবনের ৩য় তলা নির্মিত হয়। ২০০৬ সালের তথ্য অনুযায়ী শুধু স্কুল ব্যতীত শপিংকমপ্লেক্সএ তাঁদের দানকৃত পারিবারিক সম্পত্তি প্রায় ৮ গণ্ডা। যা থেকে বিদ্যালয় আয় করেন বার্ষিক ৬ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা। আর সালামী প্রাপ্ত হন ৬৭ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা। তাঁর সময়ে বিজ্ঞান গবেষণাগার (পদার্থ, জীব, রসায়ন), মোহাম্মদজামান স্মৃতি লাইব্রেরি ও ফয়েজআলী চৌধুরী মেমোরিয়াল কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া বিদ্যালয়ের আয়বর্ধকের জন্য নিচতলায় শপিংকমপ্লেক্স নির্মিত হয়। তিনি মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি উচ্চ বিদ্যালয় ও সেন্ট প্লাসিডস হাই স্কুলের সহসভাপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন।

মৃত্যু পার্থিব জগতের অনিবার্য সত্য, কিন্ত মৃত্যুর একটা সময় অসময় থাকা উচিত মানুষ অন্তত তা চায়। বার্ধ্যক্যের মৃত্যু অনেকটা শেষ বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের মতো। আবার কিছু কিছু মৃত্যু মধ্যাকাশের গনগনে পড়ন্ত সূর্যের আচমকা পতনের মতো। আমাদের ভাষাসংগ্রামী বদিউল আলম চৌধুরীর মুত্যু আচমকা সূর্যের পতনের মতো। নগরের আলো ঝলমলে পরিবেশে বাস করেও তাঁর মন ছুটে যেতো গ্রামীণ সেই কাঁদামাখা পরিবেশে। যেখানে তিনি খুঁজে পেতেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া শৈশবকে। তাইতো শেষ জীবনে বেছে নিয়েছেল তাঁর পৈতৃক ভিটাকে। আর দায়িত্ব নিয়েছেন অজস্র শিক্ষকশিক্ষার্থীর সুন্দর কলরবে ভরপুর কাট্টলী নুরুল হক চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়কে। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। কোনো স্বপ্ন ভেঙে গেলেও তিনি হতাশ হতেন না। কারণ তাঁর বিশ্বাস, ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন ভাঙা আয়নার মতো, যেখানে অনেকগুলোর আয়নার জন্ম হয়। অর্থাৎ স্বপ্নের কোনো মৃত্যু হয় না। প্রকৃতির চিরঞ্জিব বহমান স্রোতে স্বপ্ন ধাবিত হয় পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। এ স্বপ্ন নিয়ে তিনি অবিরাম কাজ করতেন কাট্টলী নুরুল হক চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়কে নিয়ে। শিক্ষাবিষয়ক সেমিনারে তাঁর বিশ্লেষণাত্বক উপস্থাপন, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক নিয়ে তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা আর শিক্ষকের দায়বদ্ধতা এছাড়াও একজন মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিশু তাঁর শিক্ষাক্যাম্পাস থেকে বেড়ে উঠুক, প্রত্যাশার এই আলোক রশ্মি সারাক্ষণ বয়ে বেড়াতো তাঁর মস্তিস্কের প্রতি শিরা উপশিরায়। শেষান্তে ইচ্ছাপাহাড়ের গায়ে জন্ম নেওয়া গুল্ম যেমন বুঝতে পারে না পাহাড়ের বিশালতা তেমনি আমরাও এ বিশাল মহৎ হৃদয়ের মানুষটির খুব কাছে থেকেও জানতে পারিনি তাঁর বিশালত্ব। শুধু প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছি তাঁর মতো বিরাট হৃদয় আর শিক্ষাবান্ধব ব্যক্তির আজ বড় প্রয়োজন।

লেখক: শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউম্মতের প্রতি প্রিয় নবীজির (সা.)- বিশেষ কিছু অসিয়ত
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা