বাংলাদেশের ১১তম নৌ–বাহিনী প্রধান ভাইস এডমিরাল সরওয়ার জাহান নিজাম এনডিইউ,পিএসসি,বিএন গত শুক্রবার সকালে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহে রাজেউন। চট্টগ্রামের এই কৃতী সন্তান ২০০৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ১১তম নৌ–বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এর পূর্বে ২০০৫ সালে তিনি বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের ৬ষ্ঠ মহাপরিচালক ছিলেন।
ভাইস এডমিরাল সরওয়ার জাহান নিজাম ১৯৫২ সালের ২৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার তৈলারদ্বীপ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম হাবিবুর রহমান নিজাম দীর্ঘদিন ৬নং বারখাইন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। মরহুম ও আর নিজাম ছিলেন তাঁর জেঠা। নয় ভাইবোনের মধ্যে সরওয়ার জাহান নিজাম ছিলেন ষষ্ঠ। আনোয়ারা কর্ণফুলী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সরওয়ার জামাল নিজাম তাঁর বড় ভাই এবং ঢাকা বদরুন্নেসা সরকারি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রফেসর লুৎফুন্নাহার নিজাম তাঁর বড়বোন। তাঁর অন্যান্য ভাই–বোনরাও স্ব–স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তিনি তৈলারদ্বীপ বারখাইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শেষে ১৯৬২ সালে তৈলারদ্বীপ বারখাইন এরশাদ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন, সেখানে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি পর্য়ন্ত লেখাপড়া করে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন। চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে এসএসসি, ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। কিন্তু অনার্স শেষ করার পূর্বেই তিনি পাকিস্তান নৌ–বাহিনীতে ১৯৭০ সালে অফিসার ক্যাডেট হিসাবে যোগদান করে প্রথম ছয় মাস কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে ৪৬তম পিএমএ লং কোর্স শেষ করেন এবং অক্টোবর ১৯৭০ সালে করাচীতে অবস্থিত পাকিস্তান নেভাল একাডেমিতে যোগ দেন। একাডেমিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে তিনি মিডশীপম্যান পদে পদোন্নতি পান । ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়। সরওয়ার জাহান বাঙালি হওয়ার কারণে তাঁকে সীমান্ত প্রদেশের আশ্রয় শিবিরে প্রেরণ করা হয়। দীর্ঘ বাইশমাস পাকিস্তান কোহাট ও লায়ালপুর বন্দী শিবিরে অন্তরীণ থাকার পর ১৯৭৪ সালের ৭ জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে এসে নৌবাহিনীতে মিডশীপম্যান হিসাবে যোগদান করেন।
নৌ বাহিনীতে দীর্ঘ ৩৮ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে তিনি দেশ বিদেশে ট্রেনিং, সমুদ্র ও জাহাজে নাবিক জীবন, শ্রীলংকায় সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে কূটনেতিক জীবন, ১৯৮৬ সালে ঢাকার ডিফেন্স সার্ভিস অ্যান্ড স্টাফ কলেজ এবং ১৯৯৬ সালে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের জাতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন, চট্টগ্রাম মেরিন ফিশারিজ একাডেমির অধ্যক্ষ, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের মহাপরিচালক এবং সবশেষে ২ বছর বাংলাদেশ নৌ–বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ২৮ জানুযারি ২০০৯ তিনি অবসরে যান। নৌ–বাহিনীতে তিনিই প্রথম তিন তারকার ভাইস এডমিরাল হিসাবে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। উল্লেখ্য, বৃহত্তর চট্টগ্রামের গর্বিত সন্তান হিসেবে সরওয়ার জাহান নিজামই সর্বপ্রথম বাংলাদেশের নৌ–বাহিনী প্রধানের পদ অলংকৃত করেন।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলংয়কারী ঘুর্ণিঝড়ের এক সপ্তাহ আগে তিনি চট্টগ্রাম মেরিন ফিশারিজ একাডেমির অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করে একাডেমির প্রচুর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। তিনি ১৯৯৪ সালে ঈসা খান নেভাল বেইসের অধিনায়ক ছিলেন, প্রায় তিনবছর একাধারে বৃটিশ ফ্রিগেট ওমর ফারুক এর অধিনায়ক থাকাকালীন সময়ে তিনি কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ফ্লিট রিভিউতে যোগ দেন। ২০০০ সালে শ্রীলংকায় বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসাবে চাকরিকালে তিনি দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটান। এসময় তিনি কমোডর পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন। দেশে ফিরে তিনি আঞ্চলিক নৌ কমান্ডার এবং পিএসও হিসাবে নৌ সদরে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে সরওয়ার জাহান বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের মহাপরিচালক পদে নিয়োগ লাভ করেন। তাঁর সময়কালে ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী ঢাকার আগারগাওয়ে কোস্ট গার্ডের সদর দপ্তরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। কোস্ট গার্ডে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ২০০৬ সালের ২১ জুন দুই তারকার রিয়াল এডমিরাল পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ তারিখে তাঁর নাম নৌ প্রধান হিসাবে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি দেশের ১১তম নৌ প্রধান হিসাবে তিনি এ পদে যোগদান করেন। দুই বছর তিনি নৌ প্রধান হিসেবে বাহিনীর অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেন। বিশেষ করে সাড়ে পাঁচ বছর ধরে অচল পড়ে থাকা জাহাজকে তিনি রি–কমিশন করে সচল করেন। জাহাজ ক্রয়সংক্রান্ত মামলা সমাধান করেন, ক্ষতিগ্রস্ত অফিসারদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করে নৌ–বাহিনীর ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।
সরওয়ার জাহান নিজাম একজন ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল, টেনিস এবং স্কোয়াস নিয়মিত খেলতেন। টেনিসে তিনি আশির দশকে নৌবাহিনীতে চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেন। ২০০৩ সাল থেকে তিনি গালফ খেলা শুরু করেন এবং এ খেলায় তিনি অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন। তিনি একজন সুলেখক ছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ঢেউয়ের পরে ঢেউ’–এ সরওয়ার জাহান নিজাম লিখেছেন ছোটবেলা হতে তিনি দৈনিক আজাদী কাগজে লেখালেখি করতেন। পরবর্তীতে নেভীর ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন নৌ পরিক্রমায় নিয়মিত লিখতেন। নৌ প্রধানের পদে অলংকৃত হবার পর নৌ ভবনে বসে গভীর রাতে একটু একটু করে প্রায় দেড় বছরের মাথায় তিনি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ঢেউয়ের পরে ঢেউ রচনা করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খুবই ধার্মিক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন কীর্তিমান মানূষকে হারালেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন, আমিন।
লেখক: সরকারি কর্মকর্তা, সাবেক দপ্তর সম্পাদক, চট্টগ্রাম সমিতি–ঢাকা।